× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

লকডাউন বাঁচায়, লকডাউন মারেও

মত-মতান্তর

ডঃ জহির আহমেদ
২৭ জুলাই ২০২১, মঙ্গলবার

করোনা ভাইরাসের সর্বব্যাপী প্রভাব সম্পর্কে আমরা জানি। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পরিবার সব স্তরেই এই প্রভাবলক্ষ্য করি। লাশের পোস্টমর্টেম করা হচ্ছে, কিন্তু জীবন-জীবিকারপোস্টমর্টেম করার দরকার আছে কি? ভাইরলজি, এপিডেমিলজি, ফার্মাকোলজি এবং বায়ওমেডিসিন করোনা প্রতিরোধে লকডাউনেরপক্ষে মত দেন। ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্নকরণের উপর জোর দেন। আবার অর্থনীতি-রাজনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা লকডাউন এর কারণে জীবিকার উপরে নেতিবাচক প্রভাবকে গুরুত্ত দেন। তাঁরা সবাই জীবন বিষয়ক বিদ্বান। প্রাত্যহিক জীবন ঘনিষ্ঠ আম জনতারও জিজ্ঞাসাঃ জীবন কিভাবে রক্ষিত হবে?
কিভাবে জীবনের মূল্যায়ন হবে তা বোঝা এই মুহূর্তে সব চাইতে জরুরি। জীবন এর নিশ্চয়তা মানে মূল্যরনিশ্চয়তা।
লকডাউনের মুল্য কি? লকডাউন কি জীবনের মান কে নিশ্চিত করবে?
২০২০ সালে পৃথিবী করোনা মোকাবেলায় অপ্রুস্তুত ছিল, কিন্তু এই ২০২১ সালের মার্চের পর আর অপ্রুস্তুত থাকছেনা। গত বছরের তুলনায় এই বছরে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে। এখন টীকা (কার্যকর- অকার্যকর যা বলিনা কেন) আবিষ্কার হয়েছে। আশা তো জাগিয়েছে। উন্নত দেশে ব্যাপক সংখ্যক নাগরিককে টিকার আওতায় আনা হয়েছে, মৃত্যু ঝুঁকি অনেক কমিয়ে দিয়েছে। যে মেগাসিটি গুলো ক’মাস আগেও ছিল মৃত্যুপুরী, সেখানে প্রাণ চাঞ্চল্য আবার ফিরতে শুরু করেছে। অতি সম্প্রতি আমরা দেখি ফুটবল টুর্নামেন্ট দর্শক দেখছে। স্টেডিয়াম ভরা মানুষ-মাস্ক পরা দর্শকের সংখ্যা ছিল খুব কম।
লকডাউনকরোনা নিয়ন্ত্রণের জনপ্রিয় মেথড। এটি কোভিড-১৯ এর বিরুদ্দে জৈব রাজনৈতিক সাড়া। লকডাউনের গুরুত্ত্ব হছে এটি সময় নেয়, সময় ক্ষেপণ করে--করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতির জায়গা তৈরি করতে সুযোগ করে দেয়। এটি সংক্রমণকে ধীর করে দেয়, চেইন ভেঙ্গে দিতে পারে কিন্তু তা সাময়িক। লকডাউন সংক্রমিতকে এক সাথে হতে দেয়না, হাসপাতালের উপর চাপ কমায়, আই সি ইউ-র উপর নির্ভরতা কমায়।বায়ওফারমাসিটিক্যাল পদক্ষেপ গুলো হচ্ছেঃ জনসংখ্যার বিভিন্ন দিকেরনিয়ন্ত্রণ। যেমন টেস্টিং, কনটাকট ট্রেচিং,--এগুলোর মাধমে আমরা প্রকৃত সংক্রমন চিহ্নিত করি।আমরা মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রন করি।
এই মুহূর্তে আমরা লকডাউনের নামে ‘বিধি নিষেধ’ আরোপ করেছি, ঈদ উপলক্ষে ছাড় দিলেও এখন আবার দু সপ্তাহের জন্যে পুরোপুরি ‘শাট ডাউন’ করেছি। পাশ্চাত্য কায়দায় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ, বিমান বন্দর নিয়ন্ত্রন ইত্যাদি আমরাও অনুসরণ করছি। ঈদের আগে ও পরদিন প্রচুর মানুষ বিশেষতঃ কর্মজীবী শ্রেণী গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছেন। টেলি কোম্পানিগুলোর ঈদ-উত্তর হিসেব দেখাচ্ছে যে, কোটির অধিক মোবাইল সিম ব্যবহারকারীরা এ কুরবানি ঈদে ঢাকা থেকে দেশের বাড়ি গেলেও ফেরত এসেছে অনেক কম। বলা যায়, লকডাউনের কারণে তাদের জীবিকা স্থবির হয়ে থাকবে এ শঙ্কা তাঁদের থাকছেই। মহানগরে না খেয়ে থাকার ঝুঁকি তাঁরা নেননি। তাঁদেরঅনেকেই আমাকে বলেছেন যে, ‘সংক্রমণের কারণে মৃত্যু ঝুঁকির চাইতে লকডাউনের কারণে অনাহারে মৃত্যু ঝুঁকি অনেক গুণ বেশী হতে পারে’।
ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলাদেশের মানুষ ঈদ পার্বণে দেশের বাড়িমুখীন-লকডাউনথাকুক আর না থাকুক।এটি ধর্মীয় অনুভুতি, এটি সাংস্কৃতিক যুক্তি। এই মানুষগুলো কি তাদের জীবনের নিরাপত্তা বুঝবেনা? তারা অবশ্যই বোঝেন। আমাদের এত রিসোর্স কই যে বাড়ি ফেরা মানুষকে গাদাগাদি করতে না দিয়ে নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেবে? এই বোধ করোনা ভাইরাসকে অন্যান্য সব রোগের মতই মনে করেতাঁরা এবং যদি এই বাড়ি ফেরায় মৃত্যু ঘটেও তা হবে ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যু- ‘নাড়ির টানের’ মৃত্যু। তাঁর প্রশান্তি হচ্ছে, নিজের বাড়ির গোরস্থানে দাফন হবে, যেখানে তাঁর স্বজনরা শায়িত আছেন। ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক এই বিষয় গুলোকে কেবল অজ্ঞতা বা কুসংস্কারবলে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবেনা।
সরকার যেন ঘড়ির দোলকের মত দোলাচলে আছে। একবার স্বাস্থ্য তথা সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের আশ্রয় নিচ্ছে, আবার অর্থনীতিকে সচল করতে শিথিলতা দেখাচ্ছে। সাময়িক থেকে কঠোর- এই বাইনারির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি তথা জীবন ও জীবিকাকে মুখোমুখি করে তুলছে। এই দ্বৈরথ অবস্থা গত বছরের বিশ্ব ব্যাপী উদার নৈতিক সঙ্কট থেকে সৃষ্ট। এখনতো টীকা আছে। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তা সহজলভ্য করা। গণ হারে টীকা দেবার এখনই সময়। রাষ্ট্রকেই এর ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের সামনে উদাহরণ আছে। ১৯২৮ সাল-ওইপনিবেশিক শাসন চলছিল । ভারত উপমহাদেশে কলেরা মহামারি ব্যপক প্রাণহানি ঘটাচ্ছে। ভারত এবং বাংলাদেশের প্রচুর অভিবাসিত শ্রমিক জাহাজে করে রেঙ্গুন যেত জীবিকার প্রয়োজনে। তখন প্রতিটি প্যাসেঞ্জারকে টীকা না নিয়ে ডেকে উঠতে দেয়া হতনা। এবং তখন বাধ্যতামুলক কোয়ারেনটাইনে থাকতে হত। এই উত্তর আধুনিক যুগেও আমরা কি মানুষের যে কোন ধরনের চলাচলে কিংবা বসত স্থানে তাদেরকে টিকার আওতায় আনতে পারিনা? এই মহাযজ্ঞে অনেক টেকনিক্যাল সমস্যা থাকবেই। তবে শুরুটা তো করতে হবে। হাসপাতালের কাছে নয়; মানুষের কাছে যাওয়াটা জরুরী এবং সময় এখনই।

লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর