[সাংবাদিক ও গবেষক আমীর খসরু ১৯৮৭ সালে সরেজমিন আফগানিস্তান যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করেন]
তবে অনেক বিশ্লেষকের মতে, এমনটিও তো হতে পারে যে, আফগানিস্তানের বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে তালেবানরাই পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে তাদের ভাবমূর্তি অর্থাৎ বিদ্যমান ভয়ভীতির ইমেজ দূর করার উদ্যোগ নিতে পারে। এছাড়া আফগানিস্তানের তালেবানরা তালেবানী ইমেজকে বাদ দিয়ে নতুন এক ইমেজ তৈরি করতে পারে। এই বিশ্লেষকের মতে, আগের তালেবানদের তুলনায় বর্তমানের তালেবানরা এক্ষেত্রে আফগানিস্তানের সাথে প্রথমে চীন এবং পরে রাশিয়াসহ অন্যান্যদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমনভাবে বজায় রাখে সে বিষয়টিও জড়িত রয়েছে। এই সমীকরণটির ব্যাপারে আরো ব্যাপক বিচার বিশ্লেষনের দাবি রাখে। তবে মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে যে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইতোমধ্যে কাতারের দোহায় তালেবান ও বিদ্যমান আফগান সরকারের মধ্যে সমঝোতার আলোচনা কোন ফলাফল ছাড়াই গত ১৯ জুলাই শেষ হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, তালেবানরা এখন কাবুল সরকারকে কোন আমলে না নিয়ে আফগানিস্তানের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সবশেষ খবর হচ্ছে, তালেবানরা ৯০ শতাংশ বাণিজ্যিক এলাকাসহ দেশটির ৮৫ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে তালেবানরা দাবি করছে। তারা খুব শিগগিরই কাবুল দখল করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যখন যুদ্ধ করছিল তখন আফগান মুজাহিদরা ছিল ওয়াশিংটনের পরম মিত্র এবং বন্ধু। তৎকালীন মুজাহিদীনদের (যা পরবর্তীকালে তালেবান) বিপুল পরিমাণ অর্থ, অস্ত্র দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র এই মুজাহিদীনদের বীরের সম্মানে ভূষিত করে তাদের নেতাদের ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেই মুজাহিদীনদের পরবর্তী ধারা তালেবানরাই এখন যুক্তরাষ্ট্রের চরম শত্রু। সেই তালেবানদের সশস্ত্র ব্যক্তিরা আফগানিস্তানকে দখল করা নিশ্চিত করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে ভারত বর্তমান আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানির সরকারকেই সমর্থন করে। আর এর কারণ আফগানিস্তানে তাদের বহু ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ রয়েছে। বিভিন্ন হিসেবে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি ভারতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি ইতোমধ্যে ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করেছে। শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়নেই ভারত ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বলে টাইমস অব ইন্ডিয়ার ২ জুলাই ২০২১-এর খবরে বলা হয়েছে। আফগান প্রেসিডেন্ট মাত্র কয়েক দিন আগেই ভারত ও আফগান পারস্পরিক বাণিজ্য কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। মধ্য এশিয়ার সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে ইরানের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত চাহবাহার (Chabahar sea port) সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। কিন্তু সব মিলিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কি হবে, তা নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন।
এ প্রেক্ষাপটেই আফগানিস্তানে ভারতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ভারত তালেবানদের সাথে গোপন বা ব্যাক চ্যানেল প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে ৭ জুলাই কাতারভিত্তিক টেলিভিশন আল জাজিরা জানিয়েছে। ভারতীয় পররষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, ‘আমরা আফগানিস্তানের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখছি। কারণ আফগানিস্তানের দীর্ঘমেয়াদে অবকাঠামো নির্মাণ এবং দেশটির পুননির্মাণের যে অঙ্গীকার ভারতের রয়েছে, তা আমরা অব্যাহত রাখতে চাই। ’
এদিকে, পাকিস্তান রয়েছে বেশ বেকায়দায়। আফগানিস্তানে তালেবানদের শক্তিশালী উত্থান, পাকিস্তানের জঙ্গী গোষ্ঠিগুলোকে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের প্রত্যাহারের বিষয়টি ইতোমধ্যেই আনন্দিত করেছে। ২০০৭ সালে জন্ম নেয়া পাকিস্তানের দুর্ধষ জঙ্গীগোষ্ঠি তেহরিক-ই-তালেবান আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। তালেবানদের এই উত্থান ও আনন্দিত হওয়াকে ইমরান খান বা পাকিস্তানের যে কোনো সরকারের জন্য ভবিষ্যতে বড় হুমকি হয়ে ওঠার সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। তবে পাকিস্তান ইতোমধ্যে বলেছে, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আফগান সমস্যার সমাধান সম্ভব। এই অবস্থায় ইমরান খানের সরকার যদি নিজস্ব ইসলামী ভাবাদর্শ বাড়িয়ে দিয়ে তালেবানদের মোকাবেলা করতে চায়, তা হবে পাকিস্তানের জন্য আরেক দফা বিপর্যয়।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম খবর দিয়েছে যে, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করলেও পাকিস্তানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়বে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে একটি সামরিক ঘাটি করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে নিউইয়র্ক টাইমস গত মাসে খবর দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাবে রাজি হওয়া পাকিস্তানের জন্য কোনো ক্রমেই সমীচিন হবে না। কারণ পাকিস্তান বহু চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তির হাত থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রস্তাবের সাথে একমত হলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য যেমন বিপদের মুখে পড়বে, তেমনি পাকিস্তান তালেবানদের টার্গেট হওয়ার সম্ভাবনাও ইসলামাবাদের পক্ষে ব্যাপকভাবে থেকে যায়। গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে তালেবানরা এক বিবৃতিতে বলেছে, পাকিস্তান যদি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সামরিক সিদ্ধান্তে ইতিবাচক মত দেয়, তবে তা হবে একটি ঐতিহাসিক ভুল। তবে পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ডন ২৪ মে ২০২১-এ পেন্টাগন সূত্রের বরাতে খবর দিয়েছে যে, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে স্থল ও আকাশপথ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
শুধু দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত-পাকিস্তানই নয়, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের প্রভাব পড়বে ইরান ও ন্যাটোভুক্ত তুরস্কসহ ওই বৃহত্তর অঞ্চলজুড়ে। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার ওপরে এর প্রভাব পড়বে নানাভাবে। বিশেষত বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোর জঙ্গিরা মাথাচারা দিয়ে ওঠতে পারে।
(আমীর খসরু, প্রধান নির্বাহী, স্টাডি গ্রুপ অন রিজিওনাল এ্যফেয়ার্স, ঢাকা)
-
আফগানিস্তান: যুক্তরাষ্ট্রের ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের 'পরিত্যক্ত যুদ্ধ'!( পর্ব-১)