বৈশ্বিক মহামারি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাসের গতি মনে হচ্ছে পরিবর্তিত হচ্ছে। ভাইরাসের বিচিত্র স্বভাব, চরিত্র, চেহারর মতোই বদলে যাচ্ছে গতিপথও। উন্নত জগত থেকে ক্রমশ সরতে সরতে করোনার প্রকোপ কঠিনতর হচ্ছে অনুন্নত বিশ্বে। সর্বশেষ পরিস্থিতিতে এমনই চিত্র দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ইউরোপ, আমেরিকায় মৃত্যু ও আক্রান্তের হার কমছে। আর বাড়ছে ভারত তথা এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে।
ইউরোপ ও আমেরিকা ক্রমশ করোনার কবল থেকে মুক্তি পাওয়ায় ধনী দেশগুলোর গোষ্ঠী জি-৭ নেতাদের এজেন্ডায় বিষয়টি মূল গুরুত্ব পায় নি। কারণ ভারত ও বিশ্বের আরও কিছু দেশে করোনার প্রকোপ তীব্রতর হলেও উন্নত দেশের পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক দেশ সম্পূর্ণ টিকাকরণের শেষ পর্যায়ে।
কোথাও কোথাও মৃত্যু ও আক্রান্তের হার দ্রুত কমছে, যার ইতিবাচক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে দেশগুলোতে।
বৃটেনে গৃহীত ‘স্বাধীনতার রোডম্যাপ’ পরিকল্পনামাফিক একটু একটু করে নিয়ম শিথিল করা হচ্ছে। ২১ জুন সম্পূর্ণ ভাবে লকডাউন তুলে দেওয়া সিদ্ধান্ত থাকলেও ডেল্টা স্ট্রেনের বাড়বাড়ন্তে তা এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে পরিস্থিতিও আগের মতো ভয়াবহ নয়।
বাকি ইউরোপেও করোনা মুক্তির পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ফ্রান্সে সংক্রমণ হ্রাস পাওয়ায় রাতের কার্ফু তুলে দেওয়া হয়েছে। কাফে, রেস্তরাঁর ভিতরে বসে খাওয়া যাচ্ছে। তবে সংখ্যাটা স্বাভাবিক সময়ের অর্ধেক করা হয়েছে। অতিপ্রয়োজনীয় নয়, এমন দোকানও খুলেছে। এমনকি জিম, সিনেমা হলও জনগণের জন্য উন্মুক্ত। তবে সতর্কতার কারণে মাস্ক পরিধান করা ৩০ জুন পর্যন্ত বাধ্যতামূলক রয়েছে। মৃত্যু ও আক্রান্ত কমায় 'সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার দেশে' মানুষ মুখিয়ে আছে মুক্ত জীবনের জন্য।করোনা-বিধির প্রতিবাদে প্যারিসে স্ট্রিট পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। আমেরিকান ফিল্মের নামে প্রতিবাদের নামকরণ করা হয়েছে ‘প্রোজেক্ট এক্স’। কয়েকশো মাস্কহীন লোক সেখানে জড়ো হন। তাঁরা পুলিশের ভ্যান লক্ষ্য করে ভাঙা বোতল ছোড়েন। গাড়ি ভাঙচুর করেন। শেষে পরিস্থিতি সামলাতে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে হয়েছে পুলিশকে। লুভর মিউজ়িয়ামের কাছে সেন নদীর তীরে অন্য একটি জমায়েত হয়েছিল। সেটি অবশ্য কোনও প্রতিবাদ নয়। শহরের পাবগুলোও খুলে দেওয়া হয়েছে। অল্পবয়সিদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। কোথাও কোথাও চলছে ফরাসি দেশের বিখ্যাত মধ্যরাতের পার্টি।
করোনার বিরুদ্ধে জার্মানি আরও এগিয়ে গেছে। বার্লিনের মতো বৃহত্তম শহরাঞ্চলেও মাস্ক পরতে হচ্ছে না কাউকে। ১৬টি প্রদেশের প্রতিটিতে আঞ্চলিক প্রশাসন নিজেদের মতো হাল্কা নিয়ম জারি করেছে। যাঁদের টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে কোনও কড়াকড়িই নেই।সামাজিক জমায়েতের ক্ষেত্রে তিনটি পরিবারের সর্বোচ্চ ছ’জন এক জায়গায় জড়ো হতে পারছেন।
প্রবলভাবে করোনা কবলিত ইটালি, স্পেনও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টায়। করোনার আগ্রাসন দ্রুত নিম্নগামী সেসব দেশে। তবে এখনও অহেতুক ভিড় করতে দেওয়া হচ্ছে না কোথাও। মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি পালন অব্যাহত রয়েছে।
ইউরোপের স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশাসনিক কর্তারা বলেছেন, ‘‘জানি দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকা মানুষের জন্য কষ্টকর। কিন্তু ভাইরাস কমলেও পুরোপুরিভাবে এখনও চলে যায়নি।’’ একই সুর শোনা গিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ শাখার প্রধান মাইক রায়ানের মুখে। তাঁর কথায়, ‘‘যে ভাবে ফিল্ম ফেস্টিভাল, স্পোর্টস টুর্নামেন্ট চলছে, মহাদেশের এক প্রান্ত থেকে লোক অন্য প্রান্তে যাচ্ছেন, তাতে বিপদ আসন্ন।’’
উল্লেখ্য, এরই মধ্যে ফরাসি ওপেনের শেষ হয়েছে। সামনের মাসেই উইম্বলডন। ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ চলছে। এই সবই যে ভয়ের কারণ হওয়ার যথেষ্ট, তা মনে করিয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যমান পরিস্থিতি এখনও সম্পূর্ণভাবে বিপদমুক্ত না হলেও ইউরোপ করোনার মূল আঘাত সামলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে। নাগরিকদের বৃহত্তম অংশের টিকাকরণ সম্পন্ন হওয়ায় মৃত্যু ও আক্রান্তের হার যেমন কমেছে, তেমনই বেড়েছে নাগরিকদের আত্মবিশ্বাস ও সাহস। যেসব দেশ টিকাকরণে এগিয়ে, সেখানে বইছে সুবাতাস। ইসরায়েল এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। আমেরিকা ও ইউরোপের বহু ধনী দেশ দ্রুতবেগে সকল নাগরিককে ভ্যাকসিন নিরাপত্তার আওতায় আনার জন্য টিকাকরণ চালাচ্ছে।
এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার অনুন্নত দেশগুলো এক্ষেত্রে রয়েছে অনেক পিছিয়ে। কোথাও কোথাও ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিয়ে চলছে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি। 'ভ্যাকসিক ডিপ্লোমেসি'কে হাতিয়া করে অনেক দেশের উপর প্রভাব বিস্তারের কৌশল নিচ্ছে ক্ষমতাশালী দেশগুলো। 'ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ'র উগ্র প্রয়োগ দেখা গেছে উন্নত দেশগুলোর নিজেদের জন্য অগ্রাধিকার প্রচেষ্টায়।
ফলে বিশ্বের একদিকে যেমন চলছে মসৃণ টিকাকরণ, অন্যদিকে চলছে টিকার জন্য হাহাকার। মওকা বুঝে সুচতুর করোনাও উন্নত দেশে টিকতে না পেরে গতি বদলে হামলা চালাচ্ছে অনুন্নত, দরিদ্র দেশগুলোতে।