মিডিয়া এসময়কালে পুরোপুরি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংকটে আছে। নানামুখী উদ্বেগ মিডিয়াকে গ্রাস করছে। একদিকে বিজ্ঞাপন কমে গেছে। অন্যদিকে সার্কুলেশন। এর বাইরে সরকারি ভাবেও কোনোরকম প্রণোদনা পায়নি গণমাধ্যম। মিডিয়ায় মালিকদের মধ্যে ঐক্য না থাকায় সরকারের ওপর প্রভাব খাটিয়ে প্রণোদনা আদায় করা যায়নি। সিনিয়র সাংবাদিক, অবজারভার সম্পাদক ও ডিবিসি চেয়ারম্যান ইকবাল সোবহান চৌধুরী করোনাকালে মিডিয়ার সংকট নিয়ে কথা বলেছেন মানবজমিনের সঙ্গে।
প্রশ্ন: করোনা চলছে দেড় বছর, এ সময় মিডিয়ার সামগ্রিক পরিস্থিতি কেমন দেখছেন? -এটি একটি বৈশ্বিক সংকট।
এই সময়কালে আমাদের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সকল ক্ষেত্রেই সংকট চলছে। এমন একজন ব্যক্তি নেই বা এমন একটি গোষ্ঠী নেই যারা এই সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এই সময়কালে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে মিডিয়াকর্মীদের কাজ করতে হয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ইতিমধ্যে প্রায় পঞ্চাশজনের মতো সাংবাদিককে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। অনেকেই সংক্রমণে ভুগছেন। একদিকে যেভাবে সাংবাদিক কর্মীরা করোনা সংকটে স্বাস্থ্যগত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিডিয়া হাউজগুলো। অনেক ক্ষেত্রেই মিডিয়াকর্মীদের বেতন-ভাতা ও চাকরির নিরাপত্তা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। গণমাধ্যমের একমাত্র আয় হচ্ছে বিজ্ঞাপন, চ্যানেলগুলোর শুধুমাত্র বেসরকারি বিজ্ঞাপন। করোনা সংকটে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই বিজ্ঞাপন কমে গেছে। আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয় হলো সরকারিভাবে বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে কিন্তু গণমাধ্যমে সেভাবে প্রণোদনা দেয়া হয়নি। শুধুমাত্র ফার্স্ট ওয়েভের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী করোনায় আক্রান্ত এবং কর্মরত সাংবাদিকদের ঈদ উপহার হিসেবে দশ কোটি টাকা দিয়েছেন। যদিও তা এখন পর্যন্ত সবার হাতে পৌঁছায়নি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো ধরনের প্রণোদনা পায়নি। ফলে আর্থিক সংকটের জন্য অনেক পত্রিকা আপাতত বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক বড় বড় পত্রিকাতে বেতন কিছুটা অনিশ্চিত হয়েছে, অনেকে বোনাস দিতে পারেনি। অনেকেই চাকরিচ্যুত হয়েছেন। এরকমটি কেবল প্রিন্ট মিডিয়াতে হয়েছে তা নয় ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও হয়েছে। মিডিয়া এসময়কালে পুরোপুরি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংকটে আছে। সরকারের কাছে প্রিন্ট মিডিয়ার অনেক টাকা পাওনা রয়েছে। কিন্তু সরকার তা ছাড় করছে না। সরকারের কাছ থেকে এই বকেয়া টাকা না পাওয়ায় অনেক পত্রিকার বেতন- ভাতা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যারা সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল তারা এখন পত্রিকা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। আমি মনে করি, সরকারের সামনে একটি সুযোগ এসেছে- প্রচার নেই, অনিয়মিত প্রকাশিত হয়, সাংবাদিক- কর্মচারীও নেই শুধুমাত্র সরকারি বিজ্ঞাপন পাবার জন্য, সাপ্লিমেন্ট পাবার জন্য যেসব পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হয় সেসব পত্রিকার ডিক্লারেশন স্থগিত উচিত।
প্রশ্ন: আপনি কি আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার কথা বলছেন? -আন্ডারগ্রাউন্ড বলবো না, তবে যাদের কোনো অফিস নেই, সার্কুলেশন নেই, সাংবাদিক নেই, অনিয়মিত প্রকাশিত হয়, সাপ্লিমেন্ট পেলে কাগজ বের করে তাদের কথা বলছি। সেসব পত্রিকা সাংবাদিকতারও কোনো উপকার করে না। কর্মসংস্থান করে না। এ ধরনের পত্রিকাগুলো সাংবাদিকতার কোনো উপকার করে না। এরা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। ডিএফপি থেকে সাপ্লিমেন্ট পাওয়া আর দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি বিজ্ঞাপন নেয়াই এদের কাজ। ভুঁইফোঁড় বা আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে যেসব বিজ্ঞাপন যাচ্ছে তারা যারা সত্যিকার সংবাদপত্র প্রকাশে কাজ করছে তারা পাবে। এতে যারা সাংবাদিক নিয়োগ দিচ্ছে, নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশের জন্য কাজ করছে তারা উৎসাহ পাবে। এখন সময় এসেছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জরিপ করে ভুঁইফোঁড় পত্রিকাগুলোর ডিক্লারেশন বাতিল করা। এবং এসব পত্রিকায় যেন কোনো ধরনের সরকারি বিজ্ঞাপন না যেতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। এটি করা গেলে এই শিল্পে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ হবে এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় স্বস্তি ফিরে আসবে। অন্যদিকে ইলেকট্রনিক মিডিয়া মূলত নির্ভরশীল প্রাইভেট বিজ্ঞাপনের ওপর। এ সময়কালে এসে এ সেক্টরেও বিজ্ঞাপনে ভাটা পড়েছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সমস্যাগুলো নিয়ে ইতিমধ্যেই তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে কতোগুলো দাবি তুলে ধরা হয়েছে। বিদেশি চ্যানেল আমাদের দেশে কোনো বিজ্ঞাপন দেখাতে পারবে না। সম্প্রচার আইনেও এটি বলা আছে। বিদেশি চ্যানেলগুলো ক্লিন ফিড দেখাতে পারবে। কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে যে, বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে। প্রচারিত বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে আমাদের কলাকুশলীদের না নিয়ে ভারতীয় কুশলীদের নেয়া হচ্ছে। তাতে আমাদের শিল্পী ও নির্মাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের যে টাকাটা বাইরের বিজ্ঞাপন প্রচারের ফলে বাইরে চলে যাচ্ছে নীতিমালা মানলে সেটি আমাদের এখানে থাকার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া সরকারি যে সব বিজ্ঞাপন প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছে তাতে তাদের আয় হচ্ছে কিন্তু একইসঙ্গে যখন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছে তখন তারা কিন্তু কোনো টাকা পাচ্ছে না। সরকারি প্রচারের কিছু বরাদ্দ টেলিভিশনের জন্য করলে তাদের আয় হতো। অন্যদিকে এখনো পর্যন্ত আমাদের সম্প্রচার ব্যবস্থায় যে অপারেটর সিস্টেম তা এখনো ডিজিটাল হয়নি। একাধিকবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এটি ডিজিটাল হলে একটি লাভ হবে সরকারের। বর্তমানে সরকারের কাছে কোনো তথ্য নেই যে, কি পরিমাণ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে আমাদের। এই তথ্য না থাকার ফলে সরকার ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অপারেটিং সিস্টেম যদি ডিজিটাল হয় তবে সরকার এ খাত থেকে অধিক ট্যাক্স আহরণ করতে পারবে। এক জরিপে দেখা গেছে, এ খাত ডিজিটাল করলে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা আয় হতে পারে। অন্যদিকে দর্শকরাও এতে লাভবান হবে। ডিজিটাল হলে তারা স্পষ্ট ছবি দেখতে পারবে। এখন চ্যানেল চলছে ফ্রি অথচ দুনিয়ার সর্বত্র পে- চ্যানেল। আমাদের এখানে অপারেটররা দর্শকদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে অথচ চ্যানেলগুলোকে কোনো টাকা দিচ্ছে না। একটি পত্রিকা হকাররা বিক্রয় করে একটি অংশ কমিশন নিয়ে বাকি অংশ পত্রিকাকেই দিয়ে থাকে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তা হচ্ছে না। যদি ডিজিটাল করা হয় আর যদি তিন/চার কোটি গ্রাহক থাকে তাহলে এক টাকা করে দিলেও একেকটি চ্যানেল বছরে অন্তত তিন/চার কোটি টাকা পাবে। তখন মিডিয়া হাউজগুলোতে কর্মরত সাংবাদিকরা যেমন আর্থিকভাবে সুবিধা পাবে অন্যদিকে ভালো অনুষ্ঠান নির্মাণে বিনিয়োগ বাড়বে। এ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ইলেকট্রনিক মিডিয়া যে ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে সেই সংকট কেটে যাবে। একইভাবে প্রিন্ট মিডিয়াতেও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দরকার আছে।
প্রশ্ন: করোনার দেড় বছর চলছে। কতোদিন যাবে বলা যাচ্ছে না। প্রণোদনা নিয়ে নানা আলোচনা, কীভাবে দেখেন? -ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক আর প্রিন্ট মিডিয়ার মালিকদের মধ্যে ঐক্য নেই, বিভক্তি আছে, বড়-ছোট আছে। বিভিন্ন মত-পথ আছে। যে কারণে ঐক্যবদ্ধভাবে পোশাক মালিকরা যেভাবে তাদের দাবি-দাওয়া জানাতে পারেন, এফবিসিসিআই যেভাবে তাদের দাবি জানাতে পারে- আমরা সেটি পারি না। মিডিয়ায় মালিকদের মধ্যে ঐক্য না থাকায় সরকারের ওপর প্রভাব খাটিয়ে প্রণোদনা আদায় বা বিভিন্ন দাবি আদায়ে সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। করোনার শুরুতেই পত্রিকার সার্কুলেশনে একটি বড় রকমের ধাক্কা লাগে। ঢাকার বাইরে পত্রিকা পাঠানো যায়নি, ঢাকাতেও প্রচার সংখ্যা কমে যায়। বড় পত্রিকাগুলোও ক্ষতির মুখে পড়ে। সার্কুলেশন থেকে যে আয় হতো তা-ও বন্ধ হয়ে যায়। অনেক পত্রিকা কলেবর কমিয়ে আনে। কারণ, উৎপাদন ব্যয় বেশি হয়ে যাচ্ছিল। করোনার সংকট যদি চলমান থাকে তাহলে সরকার, মিডিয়া মালিক ও সাংবাদিকদের নিয়ে একটি সমন্বিত নীতি গ্রহণ করতে হবে মিডিয়াকে বাঁচাতে। যখন লকডাউনের শুরুতে দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন দেখা গেছে দুটি যোগাযোগের মাধ্যম, একটি মিডিয়া আর অন্যটি মোবাইল ফোন। সরকার কি করছে, বিশ্ব পরিস্থিতি কোথায় যাচ্ছে তা শুধুমাত্র মিডিয়ার মাধ্যমেই মানুষ জানতে পেরেছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মিডিয়া এই দুর্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যেন কোনো গুজব তৈরি না হয়, কোথাও কোনো কৃত্রিম সংকট না হয়। আমি মনে করি, সরকারের জন্যই আর্থিক সংকট থেকে মিডিয়াকে বাঁচাতে হবে।
প্রশ্ন: একজন সিনিয়র সাংবাদিক গ্রেপ্তার ও মুক্তি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের অপব্যবহার নিয়ে নানা আলোচনা?-একটি ভীতিকর পরিস্থিতি ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে সুস্থ ও স্বাধীন সাংবাদিকতা হতে পারে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বললেন, কিন্তু এটি যেমন কাজের জন্য সহায়ক নয় তেমনি যে অফিসটিতে আমি কাজ করছি সেখানে যদি কাজের পরিবেশ না থাকে, কাজের নিরাপত্তা না থাকে, নিয়মিত বেতন না থাকে তবে তাও অস্বস্বিদায়ক। রাষ্ট্রের পক্ষে নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেমন করতে হবে তেমনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি তাদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। ডিজিটাল আইন করা হয়েছে ডিজিটাল অপরাধ দমনের জন্য। সে আইনে সাংবাদিক বলে কোনো কথা নেই কিন্তু এর অপব্যবহার করা হচ্ছে অনেক সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। আমি মনে করি, সাংবাদিকরাও আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু আইন প্রয়োগের নামে যে নির্যাতনের দৃষ্টান্ত তা বন্ধ করতে হবে। আমরা দেখছি, কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হলে তাকে রাত ১২টার সময় ধরে নিয়ে আসা হয়। আমরা বলেছি- সাংবাদিকরা কোনো চোর- ডাকাত না। মামলা হলে সাংবাদিক পালিয়ে যাবে না। মামলা হলে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার না করে সমন জারি করতে হবে। তার বিরুদ্ধে আদালত সিদ্ধান্ত নেবে। মামলা হলে সাংবাদিক যদি আদালতে হাজির না হয় তাহলে আদালত সিদ্ধান্ত নেবে। ডিজিটাল আইন প্রয়োজন আছে ডিজিটাল অপরাধ দমনের জন্য। বিশ্বব্যাপী এ ধরনের আইন রয়েছে। কথা হচ্ছে, ডিজিটাল আইনের অপব্যবহারটা বন্ধ করতে হবে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা হতে পারে- তবে গ্রেপ্তার করা যাবে না, সমন দিতে হবে। গ্রেপ্তার বন্ধ করতে পারলে নিপীড়নও বন্ধ হবে। একেবারে অকার্যকর ও বাতিল আইন অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এটি কারা করেছেন? দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ব্যুরোক্রেসিদের রক্ষা করতে এটি করা হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের বাঁচানো রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না। মিডিয়া ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে সরকারকে রক্ষা করতে। সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ যেন সঠিকভাবে এগিয়ে যায় তা ওয়াচ করছে মিডিয়া। সেখানে যদি তারা বাধাগ্রস্ত হয় এটি খুব দুঃখজনক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকতে পারবে তবে এর অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। কোনো সাংবাদিক যদি মিথ্যা তথ্য দেয় অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কিন্তু আজকে ডিজিটাল আইন সবচেয়ে বেশি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হওয়ায় আইনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আইনটি অবশ্যই সংশোধন হতে হবে।