শুক্রবার ১৭ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৫৪ব্যারিস্টার খোকন ও ইত্তেফাকের সালেহউদ্দিন অনেক রকম খবরাখবর নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। হাইকোর্ট ডিভিশন পর্যায়ে সুবিচারের দরজা ধীরে ধীরে খুলছে। বড় পুকুরিয়া মামলার কার্যক্রম তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ বেঞ্চে আপিল বিভাগের আদলে গণবিরোধী আচরণের পালা চলছে।
শনিবার ১৮ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৫৫খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন জরুরি আইন অধ্যাদেশ বাতিল না করা হলে বিএনপি সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেবে না। পাঁচ দফা দাবি গৃহীত না হলে দল রেজিস্ট্রেশনের জন্যও আবেদন করবে না। ফলে আগামী অর্ধ মাস জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদপত্রে এই মর্মে উদ্দেশ্যমূলক খবর ছাপা হচ্ছে যে, হাসিনা ও খালেদা জিয়া স্বেচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। যারা এ ধরনের খবর ছড়াচ্ছেন তারা বোকা এবং রাজনীতির বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞান নেই।
রবিবার ১৯ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৫৬অবস্থাদৃষ্টে একবার মনে হচ্ছে নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
আবার মাঝে-মধ্যে অবস্থা মনে হয় খুবই অনিশ্চিত, কারণ নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ ও আবহাওয়া এখনো ফিরে আসেনি। তবে সরকারের মতলব যে খারাপ এবং দুরভিসন্ধিপূর্ণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আশ্চর্যজনক! ভারতীয় হাইকমিশনার বলেছেন যে, জরুরি অবস্থার অধীনেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। আওয়ামী লীগও একই আভাস দিয়েছে। বাইরের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল যে, আওয়ামী লীগ জরুরি আইনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু এখন তাদের স্থানীয় প্রভু ভারতীয় হাইকমিশনার তার মনোভাব প্রকাশ করার পর নির্বাচন যত কাছে আসবে আওয়ামী লীগ ততই তাদের প্রভুর মনোভাবের সাথে একাত্মতা প্রদর্শন করতে থাকবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং রাজনৈতিক সংস্কারের প্রচার চালিয়ে সরকার প্রায় ১৮ মাস সময় কাটিয়ে দিয়েছে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। কিন্তু তারা কী বা কোন সংস্কৃতির উদাহরণ রেখে গেছে? বাংলাদেশের গণতন্ত্র ফিরে এলেও নির্যাতন ও নিবর্তনের ধারাবাহিকতা, বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ ইত্যাদির প্রবণতা এখন নির্বাচিত সরকারের মধ্যেও অব্যাহত থাকবে।
আজ অনেক খবরের কাগজে আমার স্বাস্থ্যাবনতির খবর বের হয়েছে। ব্লাড প্রেসার চেক করতে কোনো হাসপাতাল কর্মচারী আজও আসেনি, আমার অসুস্থতার খবর পত্রিকায় ছাপা হবার পরেও।
সোমবার ২০ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৫৭হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর সরকারের চাপ আসছে যাতে করে অনতিবিলম্বে আমাকে রিলিজ করে সেন্ট্রাল জেলে ফেরত পাঠানো হয়। নিঃসন্দেহে জেলখানার তুলনায় হাসপাতালে আমি ভালো থাকবো। কেননা সেখানে এখানকার মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া যাবে না। আমার সার্জন প্রফেসর সিরাজুল করিমকে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে এবং তিনি তা মানতে বাধ্য। তবে সুমন, জিয়া ও জামিলের মতো তরুণ ডাক্তাররা বলেছেন, যেহেতু আমার অন্যান্য রোগজনিত সমস্যা রয়েছে সেহেতু আমাকে অন্য একজন প্রফেসরের তত্ত্বাবধানে পাঠানো যেতে পারে এবং রোগী হিসেবে ভর্তি করতে প্রফেসর সিরাজুদ্দিন রাজি হয়েছেন এবং দু’ঘণ্টার মধ্যে তারা তাদের সব রকম আনুষ্ঠানিকতা সারিয়ে ফেলেছেন। আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য এই তরুণ তিনজন ডাক্তার এবং প্রফেসর সিরাজুদ্দিনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তা না হলে প্রফেসর সিরাজুল করিম হয়তো আগামীকালের মধ্যে আমাকে ডিসচার্জ করে দিতেন এবং আমাকে ফিরে যেতে হতো ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সেই ২৬নং সেল চম্পাকলি’তে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হয়েছে। এ ব্যাপারে আমি কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলাম। এখন এই ভেবে স্বস্তি লাগছে যে, এখন আর টেকনিক্যালি বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা সম্ভব হবে না। দল নিবন্ধিতকরণের ব্যাপারে সিদ্ধান্তটি ছিল সঠিক।
মঙ্গলবার ২১ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৫৮মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে আমার জামিনের বিষয়ে শুনানি শুরু হয়েছে। কতিপয় টেকনিক্যাল জটিলতার কারণে এই শুনানি আগামীকাল আবার অনুষ্ঠিত হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পাঠানো মেডিক্যাল রিপোর্ট এখন আদালতের বিবেচনাধীন রয়েছে।
অনেকদিন নাজেহাল হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতা ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর আজ জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এখন জেলখানায় আর আওয়ামী লীগের কোনো নেতা নেই। সবাই মুক্ত।
রাজনীতিবিদদের বিশেষ করে বিএনপি নেতাদের ওপর সবরকমের অত্যাচার ও নির্যাতন সত্ত্বেও, রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ ক্রমে ক্রমে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। ক্ষমতাসীন সরকারের পাঁচজন উপদেষ্টা খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে ভবিষ্যৎ নির্বাচন-সংক্রান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। নির্বাচনের ব্যাপারে এ এক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। তারা বুঝতে পারছেন যে, বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না।
বুধবার ২২ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৫৯আমার জামিনের ওপর শুনানি চলছে। সম্ভবত আদেশ জারি হবে আগামীকাল। যেকোনো বড় ছুটির পরে ঐতিহ্য অনুযায়ী বিচারকদের সিনিয়রিটি ও এখতিয়ারের বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে হাইকোর্টের বেঞ্চগুলো পুনর্বিন্যাস করা হয়। বিচার প্রশাসনের ওপর প্রধান বিচারপতির কাপুরুষতা এবং সরকারের এজেন্সিগুলোর নগ্ন হস্তক্ষেপের ফলে সুপ্রীম কোর্টের এই ঐতিহ্যগত কর্মকা- এবার পুরোপুরিভাবে ব্যাহত হয়েছে। অবৈধ সরকারের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি করা ছাড়া এটর্নি জেনারেলের কোনো ভূমিকাই নেই। কাজেই নবগঠিত বেঞ্চগুলোতে দেখা যায় যে, তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে নিম্ন পর্যায়ের বিচারপতিদের হাতে, যারা ব্যক্তিত্বে দুর্বল এবং কম অভিজ্ঞ। উপরন্তু, নিম্ন আদালত থেকে আসা বিচারপতিরা রিট এখতিয়ার সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা রাখেন না। এ কারণেই অপেক্ষাকৃত উদার মানসিকতার, অভিজ্ঞ ও দূরদর্শী উচ্চতর আদালতের সিনিয়র আইনজীবীদের মধ্য থেকেই সচরাচর বিচারক নিয়োগ করা হয়ে থাকে এবং তাদের দ্বারাই রিট শুনানি করা হয়।
নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। সরকার ও নির্বাচন কমিশন উভয়েই এর জন্য সমানভাবে দায়ী। উপরন্তু, তফসিল ঘোষণার জন্য সময় বাকি আছে মাত্র দুই সপ্তাহ। জরুরি আইনের অধীনে যেখানে জনগণের মৌলিক অধিকার প্রয়োগ স্থগিত করা হয়েছে, সেখানে অবাধ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কীভাবে? জরুরি অবস্থা বহাল থাকা অবস্থায় অবাধ ও সুষ্ঠু একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। এ একটি সাধারণ জ্ঞানের বিষয়। তারা যদি আদতেই অবাধ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রত্যাশা রাখেন তাহলে জরুরি আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার করাই হবে বাঞ্ছনীয়।
বৃহস্পতিবার ২৩ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৬০পিজি হাসপাতালের ৮ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্টের ভিত্তিতে হাইকোর্ট ডিভিশন আমাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা সম্পদ ও আয় সম্পর্কিত মামলায় তিন মাসের জন্য জামিন মঞ্জুর করেছে। এর আগে সাধারণ বিবেচনায় আমি এই মামলায় জামিন পেয়েছিলাম, তবে আপিল বিভাগ সেই জামিনের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়ে দিয়েছিল। আমি জানি না গতবারের মতো এবারও সরকার এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত দেবে। এছাড়া নাইকোর অপর একটি মামলায়ও আমাকে জামিন পেতে হবে। সেটিও আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল। এবার মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে আবার জামিনের জন্য আবেদন করা হবে। এ হিসেবে এ মামলায়ও এটা হবে আমার দ্বিতীয়বারের জন্য জামিন। “আজ চার দিন যাবৎ আমার ব্লাড প্রেসার চেক করতে কেউ আসছে না। সারা দিন সকাল থেকে বিকাল অবধি হাসপাতালে পানি সরবরাহ ছিল না।”
আমার বাহু ও পিঠের জন্য ফিজিওথেরাপি নেওয়া শুরু করেছি।
শুক্রবার ২৪ অক্টোবর ২০০৮ দিন ৫৬১সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্যে যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় সেগুলো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা। আসল দেনদরবার থাকলে তা অনুষ্ঠিত হয় পর্দার অন্তরালে।
সেখানে কী ঘটছে তার খবর কেউ জানতে পারে না। দুই নেতা এবং জেনারেলদের মধ্যে কী কী ধরনের সমঝোতা হয়েছে তা সাধারণ মানুষের কাছে অজানা থেকে যায়। হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত হওয়ায় জনগণের মনে তার রহস্যজনক আচরণ নিয়ে আরো সন্দেহের সঞ্চার ঘটেছে। আমার মনে হয় শেখ হাসিনার দেশে ফিরে না আসা বা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে সমঝোতা হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি সে কথা রাখবেন না। হাসিনা অবশ্যই ফিরে আসবেন এবং নির্বাচনে অংশ নেবেন।
(চলবে..)