যে কোন সংকটের সময়ে সমাজের সবাই একত্রিত হয় এবং সেসময় দাতব্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে দেখা যাচ্ছে, দানের নামে ‘তহবিল সংগ্রহ’ এখন দূর্নীতির একটি নতুন অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। অনলাইনে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কল্যাণে অনেক বেশি সম্ভাব্য দাতাদের কাছে যাওয়া যায়। তবে এ সমস্ত কার্যক্রমে খুব বেশি স্বচ্ছতা থাকে না। অভিযোগ রয়েছে, এই অর্থ বিভিন্ন সন্ত্রাসীদলগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগসূত্র থাকা গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরবরাহ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইনি প্রতিষ্ঠান ডিজইনফোল্যাবের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়েছে, ভারতে দ্বিতীয় দফায় করোনার ঢেউয়ের সময়ে দেশটিকে সহায়তার জন্য সারাবিশ্বে তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। এসময় তহবিল সংগ্রহের অনেকগুলো উদ্যোগ গ্রহন করা হয়; যার কিছু আসল আর কিছু নকল।
এরমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান ভারতের অথবা এসব প্রতিষ্ঠানের ভারতে বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। এছাড়া কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে যাদের ভারতে কার্যক্রম, শাখা এক কথায় বলতে গেলে কোন অস্তিত্ব নেই। এ অবস্থায় তারা তাদের দাতব্য কার্যক্রম কিভাবে পরিচালনা করবে তা জানা রীতিমতো আগ্রহের বিষয়।
গত ২৬শে এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একটি অনুরোধ এ ধরনের দাতব্য কাজকে আরো এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। প্রেসিডেন্ট সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সংকটে ভারত সহায়তা করেছে এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য করার পালা।
তার এ বক্তব্যের পর অনেক দাতব্য সংস্থাই তহবিল সংগ্রহের কাজে নেমে পড়ে, এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেকগুলোই ছিলো পাকিস্তান থেকে পরিচালিত ইসলামিক অর্গানাইজেশন। #স্ট্যান্ডইন্ডিয়া স্লোগান নিয়ে তারা এই তহবিল সংগ্রহের কাজে নেমে পড়ে এবং অনেক কৌশলগত সেলিব্রেটিদের মন জয় করে নেয় তারা।
এই সংগঠনগুলোর মধ্যে ইমানা নামের একটি প্রতিষ্ঠান তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে খুবই আগ্রাসী ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে দাতব্য কার্যক্রমের প্রচারণা চালিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির তহবিল সংগ্রহ কার্যক্রমে এতোটাই অগ্রগতি ছিলো যে, অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বারবার পরিবর্তন করা হয়। তবে এ বিষয়ক তথ্য প্রদানে কোম্পানিটি মোটেও স্বচছ ছিলো না। সবচেয়ে বাজে বিষয় হলো, তাদের কাজ ও তহবিলায়ন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করলেই তা ‘ইসলামফোবিয়ার’ কাতারে ফেলে দেয়া হয়।
বিষয় হচ্ছে- একটি বা দুটি নয়, কোভিডে ভারতকে সহায়তার জন্য শত শত তহবিল কার্যক্রম চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট তহবিল সংগ্রাহক প্লাটফর্মগুলো এই তহবিল সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত হয়। আর এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্লাটফর্মগুলোর মধ্যে ইনস্টাগ্রাম সবচেয়ে অস্বচছ।
ইমানার পরিচয়:
ইসলামিক মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা (ইমানা) ইলনয়েসভিত্তিক চিকিৎসা সহায়তা প্রতিষ্ঠান; যা ১৯৬৭ সালে ইসলামিক মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ) নামে যাত্রা শুরু করেছিলো। পরবর্তীতে এটি আইএমএনএ অথবা ইমানা নামে পরিচিত হয়। ইসলামিক অর্গানাইজেশন ইসলামিক সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকার (আইএসএনএ) কোর কিছু সদস্যদের নিয়ে সংস্থাটি গঠন করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কার্যক্রম পরিচালনার দাবি করে আসছে ইমানা। তবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো কোভিড সংকটের সময় দাতব্য কার্যক্রম নিয়ে স্বচ্ছতার পরিচয় দেয়নি ইমানা। এছাড়া সংগৃহীত কোটি কোটি ডলার কিভাবে ব্যয় করা হলো সে বিষয়েও তারা বিশদ কোন ব্যখ্যা দেয়নি।
প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান চেয়ারম্যান ড. ইসমাইল মেহেরের নেতৃত্বে ‘হেল্প ইন্ডিয়া ব্রিথ’ প্রকল্পটি পরিচালিত হয়। তিনি একজন পাকিস্তান বংশোদ্ভূত চিকিৎসক এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। তিনি মেডিসিনের (অ্যানেসথেসিয়া) ওপর ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেছেন, অবশ্য তার সঠিক শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কিছু বিভ্রান্তিও রয়েছে।
ইমানার দূর্নীতি
চলতি বছরের ২৭শে এপ্রিল থেকে ইনস্টাগ্রামে #হেল্পইন্ডিয়াব্রিথ নামে তহবিল সংগ্রহের প্রচারণা কার্যক্রম শুরু করে ইমানা। প্রাথমিকভাবে ১ দশমিক ৮ কোটি রূপি অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে এই লক্ষ্যমাত্রা কয়েক দফায় পরিবর্তিত হয়। শুধুমাত্র ইনস্টাগ্রামের প্রচারণার মাধ্যমে ইমানা ৮ দশমিক ৭৭ কোটি রূপি সংগ্রহ করে। এছাড়া জাস্ট গিভিং প্লাটফর্ম থেকে সংগৃহীত হয় আরো ২ কোটি রূপি। ইমানার চেয়ারম্যানের দেয়া তথ্যানুযায়ী, ৪ দশমিক ১২ মিলিয়ন থেকে ২১ মিলিয়ন ডলার (৩০ কোটি থেকে ১৫৮ কোটি রূপি) সংগ্রহ করা হয়েছে।
তবে খুব গভীরে যেতে হবে না হালকাভাবে দেখলেও বোঝা যায়, ইমানা কারসাজির বিষয়ে বেশ সিদ্ধহস্ত। তারা যখন ভারতে সহায়তা চাইতো তখন সেদেশটির নাগরিকদের খুশি করার জন্য মানচিত্র ব্যবহার করতো, অন্যদিকে তাদের ওয়েবসাইটে পাকিস্তান সরকারের অনুমোদিত একটি মানচিত্র রয়েছে। ইমানা নিরপেক্ষ হলে তারা অন্তত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং জাতিসংঘের মানচিত্র ব্যবহার করতে পারতো।
ইমানা যে অর্থ সংগ্রহ করেছে তা কিন্তু তাদের ব্রান্ডিংয়ের কারণে আসেনি। বরং এখানে ভারত ও ভারতীয় নাগরিকদের সুনামকে ব্যবহার করা হয়েছে। খুব চতুরতার সঙ্গে এই তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হেল্প ইন্ডিয়া প্রচারণা চালু করার একদিন পরই তারা এই তহবিল সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করে। গত বছর কোভিড সংকটের সময় ভারত যেসব দেশে ভ্যাকসিন ও মেডিকেল সহায়তা পাঠিয়েছে সেসব দেশকে লক্ষ্য করেই প্রচারণা চালায় ইমানা। যারা দান করেছে তারা মনে করেছে এই অর্থ ভারতীয়দের সহায়তার জন্যই যাচ্ছে।
কিন্তু দেখা গেছে, বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে ইমানা তহবিলের অর্থ নানা জায়গায় পাঠায়; তবে এর মূল গন্তব্য হচ্ছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী, ইসলামিস্ট অথবা পাকিস্তান সেনাবাহিনী। গোটা তহবিলের অল্প কিছু জনমানুষের সহায়তার জন্য ব্যয় করা হয়েছে।