× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

দক্ষিণ এশিয়ায় ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসি- চীনের আধিপত্য, এগিয়েও পেছনে ভারত

অনলাইন

তারিক চয়ন
(২ বছর আগে) জুন ২১, ২০২১, সোমবার, ১১:৩২ অপরাহ্ন

প্রায় দুইশ’ কোটি জনসংখ্যার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি। ভারত এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন করোনা রুখতে ব্যাপকহারে টিকাদানের কোনো বিকল্প নেই। দক্ষিণ এশিয়ার অবশ্য একটা বাড়তি সুবিধা ছিল। কারণ ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদক। সে হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ বিশ্বের অনেক দেশে বিভিন্ন পরিমাণে ভ্যাকসিন রপ্তানির চুক্তিও করে ফেলেছিল ভারত। প্রথমে উপহার হিসেবে এবং পরে চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভ্যাকসিন রপ্তানি শুরু করেছিল ভারত। কিন্তু সেই ভারতই যখন নিজ ঘরে করোনার থাবায় জর্জরিত হয় তখন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় দেশটি।

গত শনিবার সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- সমালোচকরা নিজ দেশে ধীরগতিতে, ভুলভাবে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত করার জন্য ভারতকে দায়ী করছেন।
নেপাল ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো তাদের ভ্যাকসিন ঘাটতি পূরণের জন্য চীনের দিকে মুখ ঘুরাতে শুরু করেছে। ‘ভারত বলছে, ভ্যাকসিন রপ্তানি আবার শুরু করার বিষয়ে দেশটি আশাবাদী’ শীর্ষক এপি’র ওই প্রতিবেদনে ভারতের জাতীয় থিংক ট্যাংক ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া বা নীতি আয়োগ এর সদস্য, প্রখ্যাত চিকিৎসক-বিজ্ঞানী ডা. বিনোদ কুমার পালের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। ডা. বিনোদ জানান, জরুরিভিত্তিতে নিজ দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার পর এবং বিভিন্ন উৎস থেকে ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি করা শুরু করবে। রপ্তানির বিষয়টি এখনো বিবেচনায় রয়েছে, তবে কোনো দিনক্ষণ বলে দেয়া ঠিক হবে না। বছরের শুরুতে ভারত যথেষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিন রপ্তানি করেছিল এবং বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেয়া ও সম্মান জানানো উচিত বলেও তিনি মনে করেন।

ডা. বিনোদের কথাটি ফেলনা নয়। ১৯শে জানুয়ারি ভারত সরকার ঘোষণা করে- পরদিন থেকে ভুটান, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমার ও সিশেলসকে অনুদান সহায়তা হিসেবে ভ্যাকসিন প্রেরণ করা হবে এবং প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র দেখে শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও মরিশাসে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা শুরু হবে। ভারত নিজ দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই ‘নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি’র আওতায় বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে লাখ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাঠিয়ে দেয়।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদন করা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভর করেছিল বাংলাদেশ। ২১শে জানুয়ারি উপহার হিসেবে ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিয়েছিল ভারত। ওই ভ্যাকসিন দিয়েই গত ৭ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। কিন্তু তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বিক্রি করতে চুক্তিবদ্ধ হলেও সেরাম ৭০ লাখ ডোজ দেয়ার পর  ভারত থেকে আর কোনো টিকা আসেনি। এতে বাংলাদেশ চরম সংকটে পড়ে। নতুন রেজিস্ট্রেশন করা মানুষের পাশাপাশি, প্রথম ডোজ পাওয়া লাখ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ পাওয়া নিয়ে সৃষ্টি হয় অনিশ্চয়তা। একপর্যায়ে (২৬শে এপ্রিল) টিকার অভাবে প্রথম ডোজ টিকা প্রদান বন্ধ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় দৃশ্যপটে হাজির হয় চীন। ২৯শে এপ্রিল বাংলাদেশে চীনের সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়। ইতিমধ্যেই সিনোফার্মের ১১ লাখ ভ্যাকসিন বাংলাদেশ পেয়েছে (উপহার হিসেবে)। গত শনিবার দ্বিতীয় পর্যায়ের গণটিকাদান শুরু হয় চীনের ভ্যাকসিন দিয়েই। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ পেয়ে দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় থাকা প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে চীনের সিনোফার্ম বা ফাইজার বা দুটি-ই ক্ষেত্রবিশেষে দেয়া হবে বলে অনেকেই মনে করছেন।

বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি অনেকটা নেপালের ক্ষেত্রেও। নেপালি গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশকে যেদিন (২১শে জানুয়ারি) ২০ লাখ ভ্যাকসিন উপহার দিয়েছিল ভারত; সেদিনই নেপালকে ১০ লাখ, ভুটানকে দেড় লাখ ডোজ এবং মালদ্বীপকে ১ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন উপহার দিয়েছিল ভারত। ২১শে ফেব্রুয়ারি ভারত থেকে ক্রয় করা ১০ লাখ ভ্যাকসিন পেলেও বাকি ১২ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দিতে পারেনি ভারত। নেপালে যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তারা আর দ্বিতীয় ডোজ পাচ্ছেন না। ভারত থেকে প্রতিশ্রুতি অনুসারে ভ্যাকসিন পেতে দেরি হওয়ার কারণেই দেশটিতে এই সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, ভ্যাকসিনের জন্য নেপাল এখন পুরোপুরি ‘পুরনো বন্ধু’ চীনের দিকে ঝুঁকেছে। চীনও দু’হাত প্রসারিত করেছে। মার্চেই নেপালে এসে পৌঁছে চীনের ৮ লাখ ডোজ উপহারের ভ্যাকসিন।

এ মাসের শুরুতেই চীন থেকে প্রায় ১০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন অনুদান হিসেবে পেয়েছে নেপাল। কাঠমান্ডু পোস্টের খবর, চীন থেকে নেপাল এখন ৪০ লাখ সিনোফার্মের ভ্যাকসিন কিনছে। ভ্যাকসিনের মূল্য নিয়ে নেপালি গণমাধ্যমে খবর বের হওয়ায় কিছুটা গোলমাল বাধলেও ধারণা করা হচ্ছে শিগগিরই সেগুলো নেপালে পৌঁছবে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ চীনের সিনোফার্মের ভ্যাকসিনের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়ার আড়াই মাস আগেই তার অনুমোদন দিয়েছিল নেপাল।

বাংলাদেশ ও নেপালের মতো অবস্থা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও। জানুয়ারির ২৮ তারিখ ভারতের কাছ থেকে উপহার পাওয়া ৫ লাখ ভ্যাকসিন দিয়ে দেশটি টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছিল। এরপর শ্রীলঙ্কা ভারত থেকে ১৫ লাখ ডোজ কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন পাওয়ার (ক্রয় করা) কথা থাকলেও পেয়েছিল মাত্র ৫ লাখ ডোজ। চীন থেকে মার্চ মাসে ৬ লাখ এবং মে মাসে ৫ লাখ ভ্যাকসিন উপহার পায় শ্রীলঙ্কা। সম্প্রতি চীন থেকে আরও ১ কোটি ৪০ লাখ ভ্যাকসিন কিনবে বলে জানিয়েছে দেশটি।

এদিকে চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত পাকিস্তান ২রা ফেব্রুয়ারি চীনের দেয়া উপহারের ৫ লাখ সিনোফার্মের ভ্যাকসিন দিয়েই টিকাদান কর্মসূচি চালু করেছিল। সেদিন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য চীনকে ধন্যবাদ জানান। মার্চের মাঝামাঝি আরও ৫ লাখ ডোজ টিকা উপহার পায় পাকিস্তান। এপ্রিলের প্রথম দিন চীন থেকে আরও ১১ লাখ ডোজ উপহার পায় পাকিস্তান। এপ্রিলের শেষের দিকে ৫ লাখ সিনোফার্মের ভ্যাকসিন আসে চীন থেকে। মে’র মাঝামাঝি সময়ে আসে আরও ১০ লাখ ডোজ। খালিজ টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান চীন থেকে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন পেয়েছে তার ৯ শতাংশই উপহার হিসেবে পাওয়া। এ ছাড়া পাকিস্তান নিজ দেশে মে মাস থেকে চীনের (এক ডোজের ভ্যাকসিন) ‘ক্যানসিনো’ উৎপাদন করছে বলেও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল। ভ্যাকসিন ঘাটতির কারণে পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে রোববার টিকাদান প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়। আর রোববারই  পাকিস্তানে চীন থেকে সিনোভ্যাকের ১৫ লাখ ৫০ হাজার ভ্যাকসিন এসে পৌঁছে। দেশটির ন্যাশনাল কমান্ড অ্যান্ড অপারেশন সেন্টার (এনসিওসি) এ খবর নিশ্চিত করে জানিয়েছে আগামী সপ্তাহে সিনোভ্যাকের আরও ২০ বা ৩০ লাখ ডোজের চালান আসবে। চীনকে ‘সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু’ উল্লেখ করে এনসিওসি বলেছে, পাকিস্তানে নিরবচ্ছিন্ন ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে চীন। জানা গেছে, এ বছরের মধ্যেই চীনের সিনোফার্মের ৩ কোটি, সিনোভ্যাক ও ক্যানসিনো ভ্যাকসিনের ২ কোটি ডোজ আনার পরিকল্পনা নিয়েছে পাকিস্তান সরকার।

করোনার উৎপত্তিস্থল হিসেবে পরিচিত চীন শুরুতে করোনায় জর্জরিত দেশগুলোর তালিকায় একেবারে প্রথম সারিতে থাকলেও সে ধাক্কা অনেকটাই সামলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন নিয়ে হাজির। অন্যদিকে ভ্যাকসিন যুগের শুরুতেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভ্যাকসিন নিয়ে হাজির ভারত এখন নিজেই করোনায় জর্জরিত। দেশটির প্রায় ৩ কোটি মানুষ করোনাক্রান্ত এবং মারা গেছেন প্রায় ৪ লাখ মানুষ। গণমাধ্যম বলছে, প্রকৃত সংখ্যা সরকারি ঘোষণার চেয়ে আরও অনেক বেশি। দেশটির মোট জনসংখ্যার শতকরা পাঁচ ভাগেরও কম মানুষ এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনের সম্পূর্ণ ডোজ পেয়েছেন। এমতাবস্থায় ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাদের ভ্যাকসিন ঘাটতি পূরণের জন্য চীনের দিকেই যে ছুটবে তা বলাবাহুল্য।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর