যারা ইসলামী শরীয়াভিত্তিক বিনিয়োগ করতে চান তাদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর এ সুযোগ নিয়ে এসেছে বেক্সিমকো লিমিটেড। দেশের প্রথম সুকুক সম্পর্কে তথ্য স্মারক প্রকাশ করেছে বৃহৎ এই প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন গত বৃহস্পতিবার তিন হাজার কোটি টাকার এই গ্রীণ সুকুক অনুমোদন দেয়। এরপরই অনলাইনে স্মারক প্রকাশ করে বেক্সিমকো। এ নিয়ে এরই মধ্যে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেড।
স্মারকে বলা হয়েছে, ৫ বছর মেয়াদি সম্পদ নির্ভর এই সুকুক বিনিময়যোগ্য, পুনরুদ্ধারযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক। প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে সুকুকের ৫০ শতাংশ শেয়ার ছাড়বে বেক্সিমকো, ২৫ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারধারীদের জন্য, বাকি ২৫ শতাংশ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
প্রাইভেট প্লেসমেন্ট করা হবে আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে। ২২শে আগস্ট প্রাইভেট প্লেসমেন্টে অংশ নেয়ার সময় শেষ হবে। বেক্সিমকোর শেয়ারধারী ও জনসাধারণের জন্য এই সুকুক নেয়ার সুযোগ শুরু হবে ২৫শে আগস্ট, শেষ হবে ২৭শে আগস্ট।
সুকুক বিক্রয় করে পাওয়া অর্থ থেকে দুই হাজার ২শ’ কোটি টাকা গাইবান্ধা সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পঞ্চগড়ে ২০০ মেগাওয়াট ও ৩০ মেগাওয়াটের দুটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রে অর্থায়ন করবে বেক্সিমকো। এই দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের সর্ববৃহৎ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প। দুই বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে মুনাফা অর্জনের বিষয়টি সরকারের সঙ্গে বেক্সিমকোর ২০ বছর মেয়াদি ক্রয় চুক্তিতে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সরকার সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কয়লা চালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করেছে। একইসঙ্গে সৌরবিদ্যুতের মতো জলবায়ু বান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর গুরুত্বারোপ করেছে। আর এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে চায় বেক্সিমকো। তথ্য স্মারকে বলা হয়েছে, বেক্সিমকোর সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প ২০৩৪ সাল পর্যন্ত কর আওতামুক্ত থাকবে। পাশাপাশি, শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা এবং কিছু ট্যারিফ ও ভ্যাট ছাড়ের সুবিধাও পাবে এই প্রকল্প। আটশ’ কোটি টাকা বেক্সিমকোর টেক্সটাইল বিভাগের বিদ্যমান পরিবেশবান্ধব কারখানার আধুনিকায়ন ও বিস্তৃতকরণ এবং নতুন জ্বালানিবান্ধব যন্ত্রপাতি কেনার পেছনে ব্যয় করা হবে।
বেক্সিমকোর গ্রীন সুকুক বন্ডের বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যারা ইসলামী শরীয়াভিত্তিক বিনিয়োগ পছন্দ করে, তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র কম। এ কারণে ইসলামী ব্যাংকগুলোর এসএলআরের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা পড়ে আছে। একই সঙ্গে যারা সুদ নিতে চায় না, তাদেরও অনেক টাকা পড়ে আছে। এ ধরনের বিকল্প বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হওয়ায়, তারা এখন শরীয়াভিত্তিক সুকুক বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারবে। তিনি মনে করেন এই সুকুক বন্ড ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে যে বিপুল অলস টাকা পড়ে আছে, সেই টাকা বিনিয়োগে নিয়ে আসতে পারবে, যা জাতীয় উন্নয়ন ও পুঁজির সংস্থানে ব্যবহৃত হবে। তখন এই অলস টাকা দেশের শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে অবদান রাখবে। দেশের পুঁজিবাজারে বেক্সিমকোকে দিয়ে শরীয়াভিত্তিক বন্ডের সূচনা হলো। আশ করি ভবিষ্যতে দেশের বাইরে থেকেও এক্ষেত্রে আরও বড় বিনিয়োগ আসবে।
এ বিষয়ে বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কে চৌধুরী জানান, এই সুকুক নিয়ে ইতিমধ্যে ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন তারা। তিনি বলেন, অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সম্পদশালী ব্যক্তিবিশেষ, বিদেশি বিনিয়োগকারী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই সুকুকের প্রাইভেট প্লেসমেন্টের জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
সুকুকটির মুনাফা প্রদানের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ ভিত্তি হার ধরা হয়েছে। তবে সুকুকধারীরা অতিরিক্ত মুনাফাও পাবেন। বেক্সিমকো একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে যে ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ ঘোষণা করবে, তার সঙ্গে ভিত্তি হারের পার্থক্যের ১০ শতাংশ হিসাবে এই অতিরিক্ত মুনাফা দেয়া হবে।
উদাহরণ হিসেবে তথ্য স্মারকে বলা হয়, যদি কোনো বছর বেক্সিমকো ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে, তাহলে ভিত্তি হারের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো ১ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে সুকুকধারীরা ভিত্তি মুনাফা হার ৯ শতাংশের পাশাপাশি অতিরিক্ত ১ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থাৎ মোট ১০ দশমিক ৬ শতাংশ মুনাফা পাবেন।
ইসলামি শরীয়া সম্মত সুকুকটি বেক্সিমকোর একটি শরীয়াহ বোর্ড অনুমোদন দিয়েছে। গতানুগতিক সুদ-ভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি দেশের অসংখ্য ধর্মভীরু মানুষের মধ্যেই অস্বস্তি রয়েছে। তাদের পছন্দ ইসলামী পণ্য।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত মনে করেন বেক্সিমকোর সুকুক বন্ডের বাড়তি সুবিধা হচ্ছে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ গতানুগতিক বন্ডের পরিবর্তে শরীয়াভিত্তিক বিনিয়োগ পছন্দ করে। তিনি বলেন, বেক্সিমকো বন্ডের বিশেষ সুবিধা হলো-এটি বিনিময় বা রূপান্তরযোগ্য। ভবিষ্যতে চাইলে শেয়ার রূপান্তর করা যাবে। এ ধরনের সুবিধা থাকার কারণে চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণ আবেদন জমা পড়বে বা অনেক বেশি সাড়া পাওয়ার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত আশাবাদী।
জায়েদ বখত বলেন, ‘বেক্সিমকো গ্রীন বন্ডের ক্ষেত্রে অগ্রণী ব্যাংক দুটো জিনিস করেছে। প্রথম হলো আইন অনুযায়ী আমরা এর আন্ডার রাইটিং করেছি, যদি কোনো কারণে এর আন্ডার সাবসক্রাইব হয় বা আবেদন কম জমা পড়ে। তবে আমি নিশ্চিত দেশের প্রথম সুকুক বন্ডের ক্ষেত্রে আন্ডার সাবসক্রাইব হবে না বরং চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি আবেদনকারী থাকবে। দ্বিতীয়ত আমরা কো-ইস্যুয়ার হয়েছি। এদিকে থেকে আমরা কিছু কমিশন পাবো।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের প্রথম ইসলামী সুকুক বন্ড বেক্সিমকোর মতো স্বনামধন্য নামী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে, সেখানে অগ্রণী ব্যাংকের থাকাটা সুনাম অর্জনের দিক থেকে ভালো। সুকুক বন্ড পুঁজিবাজারে বিশেষ করে ইসলামী পণ্য প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় পদক্ষেপ। তিনি মনে করেন, আগামীতে বেক্সিমকোর আর্থিক প্রতিবেদন দেখে অন্য প্রতিষ্ঠান বাজারে বন্ড আনার ব্যাপারে উৎসাহিত হবে।
এ বিষয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক মোহাম্মদ আলি বলেন, সুকুক বহু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেই ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। বাংলাদেশেও অনেক মানুষ রিবা বা সুদ রয়েছে এই ধরনের লেনদেন বা আর্থিক কার্যক্রমে জড়াতে চান না। ফলে প্রচলিত সঞ্চয় মাধ্যমের বিকল্প হিসেবে সুকুক এই ঘরানার গ্রাহকদের আকর্ষণ করবে।
গ্রীন সুকুকের আরেকটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এটি বিনিময় বা রূপান্তরযোগ্য। সুকুকধারীরা প্রতি বছর সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ সুকুক বেক্সিমকো লিমিটেডের সাধারণ শেয়ারে রূপান্তর করতে পারবেন। এক্ষেত্রে রূপান্তর হারের ওপর ২৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট রাখা হবে। বিনিময় করার নির্দিষ্ট দিনের আগের ২০ কার্যদিবসের গড় মূল্যই হবে রূপান্তরের হার। এই মার্চেন্ট ব্যাংকার আরও বলেন, ‘যদি একজন সুকুকধারী শেয়ারে রূপান্তর করেন, আর যদি বেক্সিমকো ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে, তাহলে তিনি ৩ বছরে আনুমানিক ২১ থেকে ২৭ শতাংশ রিটার্ন পেতে পারেন।’
সুকুকের প্রতিটি এককের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা। একজন ব্যক্তিকে কমপক্ষে ৫০০০ টাকার সুকুক কিনতে হবে। এটি একটি সম্পদভিত্তিক সুকুক, যা বেক্সিমকোর সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, এর যন্ত্রপাতি ও টেক্সটাইল বিভাগের যন্ত্রপাতি দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে। পাশাপাশি বেক্সিমকো তাদের কর্পোরেট গ্যারান্টি প্রদান করবে।
এই সুকুকের ক্রেডিট রেটিং করা হয়েছে দীর্ঘমেয়াদে ‘এ’। গ্রীন সুকুকের ট্রাস্টি ও ট্রাস্ট ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ। সিটি ব্যাংকের ক্যাপিটাল রিসোর্স লিমিটেড থাকবে ইস্যু উপদেষ্টা, যা ইস্যু আয়োজক ও ইস্যু ব্যবস্থাপক। অগ্রণী ইক্যুইটি অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থাকবে যুগ্ম ইস্যু ব্যবস্থাপক হিসেবে। এইআইএল, এবি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও এআইবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড এক্ষেত্রে আন্ডার রাইটারের দায়িত্ব পালন করবে।
আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ খান বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের জন্য এই সুকুক বেশ প্রতিশ্রুতিশীল। এই বাজারে উচ্চ-মুনাফার সঞ্চয়ের মাধ্যম এমনিতেই সীমিত। সেই হিসেবে এই সুকুক নতুন বিনিয়োগের পথ খুলে দিল। ব্যাংকিং খাতে অত্যধিক তারল্য যেহেতু আছে, তাই এই বিনিয়োগ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয়।