শনিবার ৩১ মে ২০০৮ দিন ৪১৫আদালতের পূর্বানুমতি নিয়ে ব্যারিস্টার খোকন এসেছিল পরামর্শের জন্য। ও আমাকে বলেছে কয়েকজন আইনজীবীর কাছে বিচারপতি রুহুল আমিন অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে বর্ণনা করেছেন কোন পরিস্থিতিতে তাকে কাজ করতে হয়েছে- কীভাবে একদিন সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র লোকেরা তার বাড়িতে ঢুকে ন্যক্কারজনক ভাষায় গালাগালি করে তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে এবং অকথ্য ভাষায় অবর্ণনীয়ভাবে কেমন করে তাকে অপমান ও নিপীড়ন করেছে। এসব সত্যি হলেও কথা থেকে যায়, তিনি ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াননি কেন? নিজের কোন দুর্বলতার কারণে তাকে সামরিক বাহিনীর লোকদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে? তিনি তো রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাদের সকলের ঊর্ধ্বে ছিলেন।
কয়েকদিন আগে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী আইনজীবীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে উন্মুক্ত আদালতে বলেছেন, “আমরা, বিচারপতিরা আর আপনাদের জামিন দেওয়ার ক্ষমতা রাখি না- জামিনের ফরিয়াদ আপনাদের জানাতে হবে আল্লাহ্র কাছে।’ হাইকোর্ট বিভাগ থেকে জামিন মঞ্জুর করার পর আপিল বিভাগে গিয়ে যখন সেই আদেশ পাল্টে যায় তার ওপর তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়েই তিনি একথা বলেছেন। তার বক্তব্য জনগণের দ্বারা উচ্ছ্বসিতভাবে প্রশংসিত হয়েছে। শিরোনাম হয়েছে খবরের কাগজে। কিন্তু জানা গেছে প্রধান বিচারপতি তাকে ডেকে নিয়ে পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ কথা শুনে বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিচারপতি চৌধুরীর কাছে ছুটে গেছেন ও তাঁকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। কথাটা কতোটুকু সত্য জানি না।
রবিবার ১ জুন ২০০৮ দিন ৪১৬আমাকে এখন শেরেবাংলা নগরে “সার্বভৌম”- সংসদের পবিত্র ভবনে স্থাপিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিতে হচ্ছে।
জনগণের প্রবেশাধিকার বর্জিত এই ট্রাইব্যুনালে চলছে আমার বিরুদ্ধে আনা দু’টি মামলা। এদের মধ্যে একটি হলো নাইকো এবং অন্যটি আমার আয় ও সম্পদসংক্রান্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের চার্জশিটভুক্ত মামলাটি।
নাইকো মামলা চলাকালে বেগম খালেদা জিয়ার পাশে ডকে বসে আমি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতবিনিময় করেছি। তিনি আদালতের নিয়মকানুন জানেন না বলে সেখানে কিছু বলতে উৎসাহিত ছিলেন না অথচ গত ৯ মাস ধরে জনগণ তার দেখা পাননি বা তার কোনো কথা শুনতে পায়নি। তাই আমার পরামর্শে আদালতের অনুমতি নিয়ে তিনি ২০ মিনিটব্যাপী এক কড়া রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। তাকে রুখার সাহস বিচারকের হয়নি। আমিও মামলার অসারতা নিয়ে বক্তব্য রাখি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিরাটসংখ্যক আইনজীবী ও সাংবাদিক। এটি একটি প্রকাশ্য আদালত হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। আমি হাজিরা দেই কয়েকশ’ গজ দূরে অপর ট্রাইব্যুনালে আমার দ্বিতীয় মামলায়।
সোমবার ২ জুন ২০০৮ দিন ৪১৭সকল নিষেধাজ্ঞা ভেঙে সংবাদপত্রগুলো গতকাল আদালতে খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্য প্রধান শিরোনামে প্রকাশ করেছে। সেখানে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এই বক্তব্যের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ছিল সুদূরপ্রসারী এবং দলের সর্বস্তরের নেতা ও কর্মীদের মানসিকতা চাঙ্গা করে তুলতে তা বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে ।
সরকার এখন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতাদের নিপীড়নের এক নয়া অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে। গত ১৭ দিন যাবৎ সরকার শুরু করেছে ব্যাপক ধরপাকড়। এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় কুড়ি হাজার জনকে। এটি সরকাবের অন্তঃসারশূন্যতা ও হীনমন্যতারই আরেকটি প্রমাণ। একই সাথে জাতীয় পর্যায়ে চলছে রাজনৈতিক সংলাপ আর স্থানীয় পর্যায়ে চলছে নির্বিচারে গ্রেফতার।
এ সরকারের পতন অনিবার্য।
মঙ্গলবার ৩ জুন ২০০৮ দিন ৪১৮আওয়ামী লীগের বিভাজনের রাজনীতির আরেক পর্যায়ের সূচনা ঘটলো। দলের প্রেসিডিয়ামের এক বৈঠকে তারা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা খালেদা জিয়া ঘোষিত জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে যোগ দেবে না এবং আমাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির সুযোগ নিয়ে সরকারকে পুরোদমে কাজ চালিয়ে যেতেই সহায়তা করবে। ১৯৭৫ সালের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, আওয়ামী লীগ কখনোই। সত্যিকারের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না এবং উচ্চ গুণসম্পন্ন কোনো নির্বাচনে তারা উৎসাহিত নয়। এখানে নীতিগত বিষয়টি একেবারেই মুখ্য নয়।
আজ আমি গিয়েছিলাম হাসপাতালে। সেখানে আমাকে ডান বাহু, কাঁধ, পা এবং পিঠে নিবিড় ইস্ট্রেনিক থেরাপি ও হালকা ব্যায়াম করানো হয়েছে।
বুধবার ৪ জুন ২০০৮ দিন ৪১৯আপিল বিভাগের রায়ে উৎসাহিত হয়ে সরকার এখন আরও নির্বিচারে জরুরি আইন ব্যবহার করে সকল পর্যায়ে রাজনীতিবিদদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে গত ৫ দিনেই সরকার গ্রেফতার করেছে প্রায় ৮ হাজার মানুষকে। কোনো প্রকার জামিন না দিয়ে রাজনীতিবিদদের জেলখানায় বন্দি করে রাখার এক মহোৎসব চলছে। এই ধরনের কৃষ্ণতম বিচারিক সিদ্ধান্তের ছদ্মাবরণের আগের যে কোনো সময়ের চাইতে জরুরি আইনের ১৬(২) ধারা এখন অধিকতর হারে অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, সার্বভৌম সংসদের যে পবিত্র কক্ষগুলোতে বসে জনগণের জন্য আইন তৈরি করা হয়, জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা হয় সেখানেই এখন দেশের দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ জনপ্রতিনিধিদের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটি ট্রাইব্যুনালে একটি ও অন্য একটি ট্রাইব্যুনালে আরেকটি- একই দিনে একই সময়ে চলছে তাদের বিরুদ্ধে দু’টি বিচারের প্রক্রিয়া।
দেশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে সহিংস ধর্মঘট ও অস্থিতিশীলতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ছাত্রদের সহিংস বিক্ষোভের মুখে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
বৃহস্পতিবার ৫ জুন ২০০৮ দিন ৪২০গতকাল গ্যাটকো মামলা চলাকালে খালেদা জিয়া তার অসুস্থ ছেলে সহ-অভিযুক্ত কোকোকে আলিঙ্গনকালে যে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয় সে করুণ স্মৃতি জনগণের মনে চিরজাগরূক হয়ে থাকবে। ট্রমাটিক সিজারে আক্রান্ত কোকো যখন বসে ছিল হুইলচেয়ারে তার হাত ও পা কাঁপছিল থরথর করে, মুখে বাধা ছিল অক্সিজেন মাস্ক। কোর্টরুমে অশ্রুভারাক্রান্ত অবস্থায় তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কর্তব্যরত ডাক্তার ও নার্স। টেলিভিশনের পর্দায় এই সবই দেখানো হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো সহঅভিযুক্তকে এভাবে আদালতে হাজির করার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোনো আদালতে আছে বলে আমার মনে হয় না। এর মধ্যে দিয়ে বন্দুকধারীরা কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চান?
এর কয়েকদিন আগে মিগ-২৯ মামলার প্রধান অভিযুক্ত শেখ হাসিনার সাথে সাবেক চিফ অব আর্মী স্টাফ মুস্তাফিজুর রহমানকে অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে সহ-অভিযুক্ত হিসেবে হাজিরা দিতে নিয়ে আসা হয়েছিল আদালতে। এরও আগে দু’জন সাবেক মন্ত্রীর সহ-অভিযুক্ত স্ত্রী সিগমা হুদা ও সাবেরা আমানের বেলায়ও ঘটেছিল একই ঘটনা।
এই বন্দুকধারীরা কারা? তারা কী চান? কেন এরা এতো নির্দয়? তারা কি বাংলাদেশের নাগরিক? ওদের বাবা, মা, ভাই, বোন কি এদেশে বসবাস করেন না?
আমি অনেকবার বলেছি যে, এটা হলো একটি অবয়ববিহীন, বিশ্বস্ততাবিহীন, যুক্তিবিহীন, লক্ষ্যবিহীন অমানবিক সরকার যাকে আধুনিক রাজনৈতিক ডিকশনারিতে। সংজ্ঞায়িত করা যাবে না
শুক্রবার ৬ জুন ২০০৮ দিন ৪২১আমি এখন নাইকো মামলার সব কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখছি। এভিডেন্স হিসেবে দেখানো আনীত এফআইআর, চার্জশিট, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৬১ ধারায় সাক্ষীদের বিবৃতি এবং এতদসংক্রান্ত অন্যান্য তথ্যাদি ও ফাইলপত্র মামলার নথিতে আমার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য বা প্রমাণ উপস্থাপিত করা হয়নি। এটি বাস্তব অর্থেই একটি তামাশা ও প্রহসন। তবে তাতে আমার ক্ষোভের কোনো কারণ নেই। কারণ, এ মামলার সুবাদেই আমি বেগম খালেদা জিয়ার সাথে নানা রকম রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলােচনার সুযোগ পাচ্ছি। ক্ষেত্রবিশেষে আমি পরামর্শ দিতে পারছি
শনিবার ৭ জুন ২০০৮ দিন ৪২২এবার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে বইয়ের ওপর। এতাদিন যাবৎ নিষেধাজ্ঞা ছিল লেখার কাগজ ও ফাইলের ওপর। এমন অভিজ্ঞতা কস্মিনকালেও আমার হয়নি। একটি যুক্তিবিহীন সরকারই কেবল এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে।
বাইরে থেকে বই আনানোর ওপর নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এরা এখন আমার বই অধিকারও কেড়ে নিতে চাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের মহিউদ্দিন আহমেদ আমার গবেষণা কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দু’টি বই পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু জেলখানার গেটেই সেগুলো আটকে দেওয়া হয়েছে। এখানে আইনের কোনো অস্তিত্ব নেই। জেলখানায় ওরা মুখে যা বলেন তাই হলো আইন। জেল সুপার বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন বন্দুকধারীরা। আমি জানি না কমিউনিস্ট কোনো দেশেও বই পড়ার ওপর এ ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার নজির আছে কি না এবং পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে এমনটি থাকতে পারে না। এমনকি ঔপনিবেশিক ভারতে পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহেরু জেলে বসেই তিনি অন্যান্য বই পড়া ছাড়াও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর তার যুগান্তকারী দু’টি বই দি ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া ও অ্যান অটোবায়োগ্রাফি লিখে গিয়েছিলেন।
রবিবার ৮ জুন ২০০৮ দিন ৪২৩আমি যা সন্দেহ করেছিলাম, তাই হতে চলেছে। শেখ হাসিনা জামিন ব্যতিরেকে তার মুক্তি নিশ্চিত করে সরকারের সাথে একটি আপস-রফা করতে যাচ্ছেন যার ফলে প্যারোলের একটি প্রশাসনিক আদেশের ভিত্তিতে তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেওয়া হবে এবং একই সাথে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বিভিন্ন আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত ১৩টি মামলায় ব্যক্তিগত হাজিরাদান থেকে অব্যাহতি পাবেন। তাছাড়া সেনাপ্রধানের সরকারের সাথে সমঝোতার কোনো শর্ত তাকে প্রকাশও করতে হবে না।
এই সমঝোতার ফলে সামরিক বাহিনীর কাঠামোতেও পরিবর্তন নিয়ে আসা হচ্ছে। ফলে সেনাবাহিনীতে আওয়ামী লীগ-ভারত অংশীদারিত্ব ও তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতের বিষয়টি আজ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এভাবে বাংলাদেশের গোটা রাজনীতি নতুন এক মোড় নিতে যাচ্ছে ।
(চলবে..)