× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

‘গর্বিত পিতা থেকে আমি এখন ভিক্ষুক’

বিশ্বজমিন

মানবজমিন ডেস্ক
(২ বছর আগে) জুলাই ২৮, ২০২১, বুধবার, ১১:৩৭ পূর্বাহ্ন

গর্বিত পিতা থেকে আমি এখন ভিক্ষুক। প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ভারতের অনীল শর্মা। করোনায় আক্রান্ত ছেলে সৌরভকে (২৪) চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি সব সঞ্চয় হারিয়েছেন। আত্মীয়দের কাছ থেকে ঋণ করেছেন। তাতেও সামাল দিতে পারেননি পরিস্থিতি। শেষ পর্যন্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এখন তার ঋণের বোঝা আকাশচুম্বী। অসহায় অনীল তাই অনলাইনে সাধারণ মানুষের কাছে হাত পাতেন।
তাতে সংগৃহীত হয়েছে ২৮ হাজার ডলার। এখনও তার ঋণ বাকি ২৬ হাজার ডলার। ফলে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি নিজেকে ভিক্ষুক হিসেবে অভিহিত করেছেন। অনলাইন আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

গত বসন্তে ভারতকে তছনছ করে দেয় করোনা ভাইরাস। এ সময় আক্রান্ত হন সৌরভ। তাকে ভর্তি করা হয় নয়া দিল্লির এক বেসরকারি হাসপাতালে। কমপক্ষে দু’মাস হাসপাতালে ছিলেন তিনি। প্রতিদিন তাকে দেখতে যেতেন পিতা অনীল। মে মাসে ভারতে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্বরেকর্ড গড়ে। এক দিনে সেখানে যখন চার লাখ আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়, এ সময় ভেন্টিলেটরে জীবনের সঙ্গে লড়াই করছিলেন সৌরভ। তার গলার ভিতর দিয়ে টিউব দেয়া হয়েছিল। ছেলের এমন পরিণতি দেখে হৃদয় ভেঙে যায় অনীল শর্মার। তিনি একা একা অঝোরে কাঁদতে থাকেন। ছেলের অগোচরে অশ্রু ফেলেন আর ঝাঁপসা চোখে প্রার্থনা করতে থাকেন।

অনীল শর্মা বলেন, তা সত্ত্বেও আমাকে শক্ত থাকতে হয়েছে ছেলের সামনে। কিন্তু তার সামনে থেকে সরে আসার সঙ্গে সঙ্গে, তার রুম থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়তাম। সৌরভ সুস্থ হয়েছে। এখন বাড়ি সে। কিন্তু শরীর অসম্ভব দুর্বল।

তিনি বাড়ি ফেরায় পরিবারে যে আনন্দ হওয়ার কথা তা মিইয়ে গেছে পাহাড়সম ঋণে। তাকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে এই ঋণ করেছেন পিতা অনীল শর্মা।

ভারতে বর্তমানে জীবন স্বাভাবিক হয়ে আসছে। আক্রান্তের সংখ্যা কমে গেছে। কিন্তু বহু পরিবার পাহাড়সম ঋণের জালে আটকা পড়েছে। তারা মেডিকেল বিল পরিশোধ করতে গিয়ে এই ঋণ করেছেন। ভারতে বেশির ভাগ মানুষের কোনো স্বাস্থ্যবীমা না থাকায় সাধারণ মানুষ এমন সঙ্কটে অসহায় হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে এম্বুলেন্স, পরীক্ষা, ওষুধ ও আইসিইউ বেডের ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে জীবনের সব সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে অনীল শর্মার। তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। খরচ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রথমে তিনি বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়েছেন। তারপর অজ্ঞাত মানুষের কাছে হাত পেতেছেন। ভারতের ‘কেটো’ নামের একটি অনলাইন ওয়েবসাইটে সাহায্যের আবেদন জানান। সব মিলে অনীল শর্মার মেডিকেল বিল চলে আসে কমপক্ষে ৫০ হাজার ডলার। অনলাইনে হৃদয়বাণ মানুষের সাহায্যে তার মধ্যে তিনি সংগ্রহ করতে সক্ষম হন ২৮ হাজার ডলার। কিন্তু ঋণ শোধ করতে তার এখনও ২৬ হাজার ডলার প্রয়োজন। কান্নাজড়িত কন্ঠে অনীল বলেন, আমার ছেলে তার জীবনের জন্য লড়াই করছিল। আর আমরা লড়াই করছিলাম তাকে বাঁচিয়ে রাখতে। আমি একজন গর্বিত পিতা। কিন্তু এখন আমি ভিক্ষুক হয়ে গিয়েছি।

করোনা মহামারি ভারতের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। কম আয়ের লাখ লাখ মানুষকে আর্থিক এক দুর্যোগে ফেলে দিয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও নাজুক হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। এমনকি মহামারি শুরুর আগে ভারতের স্বাস্থ্য সুবিধায় সমস্যা ছিল। ভারতীয়রা তাদের চিকিৎসায় নিজেদের পকেট থেকে খরচ করেন শতকরা প্রায় ৬৩ ভাগ। করোনা মহামারিকালে বিশ্বজুড়ে ব্যক্তিগত চিকিৎসা খরচের ডাটা পাওয়া কঠিন। কিন্তু ভারত ও অন্য কিছু দেশে করোনার চিকিৎসা আকাশচুম্বী। তার ওপর লাখ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এ অবস্থায় তাদের কাছে চিকিৎসার খরচ বহন করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।

২০২০ সালের মার্চে ভারতে কঠোর লকডাউনের পর কিছু কিছু শহরে কাজকর্ম শুরু হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষের বেতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মধ্যে অনীল শর্মা একজন। তিনি একটি কোম্পানিতে মার্কেটিং পেশায় কাজ করতেন। তিনি যখন ছেলে সৌরভের বন্ধুদের কাছে ‘কেটো’ সাইটে অর্থ সংগ্রহের জন্য আবেদন করার অনুরোধ করেন, তখন ১৮ মাস বা দেড় বছর ধরে তিনি বেতন পান না।

মার্চে প্রকাশিত পিউ রিসার্সের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনার কারণে ভারতে তিন কোটি ২০ লাখ মানুষ মধ্যবিত্ত থেকে আরো নিচে নেমে গেছেন। তাদের দৈনিক আয় ছিল ১০ ডলার থেকে ২০ ডলারের মধ্যে। এর ফলে ভারতে দরিদ্র্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে ৭ কোটি ৫০ লাখ। এসব মানুষের দৈনিক আয় ২ ডলার বা তারও কম। পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট কে শ্রীনাথ রেড্ডি বলেন, ভারতে মানুষ কেন ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে এবং তারা দরিদ্র হয়ে পড়ছেন যদি আপনি এ বিষয়টি জানতে চান, তাহলে দুটি বিষয়ের দিকে আপনাকে নজর দিতে হবে। তা হলো স্বাস্থ্যসেবায় তাদেরকে পকেটের অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। দ্বিতীয় হলো করোনায় বিপর্যয়কর চিকিৎসা খরচ।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর ইম্ফল, যা দিল্লি থেকে ২৪০০ কিলোমিটার দূরে, সেখানে ডিয়ানা খুমান্থেম তার মা ও এক বোনকে মে মাসে হারিয়েছেন। তাদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে এই পরিবারটির সব সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। তার বোনকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। সেখানে যখন তিনি মারা যান, তখন হাসপাতালের বিল আসে প্রায় ৫ হাজার ডলার। এই বিল পরিশোধ না করা পর্যন্ত মৃতদেহের সৎকার করতে লাশ হাসপাতাল থেকে নিতে দেয়া হচ্ছিল না। ফলে ডিয়ানা তাদের পারিবারিক স্বর্ণালংকার বিক্রি করে দেন ও দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে হাত পাতেন। তাতেও যখন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিলেন না, তখন তিনি বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও বোনের সহকর্মীদের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেন। এখনও তিনি এক হাজার ডলারের মতো ঋণী।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর