ব্যয় কমাতে ২০২৫ সালের আগে নতুন করে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি না করার সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। পাশাপাশি নতুন করে কুইক রেন্টালের মেয়াদ না বাড়ানো, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ আইনের মেয়াদ না বাড়ানোর সুপারিশ করেছে সিপিডি।
গতকাল প্রস্তাবিত বাজেটে ‘বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ ও সংস্কার’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন কালে এসব সুপারিশ করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালানা করেন সিপিডিরি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, দেশে যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এখন পরিমাণ না বাড়িয়ে বিদ্যুতের গুণগত মানের দিকে নজর দিতে হবে। এ জন্য বিদ্যুৎ খাতের দক্ষতা বাড়িয়ে সংস্কার করার এখনই সময় বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে, সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে হিসাব দেখাচ্ছে, তাতে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। বেশি উৎপাদনের তথ্য দেখাচ্ছে সরকার। এটি প্রকৃত চিত্র নয়।
আলোচানায় অন্য বক্তরা বলেন, চাহিদার তুলনায় এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন (জেনারেশন) বেশি হচ্ছে।
সুতরাং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বাজেটে বরাদ্দ আর বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। আমাদের এখন মনোযোগ দিতে হবে সঞ্চালন ও সরবরাহের (ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন) ওপর। এখানে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ভাড়ায় চালিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সময় আর না বাড়ানোর দাবি জানান তারা। একই সঙ্গে পরিবেশ দূষণ রোধ ও টেকসই পরিবেশ উন্নয়নে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে বেশি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন তারা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ খাতের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে রোডম্যাপ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং সঞ্চালন এবং সরবরাহ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন নিরুৎসাহিত করে ক্রমান্বয়ে সবুজ অর্থনীতির দিকে যাওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
স্বাগত বক্ত্যবে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিদ্যুতের দক্ষতা বাড়লে গ্রাহক সাশ্রয়ী দামে সেবা পাবেন। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে।
বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উদ্যোক্তা আসিফ আশরাফ বলেন, দেশে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ আছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই আমাদের এখন নতুন করে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের দরকার নেই। কিন্তু গুণগত মানের বিদ্যুৎ নেই। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক ঝুঁকির শঙ্কায় থাকে। সরকারকে এই বিষয়টা দেখতে হবে। তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমরা দেখছি বাজেটে অযৌক্তিকভাবে সোলার ও ইনভার্টারের ওপর ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। আবার এসব কেন্দ্র স্থাপনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানিতে উচ্চহারে কর রয়েছে। তা কমাতে হবে। যারা সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, তাদের কর প্রণোদনা দেয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
বুয়েটের পেট্রোলিয়াম ও মিনারেল রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম বলেন, সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসবে বলছে। কিন্তু কাগজে আমরা তার প্রতিফলন দেখছি না। তিনি দাবি করেন, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের হিসাব আসলে ‘কাগজে-কলমে’। ৪ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে আছে। দেড় থেকে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এমন অনেক প্ল্যান্টের অবস্থা খুবই খারাপ। আসলে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ শুভঙ্করের ফাঁকি ছাড়া কিছু নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের হিসাব ‘অতিরঞ্জিত’ বলে দাবি করেন তিনি।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস খুঁজতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। দেশের ৯টি জায়গায় সোলার মেজারিং সেন্টার করা হয়েছে। উইন্ড পাওয়ারের সমীক্ষা চালানো হয়েছে। ডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া নতুন জ্বালানি খোঁজার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
সরকারি সংস্থা ইডকলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মামুন মালিক বলেন, আমাদেরকে ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে জমি। ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারসের সভাপতি ইমরান করিম ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব করেন। একই সঙ্গে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করার পরামর্শ দেন তিনি।
বুয়েটের ড. ফারসিন মান্নান মোহম্মদী বলেন, আগে জাতীয় বাজেটে বিদ্যুতের ওপর আলাদা একটি রোডম্যাপ বা পথনকশা দেয়া হতো। এবারের বাজেটে তা দেয়া হয়নি। জ্বালানি খাতে কোনো পরিকল্পনা নেই। এর জন্য রোডম্যাপ দরকার। আনুপাতিক হারে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ছে এ খাতে। তবে মোট বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ কমে গেছে।
বেসরকারি উদ্যোক্তা ইমরান রশিদ বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে চুক্তিগুলো আরও স্বচ্ছ হওয়া দরকার। ‘একতরফা’ এসব চুক্তিতে দরকষাকষির সুযোগ নেই। এ খাতে জমি একটি বড় সমস্যা। যথাসময়ে পেমেন্ট না পাওয়াও বড় সমস্যা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির টাকা (এডিপি) ঠিকমতো খরচ হয় না। বিদ্যুৎ খাতে অদক্ষতার পেছনে এসব বিষয় কাজ করে। এ জন্য এ খাতে সংস্কার করার এখনই সময়।
আরেক বেসরকারি উদ্যোক্তা ডি এম মুজিবর রহমান বলেন, ‘এখন আমাদের ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। ব্যবহার হচ্ছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। বাকিটা উদ্বৃত্ত। ২০৩০ সালের মধ্যে ৫৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, এত বিদ্যুৎ দিয়ে আমরা কী করব?’ ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থায় বিশাল অপচয় আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এবং পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
সরকারি সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। তবে কীভাবে খরচ কমানো যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের দক্ষতা ও গুণগত মান নিয়ে ও পরিকল্পনা করা হচ্ছে। নতুন কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা এ মুহূর্তে সরকারের নেই বলে জানান তিনি। বাজেটে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন বরাদ্দ বেশি নয় বলে দাবি করেন তিনি। বরং দুই-তৃতীয়াংশ বরাদ্দ দেয়া হয় ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশনে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আর অব্যাহত রাখা হবে না বলে জানান তিনি। মোহাম্মদ হোসেন আরও বলেন, গত কয়েক বছরে আমরা বাজেটে ডিস্ট্রিবিউশন এবং ট্রান্সমিশনে বরাদ্দ বেশি রাখার বিষয়ে নজর দিয়েছি এবং ভবিষ্যতে তা অব্যাহত থাকবে। এখন বিদ্যুৎ খাতে বেশির ভাগ প্রকল্প এ সংক্রান্ত।
সিপিডিরি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিদ্যুতের গুণগত বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এর উৎপাদন খরচ বাড়বে। পরিবেশ দূষণ রোধে আমাদেরকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সবুজায়নের দিকে যেতে হবে। এ জন্য এসব খাতে বাজেট বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে।
মূল প্রবন্ধে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমাদের ডিস্ট্রিবিউশন ও ট্রান্সমিশন লাইন বাড়ছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ সুফল পেতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উঠিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও তা রয়ে গেছে এখনও। কুইক রেন্টালগুলোর নতুন করে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই। আমরা দেখেছি ২০২০ সালে কুইক রেন্টালের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এ খাতে সরকারের খরচ অব্যাহত আছে। এছাড়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন থেকে সরে আসার ঘোষণা থাকলেও তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে আগের বছরের তুলনায় আনুপাতিক হারে বরাদ্দ বাড়লেও মোট বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে অংশ কমে গেছে। বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে ডিস্ট্রিবিউশন এবং ট্রান্সমিশনে। গ্রিন এনার্জি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, উৎপাদন বাড়ছে। এটা ইতিবাচক। তবে লোডশেডিং এখনও হচ্ছে। তার মানে দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সঞ্চালন ব্যবস্থায় সংকট আছে। বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমছে, আরও কমানোর সুযোগ আছে, যদি দক্ষতা বাড়ানো যায়। তিনি বলেন, তারপরও চড়া দামে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা এবং অলস কেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধের কারণে বছরে বিপুল টাকা লোকসান করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বরাদ্দের সঙ্গতি নেই।