পেগাসাস প্রজেক্টে ভারতে বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক, অধিকারকর্মী এবং বিরোধী রাজনীতিকদের ফোন নম্বর হ্যাক হওয়ার খবরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনেছে বিরোধীরা। তারা দাবি করেছেন, তার সরকার বিরোধী রাজনীতিকদের টার্গেট করে ক্ষমার অযোগ্য এক ‘স্যাক্রিলেজ’ করেছে। ইংরেজি শব্দ স্যাক্রিলেজ মানে হলো কোনো পবিত্র জিনিসকে অপবিত্র করা। অর্থাৎ নিরপরাধ ব্যক্তিকে অপরাধী বানানো। অনলাইন গার্ডিয়ানে এসব কথা লিখেছেন সাংবাদিক হান্নাহ ইলিস-পিটারসেন এবং মাইকেল সাফি। তাদের লেখা রিপোর্টের শিরোনাম ‘মোদি অ্যাকিউজড অব ট্রেজন বাই অপোজিশন ওভার ইন্ডিয়া স্পাইওয়্যার ডিসক্লোজারস’। অর্থাৎ স্পাইওয়্যার প্রজেক্ট ফাঁস হওয়ায় বিরোধী রাজনীতিকরা মোদির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনেছেন।
উল্লেখ্য, ইসরাইলের গোয়েন্দা নজরদারি বিষয়ক প্রযুক্তি পেগাসাস ব্যবহার করে বিশ্বের ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকারগুলো বিরোধী রাজনীতিক, সমালোচক, অধিকারকর্মী, সাংবাদিকদের ফোনে আড়ি পেতেছে।
বিশ্বজুড়ে এমন কমপক্ষে ৫০ হাজার ফোন টার্গেট করা হয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান ও মিডিয়া পার্টনার আউটলেটগুলো রোববার ও সোমবার প্রকাশ করে এমন হ্যাকড হওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য। এতে দেখা গেছে ভারতে ভেরিফায়েড কয়েক শত ফোন নম্বর আছে ওই তালিকায়। এর মধ্যে রয়েছে ভারতে প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধীর ফোন নম্বর। তার ফোন নম্বর ওই তালিকায় দু’বার এসেছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজিত হয়। ফাঁস হওয়া রেকর্ড বলছে, ওই নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের মাসগুলোতে তার ফোন নম্বর টার্গেট করা হয়েছে।
কোনো ফোন সফলভাবে হ্যাক করা হয়েছে কিনা তা ফরেনসিক বিশ্লেষণ ছাড়া বলা সম্ভব নয়। কিন্তু তদন্তকারীরা নিশ্চিত করেছেন যে, এনএসও গ্রুপের সার্ভিলেন্স সফটওয়্যার পেগাসাস ব্যবহার করে ভারতের ১০টি ফোন এবং বিশ্বজুড়ে ২৭টি ফোনকে হ্যাক করা হয়েছে।
ভারতে শুধু সরকারের হাতে আছে পেগাসাস প্রযুক্তি। তবে তা কখনো ব্যবহার করার কথা নিশ্চিত করেনি ভারত। কিন্তু এনএসও’র ক্লায়েন্টদের বিষয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, যখন দেখা গেছে, মোদি সরকারের বেশ কিছু সমালোচককে টার্গেট করা হয়েছে। এ অবস্থায় মোদি সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি দিয়েছে কংগ্রেস। তাতে তারা একটি ‘গুপ্তচরবৃত্তি চক্র’ মোতায়েন এবং সেভাবে কাজ করার অভিযোগ এনেছে সরকারের বিরুদ্ধে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে- ‘এটা সুস্পষ্টভাবে মোদি সরকারের রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং এর মধ্য দিয়ে তারা পুরোপুরিভাবে জাতীয় নিরাপত্তাকে পরিত্যাগ করেছে। তারা এর চেয়েও বেশি করেছে, যখন বিদেশি কোম্পানি এসব ডাটা তাদের হাতে পাবে’। মোদি সরকারের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারকে তারা বিবৃতিতে ভারতীয় জাসুস (স্পাই) পার্টি হিসেবে অভিহিত করেছে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, এ এক অমার্জনীয় ‘স্যাক্রিলেজ’। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিক যে শপথ নিয়েছেন এরমধ্য দিয়ে তার প্রতি অবজ্ঞা দেখানো হয়েছে।
পেগাসাস ফাইলে পাওয়া গেছে নির্বাচনের কৌশল প্রণেতা প্রশান্ত কিশোরের ফোন নম্বর। তিনি এপ্রিলে রাজ্যসভার নির্বাচনে মোদির দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তার ফোন পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তার ফোন হ্যাক করা হয়েছিল পেগাসাস ব্যবহার করে। এ ঘটনায় সোমবার এনডিটিভিকে কিশোর বলেছেন, ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আমাদের বিষয়ে নাক গলানো হয়েছে। কিন্তু আমরা বিষয়টি বুঝতে পারিনি। যদিও আমি ৫ বার আমার হ্যান্ডসেট পরিবর্তন করেছি, কিন্তু হ্যাকিং অব্যাহত ছিল।
কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক ও রাহুল গান্ধীর বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এই ফোন হ্যাককে জঘন্য এবং গণতন্ত্রের প্রতি সংঘাতময় বলে অভিহিত করেছেন। প্রিয়াঙ্কা টুইটারে বলেন, যদি এসব কথা সত্য হয়, তাহলে মোদি সরকার ব্যক্তিগত অধিকারের প্রতি জঘন্য এবং ঘৃণ্য আক্রমণ করেছে। কারণ, ভারতের সংবিধান ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে।
নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে প্রবেশের আগে ২০১৭ সালে টার্গেট করা হয়েছিল ভারতের বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণ’র ফোন নম্বর। সোমবার তিনি পার্লামেন্টে বলেছেন, যে অভিযোগ উঠেছে তা ভারতের গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর প্রচেষ্টা। অতীতেও এমন অভিযোগ উঠেছিল। বলা হয়েছিল, হোয়াটসঅ্যাপের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে পেগাসাস। ওইসব রিপোর্টের কোনো ভিত্তি ছিল না এবং সবাই এ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। তার এ বক্তব্যের সময় বিরোধীদের বেঞ্চ থেকে হর্ষধ্বনি দেয়া হয়।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অভিযোগ করেছেন, যেসব বৈশ্বিক সংগঠন চায় না যে ভারত অগ্রগতি করুক, তারাই এইসব নজরদারির খবরের নেপথ্যে রয়েছে।