× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রাণ গেল ঊষা রানীর /লাল পতাকায় সতর্কতা করোনা কী জানে না ওরা

শেষের পাতা

মাহবুব খান বাবুল, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে
২৮ জুলাই ২০২১, বুধবার

করোনা কেড়ে নিলো গৃহবধূ ঊষা রানী দাসের (৫৩) প্রাণ। সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ ইউনিয়নের দাসপাড়া গ্রামের সুকুমার দাস ওরফে মন্টু দাসের স্ত্রী ঊষা। নমুনা পরীক্ষার পরদিনই গত ২৩শে জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মাত্র ১০-১২ জন মিলে সম্পন্ন করেন তার দাহ কাজ। মন্টু দাস ও তার ছেলে সুজয় ওইদিনই নমুনা দেন। বাবা-ছেলে দু’জনেরই ফলাফল আসে নেগেটিভ। উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে ওইদিনই দাসপাড়া গ্রামে ৬টি লাল পতাকা উড়িয়ে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত ও নিরাপদে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগ। এ অবস্থায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন গ্রামবাসী।
চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক। ঠাণ্ডাজ্বরে আক্রান্তরা একেবারে একা হয়ে যান। ঊষার পরিবারকে ঘিরে প্রকাশ্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দাদের ধিক্কার ও তিরস্কারে কষ্টে আছেন তারা। দাস পাড়ার জেলেদের কাজে নেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনাহার-অর্ধাহারে কষ্ট করছেন ৩০-৩৫টি পরিবার। পাশের মার্কেটের ব্যবসায়ীরা ওই পাড়ার লোকজনের কাছে মালামাল বিক্রি করতে অনীহা প্রকাশ করছেন। দাসপাড়া গ্রামের কেউই এখনো টিকা নেননি। স্বল্পতার কারণে টিকা গ্রহণ না করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রথমসারির সম্মুখযোদ্ধা সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান মো. সরাফত আলীসহ গোটা পরিষদের সদস্যরা। অনুসন্ধানে হাসপাতাল, ভুক্তভোগী ও গ্রামবাসী সূত্র জানায়, কালিকচ্ছ ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের দাসপাড়া গ্রামে ২২৫ জন নারী-পুরুষের বসবাস। খানা সংখ্যা ৫৪। করোনা চিনেন না তারা। উপসর্গও অজানা তাদের। নমুনা পরীক্ষা করাননি আদৌ। তারা এখনো জানেন না স্বাস্থ্যবিধি কি? কেন মাস্ক পরতে হবে? স্যানিটাইজার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তাদের। যেখানে-সেখানে গিজগিজ করে বসছেন নিয়মিত। মাস্ক বিহীন ঘুরছেন দেদারছে। বিকাল বেলা ওই গ্রামের পাশের ২-১টি বাজারে মানুষের ঢল নামে। চায়ের দোকানে ২০-৩০ জন একসঙ্গে বসে আড্ডা করছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একই কাপে চা পান করছেন অর্ধশতাধিক লোক। এভাবেই চলছে পানি ও সিগারেট পানের প্রতিযোগিতা। গরমে শান্তির জন্য পান করছেন ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানীয়। ফলে জ্বর-সর্দি-কাশির রোগী রয়েছে অধিকাংশ ঘরেই। এ জ্বরকে তারা স্বাভাবিক বা সিজনাল ভাইরাস মনে করছেন। খাবারে স্বাদ নেই। নাকে গন্ধ নেই। সবই মামুলি বিষয় তাদের কাছে। যাচ্ছেন না চিকিৎসকের কাছে। প্যারাসিটামল বা নাপা ট্যাবলেট খাচ্ছেন। করোনা নিয়ে তারা মোটেও ভাবছেন না। এটাকে তারা কোনো গুরুত্বপূর্ণ রোগ মনে করছেন না। তাদের অনেকেই করোনাকে সরকারের একটি পলিসি বলেও উল্লেখ করছেন। ফলে লকডাউন চলাকালেও ওই গ্রামের লোকজন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। এখন পর্যন্ত গ্রামের একটি লোকও করোনা প্রতিরোধের টিকা গ্রহণ করেননি। একটি পুকুরের চার পাড়ে বসবাসকারীরাই এই পাড়ার বাসিন্দা। এ পুকুরের পানিতে তারা শিশুদের মলমূত্র ত্যাগের বিছানা ও কাপড় ধৌত করছেন। পানিতে মিশছে মাছের খাবারের নামে ভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল। আর এ পুকুরেই নিয়মিত গোসল, ভাতের চাল ও তরকারি ধৌত করছে দাসপাড়া গ্রামের অধিকাংশ পরিবার। তবে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের ধারণা ওই গ্রামের মানুষগুলো সচেতন নয়। করোনা বা স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে তাদের ধ্যান-ধারণা অনেক পিছিয়ে আছে। স্বাস্থ্য সহকারী শেখ রফিকুজ্জামান বলেন, সেখানকার অধিকাংশ লোক স্বাস্থ্যবিধি শুধু শুনেন। বোঝেন না। মানেনও না। আরও বলেন, করোনা আবার কি? করোনায় মানুষ মরে না। মরণ আসলে মরবোই। কেউ আটকাতে পারবে না।

করোনায় নিহত দাসপাড়া গ্রামের ঊষা রানীর স্বামী সুকুমার দাস মন্টু (৫৫) বলেন, স্ত্রীকে হারিয়ে কষ্টে আছি। আরও কষ্টে আছি মানুষের কথায় ও আচরণে। আমার পরিবারের কেউই টিকা নেয়নি। জ্বর হলে ঊষাকে গত ২৫শে জুন জেলা শহরে চিকিৎসা করি। গত ২২শে জুলাই হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সরাইল হাসপাতালে গেলে নমুনা নিয়ে নিরীক্ষার পর পজেটিভ আসে। দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যায়। ২৩শে জুলাই সকালে মারা যায়। ভয়ে লোকজন দাহ কাজে আসতে চায়নি। কোনোরকমে ১০-১২ জন মিলে দাহ সম্পন্ন করেছি। প্রশাসনের লোকজন এসে পুকুরের চার পাড়ে ৬টি লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়ে গেছেন। এরপর থেকে শুধু আমার পরিবার নয় গোটা দাসপাড়াকে আড় চোখে দেখছেন পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দারা। আমাদের দেখলেই বলে করোনার গ্রামের লোক আসছে। সাবধান। এদের থেকে দূরে থাক। তোমরা বের হও কেন? রেড জোনের ভেতরে থাকো। কেউই মিশতে চায় না। আমাদের গ্রামের লোকজনের কাছে মালামাল বিক্রয় করতে চায় না ব্যবসায়ীরা। দাসপাড়া গ্রামের জেলে পরিবারের সদস্য পরিমল দাস (৪৫), হারাধন (৩৫), বিকাশ দাস (৩০) ও রাকেশ দাস (৩২)সহ অনেক জেলে বলেন, আমরা জেলের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি। লাল পতাকা লাগানোর পর আমাদেরকে কেউ কাজে নিচ্ছে না। আমাদের শরীরে নাকি করোনা আছে। বেকার হয়ে গেছি। অর্ধাহার অনাহারে আছি। আমাদেরকে বাঁচান। নিহত ঊষা রানীর কলেজ পড়ুয়া ছেলে সুজয় চন্দ্র দাস (১৭) বলেন, আসলে অজপাড়া-গাঁ হওয়ায় এ গ্রামে স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন খুব একটা আসেন না। শুধু করোনা নয়, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অনেক বিষয়ে গ্রামবাসী এখনো অজ্ঞ। কালিকচ্ছ পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ও দাসপাড়ার বাসিন্দা শিশু ডলি বেগম জানায়, দোকানে গেলে তাদেরকে ধমকায়। দূরে সরে থাকতে বলে। হাতে হাতে কোনো মাল দেয় না। লুঙ্গি বা কোনো কাপড় মাটিতে বিছিয়ে সেটার ওপর মাল রাখেন। পরে সেখান থেকে আনতে হয়। সবাই আমাদের ঘৃণা করে। ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. ধন মিয়া নিজে এখনো টিকা না নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আমি আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে টিকা নেবো। দাসপাড়ার সকলকে টিকা নিতে সহায়তা করবো। ইউপি চেয়ারম্যান মো. সরাফত আলী বলেন, প্রথম ধাপে টিকার স্বল্পতার কারণে আমিসহ পরিষদের কেউ টিকা নিতে পারেননি। দাসপাড়া গ্রামের কেউ এখনো টিকা নেয়নি এটাও সত্য। তবে তারা করোনা বিষয়ে কিছুই জানে না। এটা তাদের অসচেতনতা ও ব্যর্থতা। কারণ সরকার করোনা বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. নোমান মিয়া বলেন, আমাদের কর্মীরা নিয়মিত প্রত্যেকটি পাড়া-মহল্লায় কাজ করছেন। এরপর রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। সেবা নেয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাঁচতে হলে প্রত্যেকটি নাগরিককে সচেতন হতে হবে। সরকার তথা স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা মানতে হবে। হাসপাতালে নিয়মিত নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। টিকাও দেয়া হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরিফুল হক মৃদুল বলেন, লাল পতাকা দিয়েছি শুধুমাত্র স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সতর্ক ও প্রত্যেকটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এ বাড়িতে করোনায় মৃত্যু হয়েছে। আপনি/আপনারা আসবেন না। এই বাড়ির কেউ বাইরে যাবেন না। এ অবস্থা বহাল থাকবে ১৪ দিন। বিষয়টিকে নেগেটিভলি দেখার কিছু নেই। কারো খাবারের সমস্য হলে শুধু আমাদেরকে জানাতে বলে এসেছি। আমরা খাবার পৌঁছে দেবো। ৬নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মোছা. রোকেয়া বেগম বলেন, করোনায় মৃত্যু হয়েছে। তাই ঊষা রানীর দাহ কাজে লোকজন আসছিল না। আমি উপস্থিত থেকে মাত্র ১০-১২ জন লোককে নিয়ে দাহ সম্পন্ন করেছি। শিক্ষার হার কম ও দারিদ্র্যের কারণে গ্রামটির অধিকাংশ লোক সচেতন নয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর