ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এর তালিকা অনুসারে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বাসযোগ্য শহর নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড। হ্যা, ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের কোন শহর নয়, বরং ইআইইউ-র বিচারে করোনাকালে সেরা বাসযোগ্য শহরের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের সব চেয়ে বড় শহর অকল্যান্ডের নাম। এর আগেও বিভিন্ন সময় শহরটি তালিকায় উপরের দিকেই ছিল। কিন্তু এবার তালিকায় একেবারে এক নম্বরে উঠে আসার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে- করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারার সাফল্যকে।
ইআইইউ এক বিবৃতিতে বলেছে, করোনার কারণে ইউরোপের শহরগুলো তালিকার নীচের দিকে নেমে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শহরগুলো কীভাবে করোনা মোকাবিলা করছে, স্বাস্থ্য পরিষেবা কতটা ভাল, সেসব বিষয় এবার প্রাধান্য পেয়েছে। নিউজিল্যান্ডের কঠোর লকডাউন শহরটির সবকিছু আবার খুলে দিতে এবং অকল্যান্ড ও ওয়েলিংটনের মতো শহরগুলোর নাগরিকদের জীবনযাত্রা সেই প্রাক-মহামারীকালের অনুরূপ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু ওটাই একমাত্র কারণ নয়। অকল্যান্ড বিশ্বের সবচেয়ে বাসযোগ্য শহর হওয়ার পেছনে রয়েছে আরো নানাবিধ কারণ। অকল্যান্ড আধুনিক এবং সমৃদ্ধশালী এক শহর যা তার বাসিন্দাদের নানান সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে।
ব্যবসার সুযোগ প্রদান এবং সুন্দর লাইফস্টাইলের মধ্যে নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রেখে চলার কারণে শহরটি অনেকের কাছেই আদর্শ গন্তব্যস্থান।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অকল্যান্ডে পরিবারসহ বসবাস করছেন শাহরিনা আহমেদ। অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি'র স্নাতক শাহরিনা মানবজমিনকে বলছিলেন, "নিউজিল্যান্ডের আবহাওয়া এমনিতেই ভালো। আর অকল্যান্ডের আবহাওয়া গোটা নিউজিল্যান্ডের মধ্যেও সেরা। এছাড়া কালচারাল ডাইভার্সিটি, চাকরির সুযোগ অনেক দিক থেকেই শহরটি সেরা।"
শাহরিনার স্বামী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তানভীরুল ইসলাম অকল্যান্ডে আছেন প্রায় দুই দশক ধরে। তিনি বলছিলেন, "কিউইরা (নিউজিল্যান্ডের নাগরিক) ভালো। এখানকার আবহাওয়াও ভালো। এছাড়া কাজের জন্যও শহরটি ভালো।"
নিউজিল্যান্ডের একজন শিক্ষক ও প্রশিক্ষক ক্যাথি শেফার্ড মানবজমিনকে বলেন, "আমি বিশ্বের অনেক দেশ ঘুরেছি। নিউজিল্যান্ডের নাগরিক বলে বলছি না; অকল্যান্ড, ওয়েলিংটন- নিউজিল্যান্ডের শহরগুলো বসবাসের জন্য সত্যিই সেরা জায়গা। আমরা সবাইকে আমাদের দেশে স্বাগত জানাই।"
নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড, গার্ডিয়ান সহ বিশ্বের কিছু নামকরা পত্রিকা, ম্যাগাজিন থেকে পাওয়া গেলো এরকম আরো কিছু কারণঃ
*ভালো আবহাওয়াঅকল্যান্ডে শীত এবং গ্রীষ্মের মধ্যে নিখুঁত ভারসাম্য রয়েছে। গ্রীষ্মকাল উষ্ণ-গরম হলেও অতোটা গরম নয়। সিডনির ৪২-৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তুলনায় অকল্যান্ডের তাপমাত্রা গড়ে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতকালের আবহাওয়াও ভালো, সেসময় গড় তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়।
*কাজের সুযোগউৎপাদন, তথ্যপ্রযুক্তি এবং নির্মাণ শিল্পের মতো খাতগুলোতে বেকারত্ব বর্তমানে বেশ কয়েক বছর ধরে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। অকল্যান্ডে ইংরেজি বলতে পারা বা বিশেষজ্ঞদের জন্য কাজের ভালো সুযোগ রয়েছে। অকল্যান্ডের বড় নিয়োগকারীদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মালবাহী ফরওয়ার্ডার, এয়ার নিউজিল্যান্ড, ব্যাংক, বিমা প্রদানকারী সংস্থা এবং বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যসেবা গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানসাপেক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন বা মেলবোর্নের চেয়ে বেতন কিছুটা বেশিও হতে পারে।
*আশপাশ, পাড়া-প্রতিবেশীগ্রেটার অকল্যান্ড আসলে চারটি পৃথক শহরের এক গুচ্ছ। হাইওয়ের একটি নেটওয়ার্ক বেলে উপকূল, অগণিত বন্দর এবং নদীগুলোর মধ্য দিয়ে এগুলোকে সংযুক্ত করেছে। চারটি শহরেরই রয়েছে নিজেদের অনন্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। সাধারণভাবে পাড়াগুলো পারিবারিক বন্ধুত্বপূর্ণ, স্বচ্ছল। রয়েছে বিলাসবহুল মল, ফ্যাশনসচেতন মানুষ। উন্নত জীবনযাত্রার জন্য রয়েছে অনেকগুলো এলাকা।
*থাকার ব্যবস্থাঅকল্যান্ডে থাকার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরণের আবাসন ব্যবস্থা। সৈকত অঞ্চলে আবাসন চমৎকার জীবনের অভিজ্ঞতা দেবে। অপেক্ষাকৃত কম ব্যস্ত জায়গায় থাকতে চাইলে শহরের কেন্দ্র থেকে দূরে রয়েছে পরিবার-বান্ধব আবাসন। এছাড়া, উপকূল থেকে দূরেও অনেক সুন্দর বসবাসের বিকল্প স্থান রয়েছে। থাকার পরিবেশ বন্ধুত্বপূর্ণ এবং থাকার ব্যবস্থা প্রথম শ্রেণির। যদিও অকল্যান্ডে বাড়ির দাম আকাশছোঁয়া, কিন্তু জীবনযাত্রার মান বিশ্বের সেরা। অর্থ ঢাললেও তার মূল্য পাওয়া যায়।
*স্কুল এবং শিক্ষাঅকল্যান্ডের শিক্ষার মান অত্যন্ত উঁচু। অকল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রীয় অনুদানে, আংশিক অর্থায়নে এবং বেসরকারি সবভাবেই পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষকরা খুব ভালো এবং যোগ্য। গ্রেটার অকল্যান্ড অঞ্চলে ৫০০ টিরও বেশি স্কুল রয়েছে।
*সস্তা এবং মজার খাবারঅকল্যান্ড তার বৈচিত্র্যময় খাবারের জন্য বিখ্যাত। খাবার স্বাস্থ্যকর এবং সতেজ। অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী মূল্যে খাবার সরবরাহ করে এমন বিভিন্ন রেস্তোঁরা রয়েছে। অকল্যান্ড অনেক এশিয়ান রেস্তোরাঁয় ভরে গেছে যেখান সুস্বাদু খাবার সস্তায় পাওয়া যায়। অনেক ফুড কোর্ট এর পাশাপাশি রয়েছে অনেক রেস্তোঁরাও।
* চমৎকার সৈকতঅবসরে সময় কাটাবার জন্য অকল্যান্ডে রয়েছে চমৎকার সব সৈকত যেখানে পুরোদিন কাটিয়ে দেয়া যায়। অকল্যান্ডের সেরা কয়েকটি সৈকতের মধ্যে রয়েছে মিশন বে, সেন্ট হেলিয়ার্স, চেল্টেনহাম বিচ, মিলফোর্ড বিচ এবং বেথেলস বিচ। বেশিরভাগ সৈকতে সার্ফিং, সাঁতার কাটার পাশাপাশি বনভোজনও সেরে নেয়া যায়।
এতকিছুর পরও সব শহরেরই থাকে কিছু সমস্যা বা অসুবিধা। অকল্যান্ডও তার ব্যতিক্রম নয়। শাহরিনা যেমন বলছিলেন, "এখানে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি।"