× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস

দেশ বিদেশ

সুব্রত বিশ্বাস শুভ্র
২৬ জুলাই ২০২১, সোমবার

ম্যানগ্রোভ এক বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ যা সাধারণত সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের নোনা পানিতে জন্মায়। এগুলো হচ্ছে শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদ। জোয়ারের সময় শ্বাসমূলের সাহায্যে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ শ্বসন কাজ চালায়। এদের মূল থেকে একটা ডালের মতো চিকন অংশ মাটি ভেদ করে উপরে উঠে আসে। জোয়ারের সময় যখন মাটির উপরে পানি জমে যায়, তখন এই শ্বাসমূলগুলো পানির উপরে ভেসে থাকে। এই শ্বাসমূলগুলোর মাথায় এক ধরনের শ্বাসছিদ্র থাকে, যাদের বলে নিউমাটাপো। এদের সাহায্যেই ম্যানগ্রোভ গাছেরা শ্বাস নেয়। ম্যানগ্রোভ বা বাদাবনের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং এর প্রতিবেশ সুরক্ষার আহ্বান জানিয়ে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস পালিত হয়।
আজ ২৬শে জুলাই আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস।
ইকুয়েডরে ম্যানগ্রোভ বন কেটে চিংড়ি চাষ করার প্রতিবাদে ১৯৯৮ সালের ২৬শে জুলাই আয়োজিত সমাবেশে একজন অংশগ্রহণকারীর মৃত্যু হয়। সেই থেকে তার স্মরণে এই দিনটিতে আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘও দিবসটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
পৃথিবীতে ১০২টি দেশে ম্যানগ্রোভ বনের অস্তিত্ব থাকলেও কেবলমাত্র ১০টি দেশে ৫০০০ বর্গ কি.মি.’র বেশি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রয়েছে। পৃথিবীর সমগ্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ৪৩% ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া এবং নাইজারে অবস্থিত এবং এদের প্রত্যেকটি দেশে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ২৫% হতে ৬০% ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থিত ম্যানগ্রোভ বন (সুন্দরবন) পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ১০,২৩০ বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে এ বন বিস্তৃত। বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ৬,০৩০ বর্গ কি.মি.।
বাংলাদেশের সমুদ্রোপকূলে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন প্রধান। কক্সবাজারে মাতামুহুরী নদীর মোহনায় ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে যা ‘চকোরিয়া সুন্দরবন’ নামে পরিচিত। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে বাংলাদেশে। যার বর্ণনা নিম্নে দেয়া হলো।
সুন্দরবন বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। অভ্যন্তরীণ নদী ও খাল সহ এ বনের আয়তন প্রায় ৬৪৭৪ বর্গ কি.মি.। বাংলাদেশের মোট বনভূমির ৪৭ ভাগই সুন্দরবন। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এ ম্যানগ্রোভ বন গড়ে উঠেছে। এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী ছাড়াও অন্যান্য বৃক্ষের মধ্যে গেওয়া, পশুর, ধুন্দল, কেওড়া, বাইন ও গোলপাতা অন্যতম।
সুন্দরবনের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য খাল ও নদী। এসব নদীতে কুমির, ভোদর, ডলফিন, কাঁকড়া এবং চিংড়িসহ প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ রয়েছে।
সুন্দরবনের প্রাণী বৈচিত্র্যের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো- ডোরাকাটা দাগবিশিষ্ট রয়েল বেঙ্গল টাইগার। পৃথিবীর অন্য কোথাও এই প্রাণী আর দেখা যায় না। অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে রয়েছে হরিণ, বন্য শূকর, বনবিড়াল, বানর, সাপ, মৌমাছি এবং ২৭০ প্রজাতির পাখি।
বর্তমানে সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যগুলোর একটি। বনবিভাগের রাজস্ব আয়ের অধিকাংশের বেশি আসে সুন্দরবনের কাঠ, জ্বালানি, গোলপাতা, মধু, মোম ও নদীর মাছ হতে।
কক্সবাজার জেলায় মাতামুহুরী নদীর মোহনায় অবস্থিত ম্যানগ্রোভ বনের নাম ‘চকোরিয়া সুন্দরবন’। এ বনের প্রধান উদ্ভিদ হলো- বাইন, ওরা, কেওড়া, গরান, হিন্তাল, গোলপাতা ইত্যাদি।
টেকনাফের কাছাকাছি নাফ নদের তীরেও একটি ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। এ বনের বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে সাপ, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও মাছ রয়েছে।
টেকনাফ থেকে ১২ কি.মি. দূরে বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণাংশে একটি ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। এ বনের উদ্ভিদের মধ্যে ক্রিপা, খলশি ও ভোলা অন্যতম। এ বনের প্রাণীর মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ ও কাঁকড়া।
উপকূলের প্রতিকূল ও লবণাক্ত মাটিতে গরান, বাইন ও কেওড়া গাছ ভালো জন্মে। তাই বর্তমানে এ অঞ্চলে এসব গাছের চারা রোপণ করে কৃত্রিমভাবে ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টি করা হয়েছে।
তথ্যমতে, পৃথিবীতে ১,৮১,০০০ বর্গ কি.মি. এলাকাজুড়ে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বিস্তৃত ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ বনাঞ্চলের আয়তন ১,৫০,০০০ বর্গ কি.মি.’র নিচে নেমে এসেছে। সমগ্র পৃথিবীর উপকূলীয় আবাসস্থল অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল থেকে অতিরিক্ত কাঠ ও মাছ আহরণের ফলে এবং উপকূলীয় ভূমিকে বিকল্প ব্যবহারযোগ্য ভূমি হিসেবে ব্যবহারের ফলে এ বনাঞ্চল হুমকির সম্মুখীন। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো অনেক প্রজাতিই এ বনকে তাদের জীবনচক্রের কোনো না কোনো সময় ব্যবহার করে।
পুরো পৃথিবীতে প্রায় ৫০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ রয়েছে। যার ৩৫ প্রজাতি রয়েছে সুন্দরবনে। লবণের তারতম্যের ভিত্তিতে বনের বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪০০ প্রজাতির মাছের আবাসস্থল সুন্দরবনে।
বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়ের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই সুন্দরবন। বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড টেনে নেয়। এতে পরিবেশের দূষণ কমে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে খাদ্যে রূপান্তরিত করে সুন্দরবনের নোনা পানির উদ্ভিদরাজি বেড়ে ওঠে। কেওড়া গাছ সর্বাধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড তার শিকড়, কাণ্ড, ডালপালা ও পাতায় আটকে রাখতে পারে। এক হেক্টর কেওড়া বন বছরে ১৭০ টন পর্যন্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড আটকে রাখতে সক্ষম। বাইনের ক্ষেত্রে তা ১১৫ টন, গেওয়ায় ২৩ টন। গাছের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই ক্ষমতা হ্রাস পায়।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে ৬৬২ কোটি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড সঞ্চিত। এর সঙ্গে প্রতি বছর যোগ হচ্ছে আরও ৩৮ লাখ টন। আটকে থাকা এই বিষ-গ্যাসের একাংশ শর্করায় পরিবর্তিত হওয়ায় প্রতি বছর এরা আরও বেশি গ্যাস আটকে রাখতে সক্ষম হয়।
জীব বৈচিত্র্যের এমন প্রাচুর্যতার জন্য সুন্দরবন ১৯৯২ সালের ২১শে মে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৯৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর ইউনেস্কো সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে। আর এ জন্য সুন্দরবনের সৌন্দর্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশে ১৪ই ফেব্রুয়ারি পালিত হয় ‘সুন্দরবন দিবস’।
মানুষ কৃষিকাজ ও খাদ্যের জন্য প্রায় সাত হাজার উদ্ভিদ ও কয়েক হাজার প্রাণীর উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। মানুষের জীবন ধারণের জন্য জীববৈচিত্র্যের প্রয়োজনের কোনো শেষ নেই। এদেশের অর্থনীতিকে অচল রাখতে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। তাই এ বনের রক্ষণাবেক্ষণ করা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব।
লেখক : কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ এবং সমন্বয়ক, মিডিয়া সেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর