× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

কদমতলীতে ৩ খুন / মুনের বেপরোয়া জীবন

প্রথম পাতা

শুভ্র দেব ও ফাহিমা আক্তার সুমি
২১ জুন ২০২১, সোমবার

ছোটবেলা থেকেই বেপরোয়া ছিলেন মেহজাবিন ইসলাম মুন। বাবা মাসুদ রানা বিদেশে থাকায় তাকে শাসন করার মতো কেউ ছিল না। খারাপ বন্ধুদের সঙ্গ অল্প বয়সেই মুনকে ভিন্ন পথে নিয়ে যায়। সুযোগ পেয়ে মুন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। যখন যা মনে হয়েছে তাই করেছেন। দিন রাতের বেশির ভাগ সময় মুনের কাটতো বন্ধুদের সঙ্গে। মাদক সেবন, নাইট পার্টি, একাধিক পুরুষের শয্যাসঙ্গী হওয়া ছিল স্বাভাবিক বিষয়। গভীর রাতে বাড়ি ফেরা এটি ছিল তার নিত্য দিনের স্বভাব।
বন্ধুদের সঙ্গে মিশে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। একসময় মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। মেয়ের অন্ধকার জগতে বেপরোয়া হয়ে ওঠা দেখে খোদ তার মা-বাবাও অবাক হয়ে যান। অনেক চেষ্টা করেও তাকে স্বাভাবিক পথে আনতে ব্যর্থ হন। মুনের এই বেপরোয়া জীবনে অতিষ্ঠ ছিল সবাই। আর এটিই পরিবারের জন্য কাল হয়ে ওঠে। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষোভের কারণে নিজের মা-বাবা ও ছোট বোনকে বিষাক্ত দ্রব্য খাইয়ে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। পরে নিজেই পুলিশের জরুরি সেবা-৯৯৯ এ ফোন করে হত্যার কথা জানান। পরে পুলিশ এসে তাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পুলিশের কাছে মুন অকপটে মা, বাবা ও বোনকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন।
পুুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও নিহতদের স্বজনসূত্রে জানা গেছে, শফিকুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ের আগে মুন কেরানীগঞ্জের একজনকে বিয়ে করেছিলেন। মুনের  বেপরোয়া জীবনযাপনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি ওই স্বামী। তাই তাদের মধ্যে নিয়মিতই ঝগড়া লেগে থাকতো। বেপরোয়া জীবন থেকে বের হয়ে আসার জন্য তাগাদা দিলেই স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হতো মুনের। একসময় ক্ষোভের মুখে ওই স্বামীকে খুন করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। স্বামীকে হত্যার দায়ে ৫ বছর জেলও খেটেছিলেন। সূত্রগুলো জানিয়েছে, একাধিক পুরুষের সঙ্গে মুনের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। টাকার বিনিময়ে একাধিক পুরুষের শয্যাসঙ্গী হয়েছেন।
শফিকুলের সঙ্গে বিয়ের পর মুন আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে বাবা-মায়ের সম্পদের প্রতি তার চোখ পড়ে। প্রায়ই সে তার বাবা-মাকে সম্পত্তি লিখে দেয়ার জন্য চাপ দিতেন। যখন তখন টাকা-পয়সা চাইতেন। কিন্তু তার মা মৌসুমি ইসলাম তার এসব প্রস্তাবে আপত্তি করতেন। এজন্য মায়ের সঙ্গে তার বিরোধ ছিল। সম্পত্তি লিখে দেয়ার পেছনে তার স্বামীর ইন্ধন ছিল বলে স্বজনরা মনে করছেন। এজন্য মামলায় তার স্বামীকেও আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি মুনের সন্দেহ হয় তার ছোট বোন জান্নাতুলের সঙ্গে তার স্বামী শফিকুলের পরকীয়ার সম্পর্ক আছে। এ নিয়ে বাবা ও মায়ের কাছে একাধিকবার অভিযোগ করেছেন। কিন্তু মা-বাবা মুনের এই অভিযোগকে প্রশ্রয় দেননি। এতে করে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথাকাটাকাটিও করেন মুন। সবমিলিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মনে জমে থাকা ক্ষোভ থেকেই বাবা-মা ও বোনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তার ধারণা ছিল সবাইকে হত্যা করলে সম্পত্তি দাবি করার আর কেউ থাকবে না। আর বিষাক্ত কিছু খাইয়ে হত্যা করলে সবাই ভাববে তারা একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছেন।
নিহত মাসুদ রানার পরিবারের অন্য সদস্যরা গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে দাবি করে বলেন, মুনের একার পক্ষে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব নয়। সঙ্গে তার স্বামী শফিকুলও জড়িত। মুনের খালা শিউলি আক্তার জানান, মুনের একার পক্ষে এই খুন করা সম্ভব না। তার সঙ্গে তার স্বামী শফিকুলও জড়িত ছিল। হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আগে থেকে তাদের পরিকল্পনায় ছিল এবং সেটি তার স্বামীর প্ল্যান অনুযায়ী। মুন তাকে সহযোগিতা করেছে। একই অপরাধে দু’জনই অপরাধী। তাদের মেরে ফেলতে পারলে সব সম্পত্তির মালিক হবে তারা। এই লোভে তাদের হত্যা করা হয়েছে। আর মেহজাবিনকে সে সম্পত্তির লোভে ব্যবহার করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার চান তিনি।
তিনি আরও জানান, মুনের সঙ্গে প্রথমে তার স্বামী শফিকুলের একটি বিকাশের দোকান থেকে সম্পর্ক হয়। পাঁচ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর যখন তাদের বাসায় আসা যাওয়া করতো তখন তার ছোট বোন জান্নাতুলের সঙ্গে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। যখন পরিবারের লোক বুঝতে পারে তখন জান্নাতুলকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। এটা নিয়ে ওদের পরিবারে সবসময় কথাকাটাকাটি হতো। এই ব্যাপারটি নিয়ে বোনের সঙ্গে মনোমালিন্য ছিল। এবং তাদের বাসায় আসা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তার বাবা রোজার মধ্যে বিদেশ থেকে দেশে আসলে তার স্বামীকে নিয়ে তারা বাবার বাড়িতে যায়। পরিবারের সঙ্গে পুনরায় আসা যাওয়া শুরু করে। আসা-যাওয়ার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা দু’জন এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে।  
এদিকে মা, বাবা ও বোনকে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় মেহজাবিন ইসলাম মুনের চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল মুনকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে সাতদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কদমতলী থানার পরিদর্শক জাকির হোসেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস তার চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে কদমতলী থানায় মুন ও তার স্বামী শফিকুল ইসলামকে আসামি করে মামলা করেন মুনের চাচা সাখাওয়াত হোসেন। কদমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন মীর বলেছেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গত শনিবারই মেহজাবিন ইসলাম মুনকে আটক করে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তার স্বামী শফিকুল ইসলাম আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাকে পুলিশি পাহারায় রাখা হয়েছে। সুস্থ হলে তাকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে।
কদমতলী থানার এজাহারে মুনের চাচা সাখাওয়াত হোসেন উল্লেখ করেছেন, আমার ছোট ভাই মাসুদ রানা দীর্ঘ ২৬ বছর যাবৎ সৌদি আরবে থাকতেন। প্রায় মাঝে মধ্যে দেশে আসতেন। ছোট ভাইয়ের বড় মেয়ে মেহজাবিন ইসলাম মুনকে শফিকুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার পর থেকে আমার ভাইয়ের স্ত্রী মৌসুমীকে বিভিন্ন ভাবে জ্বালা-যন্ত্রণা ও টাকা-পয়সা দাবি এবং সম্পত্তি তাদের নিজেদের নামে লিখে দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতো। এতে আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী রাজি না হওয়ায় মুন ও তার স্বামী আমার ছোট ভাইয়ের বউ, ছোট ভাই ও তাদের মেয়েকে ৬ মাস ধরে হত্যার পরিকল্পনা করতো। আমার ছোট ভাই তিন মাস আগে সৌদি আরব হতে দেশে আসে এবং তাদের বর্তমান ঠিকানায় বসবাস করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় মুন ও তার স্বামী পূর্ব পরিকল্পিতভাবে শুক্রবার বিকালে ভাইয়ের বাসায় আসে। ছোট ভাইয়ের স্ত্রী সবকিছু ভুলে আসামিদ্বয়কে বাসায় থাকতে দেয়। পরে ওই রাতেই আমার ভাই তার স্ত্রী ও তাদের মেয়ে জান্নাতুল ইসলাম মোহনীকে বিভিন্ন সময়ে চা-কপি ও পানির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ায়। এতে সবাই অচেতন হয়ে গেলে তারা গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে একে একে সবার মৃত্যু নিশ্চিত করে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর