প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি বলেছেন, বর্তমান চেয়ারম্যান ও কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফিরেছে। লেনদেন এবং বাজার মূলধন বেড়েছে অনেকগুণ। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি বলছে, সারা বিশ্বের মধ্যে ‘বেস্ট পারফর্মিং’ শেয়ারবাজার বাংলাদেশে। গত এক বছর ধরে শেয়ারবাজারে নতুন ধরন দেখছি। নতুন কমিশন অনেকগুলো সুন্দর পদক্ষেপ নিয়েছে।
শনিবার অনুষ্ঠিত ‘বাজেট আলোচনা ও পুঁজিবাজার উন্নয়নে রোড ম্যাপ’- শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন (বিএমবিএ) যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সিএমজেএফ’র সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন- বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, বিএসইসি’র কমিশনার ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ, ডিএসই চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমান ও সিএসই চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন ও এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ এসোসিয়েশনের সভাপতি ড. হাসান ইমাম, বিএমবিএ’র সভাপতি মো. ছায়েদুর রহমান এবং সিএমজেএফ সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল।
বক্তারা বলেন, দেশের অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
আর সামগ্রিকভাবে বাজার উন্নয়নে কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। কিন্তু আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও এ খাতের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেই। এ কারণে শেয়ারবাজারে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাজেট চূড়ান্ত অনুমোদনের সময় বেশকিছু পদক্ষেপের সুপারিশ করেছে এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। এ সব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর আরও কমানো, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ, মার্চেন্ট ব্যাংকের কর হার কমানো, মৌলভিত্তি সম্পূর্ণ কোম্পানি তালিকাভুক্তি, বাজার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এবং নতুন নতুন পণ্য চালু।
সালমান এফ রহমান বলেন, গত এক বছরে শেয়ারবাজারে বর্তমান কমিশন অনেকগুলো সুন্দর পদক্ষেপ নিয়েছে। দীর্ঘদিনের সমস্যা ইক্যুইটিভিত্তিক মার্কেট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। বন্ড আসছে, সুকুক (ইসলামী বন্ড) অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া করপোরেট ও পারপিচুয়াল বন্ড আসছে। সবমিলিয়ে শেয়ারবাজারের ভবিষ্যতে আরও ভালো হবে বলে মনে করছি। তিনি বলেন, সম্প্রতি বিএসইসি ফ্লোরপ্রাইস (শেয়ার মূল্যে নিম্নসীমা) তুলে দিয়েছে। এটি ইতিবাচক। তিনি বলেন, পুঁজিবাজার যেভাবে আগাচ্ছে, তাতে বাজারের ভবিষ্যৎ ভালো। শেয়ারবাজার ভালো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্টেকহোল্ডারদের দায়িত্ব বাড়বে। এক্ষেত্রে দেশের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের ম্যানেজমেন্টের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এছাড়া বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর শেয়ারবাজার যেভাবে পরিচালিত হয় এবং সেখানে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে, সেগুলো আমাদেরকেও চালু করতে হবে। তিনি বলেন, আজকের আলোচনায় চূড়ান্ত বাজেটে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ব্যবধান বাড়ানো, লভ্যাংশে দ্বৈত করহার প্রত্যাহার, মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার কমানো, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগসহ যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে- সেগুলোর পেছনে যুক্তি আছে। বাজেট চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে কিছু পরিবর্তন আসবে।
চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রাখা উচিত। তিনি বলেন, এবারের বাজেট ‘মেড ইন বাংলাদেশ বাজেট’। এটি পুঁজিবাজারের জন্যেও ইতিবাচক। কমিশন ব্যবসাবান্ধব নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করছে। সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুঁজিবাজারের অবদান বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কমিশন।
ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, গত ২০ বছর ধরে একই রকম শেয়ারবাজার দেখে আসছি। সেখানে বিবর্তন দরকার। এজন্য নতুন প্রোডাক্ট আনা ও কৌশল নিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদেরকে ইক্যুইটি মার্কেটের বাহিরে গিয়ে বিবর্তন আনতে হবে। এ লক্ষ্যে কমিশন কাজ করছে। আমরা এখন মিউনিসিপ্যাল বন্ড নিয়ে কাজ করছি। এছাড়া সরকারি সিকিউরিটিজ আনার জন্য গভীরভাবে চেষ্টা করছি। আশা করছি দ্রুত এটা সম্ভব হবে। সামনে আরও পরিবর্তন আসবে।
বিএমবিএ সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানির পাশাপাশি অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার ২.৫০ শতাংশ কমানো হয়েছে। এর মাধ্যমে উভয় ক্ষেত্রের মধ্যে করহারের ব্যবধান ৭.৫০ শতাংশ। কিন্তু একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির বিভিন্ন নিয়ম কানুন মেনে চলার কারণে ব্যয় অনেক বেশি হয়। যে কারণে ভালো মুনাফা করা বৃহৎ কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হতে চাইবে না। এই সমস্যা কাটিয়ে তুলতে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ব্যবধান ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর করহার স্বাভাবিকবা ৩০ শতাংশ করার দাবি করেন তিনি।
ডিএসই’র চেয়ারম্যান ইউনুসূর রহমান বলেন, আগামী বছরেও চলতি বছরের ন্যয় অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ অব্যাহত রাখার দাবি জানাই।
সিএমজেএফ সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল বলেন, সারা পৃথিবীতে অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে পুঁজিবাজার। তাই আমাদের অর্থনীতিকে উন্নত করতে হলে শক্তিশালী পুঁজিবাজারের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত এবং অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারের ব্যবধান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সরকারি ঋণের বোঝা কমাতে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পকে বাজারে আনতে হবে। যেমন পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল এসব প্রকল্পের অর্থায়ন পুঁজিবাজার থেকে করতে হবে। এতে আগামী বাজেটে যে দুই লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রাখা হয়েছে। সে ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ হবে। অন্যথায় ঘাটতি বাজেট মেটাতে ঋণের বোঝা আরও বাড়বে।
সিএসই’র চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণের দাবি জানান। এতে তালিকাভুক্ত ও তালিকার বাইরে থাকা কোম্পানির মধ্যে করের ব্যবধান বাড়বে। ভালো কোম্পানিগুলো কর সুবিধা পাওয়ার জন্য পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে।
শরীফ আনোয়ার হোসেন বলেন, ব্রোকার হাউজের লেনদেনে বিদ্যমান অগ্রিম আয় কর নেয়া যৌক্তিক নয়। উৎসে করের হার ০.০৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.০১৫ শতাংশ নির্ধারণ করার দাবি জানান তিনি।
এএমসি এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হাসান ইমাম বলেন, ক্যাপিটাল মার্কেটের দিকে আগে নজর দিতে হবে। মিউচুয়াল ফান্ড এবং অন্যান্য বিনিয়োগকে কাজে লাগানোর জন্য সমগোত্রীয় নতুন ফান্ড বাজারে আনতে হবে। আর এসব ফান্ডে প্রথম ৫ বছর করমুক্ত রাখতে হবে।