আবারো কৌশলী পথে এগোতে চাইছে চীন। 'দ্য ডিপ্লোম্যাট' জানাচ্ছে , দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে সাহায্য প্রদান এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের রাস্তা দেখিয়ে প্রতিবেশীদের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চাইছে শি জিংপিং এর দেশ । ২৭ এপ্রিল চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই কর্তৃক আয়োজিত ভার্চুয়াল বৈঠকে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার (ভারত, ভুটান এবং মালদ্বীপ বাদে) পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। চীনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উপরে উল্লিখিত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা ৯ জুলাই চেংদুতে একত্রিত হয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরী করে , যার লক্ষ্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে কোভিড -১৯ টিকা প্রদান এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য কাজ করা। এই প্ল্যাটফর্ম তৈরির উদ্দেশ্য, ভ্যাকসিন বিতরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা । পাশাপাশি দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সমবায় উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জীবিকার উন্নতি সাধন করা। এই ধরনের সমস্যাগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্ব প্রয়োজন, যা ইঙ্গিত করে যে চীন দীর্ঘমেয়াদে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে জড়িত থাকতে চায়। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এই ধরণের চীনা কৌশল গণমাধ্যমগুলোও টের পায়নি। অবশ্য দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে চীনের আগ্রহ নতুন নয়। দক্ষিণ এশিয়ার ওপর চীনের বাড়তি নজর দেয়ার নানা কারণ আছে, বিশেষত বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে । প্রথমত, ভৌগোলিকগত কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান পূর্ব এশিয়া এবং তেল সমৃদ্ধ মধ্য প্রাচ্যের মধ্যে । চীনের বাণিজ্য ও অর্থনীতি মূলত মালাক্কা প্রণালী এবং ভারত মহাসাগরের ওপর বিস্তৃত সমুদ্রপথের উপর নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে চীনকে অবশ্যই ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার উপস্থিতি বাড়াতে হবে, যা এখনও পর্যন্ত ভারত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ (আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা) চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভস (বিআরআই) -এর পার্টি হয়ে উঠেছে এই প্রত্যাশা নিয়ে যে, এটি তাদের উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে ।
চীন তাই ক্রমাগত এই দেশগুলোর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজের কৌশলগত স্থান বজায় রাখতে চায়। এটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক কারণ, বিআরআই এই দেশগুলোতে একাডেমিক এবং মিডিয়ার নজরে রয়েছে। যখন ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোতে তার কোভিড -১৯ vaccine ভ্যাকসিন রপ্তানি স্থগিত করেছিল , তখন চীন তাদের কাছে নিজেকে একটি পরোপকারী প্রতিবেশী হিসাবে প্রতিপন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। কৌশলগতভাবে, এটি চীনকে তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে এবং নিজেকে একটি দায়িত্বশীল শক্তিধর দেশ হিসাবে তুলে ধরতে সহায়তা করেছে। সেই সঙ্গে এই দেশগুলোর কাছে ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কমানোর সহায়ক হয়েছে। তৃতীয়, গালওয়ান উপত্যকায় সহিংস সীমান্ত সংঘর্ষ এবং ভারতে চীনাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষুন্ন হবার বিরোধের পর থেকে ২০২১ -তে চীন-ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও অবনতি হয়েছে। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে, ভারত মার্কিন নেতৃত্বাধীন চতুর্ভুজ (অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)- এর সাথে একটি শক্তিশালী জোট গঠনে এগিয়ে যায়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল এবং মার্কিন নৌবাহিনীর সঙ্গে তার নিয়মিত সামরিক মহড়ায় ভারতের সমর্থন ইঙ্গিত দেয় যে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকছে। যেহেতু ভারত বহিরাগত ভারসাম্য বজায় রাখতে উদ্যোগী হয়েছে এবং এইভাবে তার আশেপাশের এলাকা থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে , সেই সুযোগে চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে এবং বিকল্প আঞ্চলিক গোষ্ঠী তৈরি করে এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব খর্ব করতে কৌশল অবলম্বন করছে ।অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন, একটি দিল্লি-ভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক চীনের এই স্ট্রাটেজি তুলে ধরেছে । চীন ২০০৫ সালে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) একটি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হয়ে ওঠে এবং তারপর থেকে এটি আঞ্চলিক সংগঠনের পূর্ণ সদস্য হওয়ার জন্য জোর দিচ্ছে। সার্ক উন্নয়ন তহবিলে চীন ৩ লক্ষ ডলার অনুদানও দিয়েছে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক ফোরামে চীনের সদস্যপদ নিয়ে ভারতের দীর্ঘ এবং ক্রমাগত আপত্তি চীনকে পূর্ণ সদস্য হতে বাধা দিচ্ছে ।একদিকে ভারত সার্ক-এ চীনের সদস্যপদে বাধা দিচ্ছে, অন্যদিকে নয়াদিল্লি নিজেই সার্ক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে অনিচ্ছুক। আর্নস্ট হাস যাকে 'টার্বুলেন্ট নন গ্রোথ ' বলে বর্ণনা করেছেন। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন, যা প্রতি দুই বছরে হওয়ার কথা ছিল, ২০১৪ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হয়নি, মূলত পাকিস্তানের সম্মেলন আয়োজনে ভারতের বিরোধিতার কারণে। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সীমান্তে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ করে আসছে এবং কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার কোনো প্রচেষ্টা ছাড়েনি, ইসলামাবাদকে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করার জন্য দায়ী করা হয়েছে । ভারত এবং পাকিস্তানের এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কারণে সার্ক প্রক্রিয়া ক্রমাগত বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে । সার্ক প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ায়, ভারতের প্রতিবেশীরা এখন অন্যান্য পথের সন্ধান করছে । যা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে চীনের আধিপত্য বিস্তারের জন্য উর্বর ভূমি তৈরি করে দিচ্ছে ।সার্ক ব্যতীত, বে অফ বেঙ্গল মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) নাম দিয়ে আরেকটি আঞ্চলিক সংগঠন ১৯৯৭ সালে গঠন করা হয়েছিল। যার উদ্দেশ্য বিমসটেক বা তার সদস্য দেশগুলোর (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মায়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড) উন্নতিসাধন করা। যদিও সার্কের একটি "বিকল্প" হিসাবে 'বিমসটেক' তৈরি করা হয়েছিল, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় উন্ননয়নে এর উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব দেখা যায়নি । মনে করা হচ্ছে এই পরিস্থিতিতে ভারতে বাদ দিয়ে চীনের "মাইনাস-ইন্ডিয়া" উদ্যোগটি দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যমান আঞ্চলিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এমনকি যখন সার্ক এবং বিমসটেক প্রক্রিয়া একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হচ্ছে, এই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ চীনের নতুন প্ল্যাটফর্ম-এ যুক্ত হতে পারে । সেটি যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে চীন এবং ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হতে পারে। চীন-পাকিস্তান বন্ধুত্ব ভারতের জন্য এই অঞ্চলে তার প্রভাব বজায় রাখাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।প্রকল্পটি একটি প্রতীকী অর্থ বহন করে। মনে হচ্ছে চীন এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল। প্রথমত, এটি সার্কে চীনের সদস্যপদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান সম্পর্কে ভারতের কাছে একটি বার্তা, এবং ভারতের নিকটবর্তী এলাকায় একটি সমান্তরাল সংগঠন তৈরী করে নিজের ক্ষমতা তুলে ধরা। চীন উঠেপড়ে লেগেছে এই প্রমাণ করতে যে, দক্ষিণ এশিয়া আর ভারতের প্রভাবের ক্ষেত্র নয়। দ্বিতীয়ত দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরী করে পশ্চিমের দেশগুলির কাছে নিজের ভাবমূর্তি তুলে ধরাও আরেকটি কৌশল চীনাদের। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সমালোচকদের মুখের ওপর জবাব দিয়ে চীন দেখতে চায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতার ক্ষেত্রে চীন এখনও একটি আকর্ষণীয় অফার নিয়ে হাজির রয়েছে । এই পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতকে নিজেদের অধিকার কায়েম রাখতে সার্ক এবং বিমসটেক প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার পরামর্শ দিচ্ছেন কূটনীতিবিদরা। সেই সঙ্গে তারা মনে করেন , পশ্চিমা শক্তিগুলো, বিশেষ করে জি-7 দেশগুলোরও উচিত, সম্প্রতি সমাপ্ত জি-7 শীর্ষ সম্মেলনে ঘোষিত অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের প্রক্রিয়াগুলো ত্বরান্বিত করা।