প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, করোনার অতিমারির প্রতিকূল প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত বছর ইতিবাচক জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ যে মন্দার কবলে পড়েনি। দেশের অর্থনীতি ভালো করেছে। এতে অর্থনীতির সক্ষমতা বেড়েছে, তা প্রকাশ পেয়েছে।
বুধবার ‘টেকসই বেসরকারি খাত’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) অনলাইনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইএফসি’র আঞ্চলিক অর্থনীতিবিদ জুলিয়া মিরুনোভা।
সালমান এফ রহমান বলেন, করোনার প্রতিকূল প্রভাবের মধ্যেও সমস্ত চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় রেখে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। তিনি বলেন, সিপিএসডি রিপোর্টের বিভিন্ন সুপারিশ ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পথে যেতে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বেসরকারি খাতের অর্থায়ন সুযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের উৎস হিসেবে শক্তিশালী ঋণনির্ভর বা বন্ডবাজার তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ইক্যুইটিভিত্তিক বা কোম্পানিনির্ভর বাজার। কিন্তু অর্থায়নের উৎস হিসেবে পুঁজিবাজার ব্যবহৃত হয় না।
বন্ডের মাধ্যমে কীভাবে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা যায়, তা নিয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করছে।
বাংলাদেশের ওপর আইএফসি’র রিপোর্ট: আইএফসি ও বিশ্বব্যাংক প্রণীত বাংলাদেশ কান্ট্রি প্রাইভেট সেক্টর ডায়াগনস্টিক (সিপিএসডি) নামের এ রিপোর্টে বলা হয়েছে, সামপ্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশ অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন সাফল্যের উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরবর্তী দশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণে বাংলাদেশের এখন গতি পরিবর্তনের সময়। আর এ জন্য একটি আধুনিক, বৈচিত্র্যধর্মী ও প্রাণবন্ত বেসরকারি খাত গড়ে তুলতে বিভিন্ন আইন-কানুন ও নীতির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৪০ লাখের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী তৈরি পোশাক খাতের সাফল্য এবং সরকারের দূরদর্শী নীতির সহায়তায় রেমিট্যান্সের তেজি প্রবাহ বাংলাদেশের দৃঢ় ও প্রাণবন্ত প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে, এমনকি অতিমারির সময়েও।
রিপোর্টে আরও বলা হয়, সংস্কার এজেন্ডার প্রধান অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়ক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি, আর্থিক খাতের আধুনিকায়ন ও সমপ্রসারণ এবং অবকাঠামো উন্নয়নের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা অপসারণ। বেসরকারি খাতে উজ্জ্বলতম বিনিয়োগ সম্ভাবনার খাতের মধ্যে রয়েছে পরিবহন ও লজিস্টিকস, জ্বালানি, আর্থিক সেবা, হালকা প্রকৌশল, কৃষি বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং ওষুধ, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
সিপিএসডি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ৪ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যা থেকে বের হওয়া বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নশীল বিশ্বে ৯০ শতাংশ কর্মসংস্থান বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। ফলে একটি বিস্তৃত বেসরকারি খাত গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আইএফসি’র এশিয়া ও প্যাসিফিক ভাইস প্রেসিডেন্ট আলফনসো গার্সিয়া মোরা বলেন, অতিমারি বাংলাদেশের ওপর কঠিন আঘাত হেনেছে এবং দেশটি করোনা থেকে উত্তরণের পর্যায়ে থাকায় সংস্কারের প্রয়োজনীতা আরও দৃঢ়ভাবে দেখা দিয়েছে। মজবুত আর্থিক খাতের সহায়তায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ৭০ শতাংশের বেশি বেসরকারি খাতের এবং এখন অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করতে এ খাতের জোরালো ভূমিকা রাখার দরকার, যাতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি বাড়ানোর পাশাপাশি গুণগত মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশ ও ভুটানে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন বলেন, রপ্তানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে থাকা তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। আরও প্রাণবন্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে।
বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালে নিযুক্ত আইএফসি’র কান্ট্রি ম্যানেজার ওয়েন্ডি ওয়ার্নার বলেন, এটা সুস্পষ্ট যে, গুণগত স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণে এবং স্বাস্থ্য পরিসেবার দক্ষতা বাড়াতে বেসরকারি খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কেননা, একই পর্যায়ের উন্নয়নে থাকা অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন নিম্ন মাত্রার। তিনি বলেন, এর বাইরে বাংলাদেশ উচ্চমূল্যের তৈরি পোশাকের বাজারে মনোযোগ দিতে পারে ও নতুন প্রযুক্তির প্রবর্তন করতে পারে এবং পাদুকা, চামড়া, ইলেকট্রিক সামগ্রী এবং কৃষিবাণিজ্য রপ্তানির সুযোগ কাজে লাগাতে পারে।
আরেক পর্বে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া, প্রাণ গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী এবং প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারস বাংলাদেশের ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশিদ। এ পর্ব সঞ্চালনা করেন আইএফসি বাংলাদেশের সিনিয়র কান্ট্রি অফিসার নুজহাত আনোয়ার। রিপোর্ট প্রকাশ অনুষ্ঠান শেষে আলাদা পর্বে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন আইএফসি’র কান্ট্রি ম্যানেজার ওয়েন্ডি ওয়ার্নার। মিডিয়া ব্রিফিং সঞ্চালনা করেন আইএফসি বাংলাদেশের যোগাযোগ কর্মকর্তা আহসান জেড. খান।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশি-বিদেশি সূত্র থেকে অর্থায়নের সুযোগ বাড়ছে। এ দেশের করপোরেট সংস্কৃতি শক্তিশালী হচ্ছে, সেই বার্তাই প্রদান করছে। তিনি বলেন, অর্থায়নের খরচ কমলে (সুদ কম হলে) চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবো। তিনি আরও জানান, একটি কোম্পানির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থায়ন। প্রতিষ্ঠানটি কতো সহজে ঋণ পাচ্ছে, আর ঋণের বিপরীতে খরচ কতো।
করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নের জন্য কি দরকার, এমন প্রসঙ্গে পিডব্লিউসি বাংলাদেশের ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশীদ বলেন, বেসরকারি খাতের দক্ষতা বাড়াতে হবে। কারণ এতে ঋণ নেয়ার সক্ষমতা বাড়বে। প্রতিষ্ঠানের ব্যালেন্স শিট শক্তিশালী হবে। ব্যালেন্স শিটের ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছতা থাকতে হবে। সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে মামুন রশীদ বলেন, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ও করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কর খাতে সংস্কার লাগবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া জানান, বাণিজ্য সমপ্রসারণে ইতিমধ্যে ৬টি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিগুলো বিনিয়োগ, অগ্রাধিকার বাজার সন্ধান, মেধাস্বত্ব আইন, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে মসৃণ যাত্রা, এসব বিষয়ে কাজ করছে। মধ্যমেয়াদি উন্নয়নে বেসরকারি খাতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই বেসরকারি খাতের বিকাশের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে জুলিয়া মিরুনোভা বলেন, বেসরকারি খাতের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ জন্য বন্ডবাজার উন্নয়নে সংস্কার প্রয়োজন। এ ছাড়া তিনি আর্থিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংক খাতে করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন।