নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্যে পৃথিবীতে মানুষ আসে, আবার চলেও যায়। এটাই তো নিয়ম। এটাই তো হবার কথা, সবার ক্ষেত্রে এটাই তো হয়, হচ্ছে বা হবেও। তারপরও কিছু মানুষের চলে যাওয়া আমাদের বড্ড কাতর করে তুলে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে এসেও পৃথিবীর কিছু মানুষ অম্লান হয় আপন কর্মে, মানবিকতার ধর্মে৷ ধরনীর বুকে আসা যাওয়ার এই গল্পে অনন্য হয়ে থাকা এমন মানুষের সংখ্যা সমাজে খুবই সামান্য।
সমাজের সেই গুঁটিকয়েক অনন্যাদের মধ্যে তেমনই একজন ছিলেন প্রফেসর হাবিবা আক্তার শিল্পী।
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবা ছিলেন আপন আলোয় আলোকিত প্রজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
হবিগঞ্জের লাখাইয়ে জন্ম এই শিক্ষকের স্বামী একই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ফরিদ আহমদ। মানুষ গড়ার কারিগর গুণী এই দম্পতির একমাত্র মেয়ে সামা আক্তার গাজীপুর মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়নরত।
১৯৯৬ সালে শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজে চাকুরী জীবন শুরু করলেও মাত্র কয়েকমাসের ভেতরেই বদলী হয়ে চলে আসেন স্বপ্নের এমসি কলেজে। এই কলেজ থেকেই কৃতিত্বের সাথে অনার্স পাশ করেছিলেন তিনি। যেকারণে শিক্ষক হিসেবে সবুজ এই ক্যাম্পাসে ফেরার ব্যাকুলতাও ছিল প্রবল।
দীর্ঘদিন কলেজের একমাত্র ছাত্রী হোস্টেলের হল সুপার হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করা হাবিবা ছিলেন পরিপূর্ণ মানবিক গুণেপুষ্ট একজন অনুপ্রেরণার বাতিঘর। একজন অভিভাবক। একজন বন্ধু।
এমসি কলেজের দর্শন বিভাগ কর্মক্ষেত্র হলেও তার অসাধারণসব গুণের দরুন জায়গা করে নিয়েছিলেন, কলেজের সবকটি আঙিনার প্রত্যেকটা মানুষের হৃদয়ে। উপস্থাপনায় ছিলেন বরাবরই অনন্যা। মাইক হাতে শতবর্ষী কলেজটির অধিকাংশ অনুষ্ঠানের প্রাণবন্ত সঞ্চালনাতেই দেখা মিলতো তার। সাহিত্যের প্রতি অগাধ পাণ্ডিত্যে ভরা গুণী এই শিক্ষকের লেখনী বরাবরই মুগ্ধ করতো। ছিলেন আপাদমস্তক একজন ধার্মিক। কথা বলতেন কোমল সুরে। শ্রেণীকক্ষের বাইরে গিয়েও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। যেকারো কথাই মনযোগ দিয়ে শুনতেন।
শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধু সবকিছুর সমন্বয়ে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেয়েছিলেন। সহকর্মী, শিক্ষার্থীদের সাথে তার চমৎকার সম্পর্ক ছিল।
কখনও কঠিন চাহনি দিয়ে কড়া শাসন, আবার কখনও উদার আকাশের মতো দু'হাত ছড়ানো মমতার কোমল পরশ। তার সুবিশাল ছায়ায় বেড়ে উঠেছে অগণিত শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের সিঁড়ি। তৈরি হয়েছে বর্তমান আর ভবিষ্যতে পথচলার মসৃণ রাজপথ।
উপরের লেখাগুলোতে বর্ণনা করা আলোর এই বাতিঘর এখন আর আমাদের মাঝে নেই। বিধাতার আহবানে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন, দুরে, অনেক দুরে৷ না ফেরার দেশে পাড়ি দেওয়া আমার এই ক্যাম্পসী জননী আর পা রাখবেন না এমসি কলেজের সবুজ আঙিনায়। খানিকটা অমনোযোগী হলে চোখ রাঙানো শাসন করবেন না। কোমলসুরে আর বলবেন না, বাবা মুখটা শুঁকিয়ে গেছে, দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নি বোধহয়, অফিসে চলো ' সিঙ্গারা আছে, ম্যাম আর তুমি আজ একসাথে খাবো'।
শিক্ষকতা মহান পেশা। কিন্তু কর্পোরেট এই সময়ে সবাই এর মহানত্তটা ধরে রাখতে পারেন না৷ শিক্ষক অনেকেই হতে পারেন, কিন্তু সবাই শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক হতে পারেন না। বর্তমানে খুব কম সংখ্যক শিক্ষকই আছেন, শিক্ষার্থীদের ভাষা যারা বুঝতে পারেন৷ মিশতে পারেন বন্ধুর মতো। প্রফেসর হাবিবা ছিলেন সেই অল্প সংখ্যক মানুষ গড়ার কারিগরদের একজন।
গেল ২০ জুলাই করোনা যুদ্ধে হেরে গিয়ে প্রেরণার এই বাতিঘর চলে গেছেন প্রভুর সান্নিধ্যে।
প্রাণঘাতি করোনা একদিন ঠিকই দুর হবে, ক্যাম্পাস খুলবে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। তবে মাইক হাতে আর হাবিবা আক্তার আসবেন না, প্রিয় শ্রোতা বলে নির্মল হাসি দিয়ে করবেন না শৈল্পিক উপস্থাপনা। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হবে পুরো ক্যাম্পাস, ক্লাস হবে। তবে হাবিবা আক্তারের পদচিহ্ন আর পড়বে না। সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেল। আমার ম্যাম নেই, এটাও বিশ্বাস করতে হচ্ছে!
অসাধারণ মানুষের কাতারে থাকলেও অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্থ হাবিবা আক্তার অন্যদের কাছে আদর্শের প্রতীক হয়েই থাকবেন।
হাবিবা আক্তারের মতো শিক্ষকদের দেহের বিদায় ঘটলেও অগণিত সন্তানদের মনোজগতে এই আলোকবর্তিতারা প্রকটভাবে আজীবন বসবাস করেন মমতার এই ভূবনে, আদর্শিকতার উদাহারণে।
অপেক্ষার অষ্টপ্রহর জুড়ে এখন কেবলই ক্যাম্পাস জননীর স্মৃতির আনাগোনা। আর নৈপথ্যে বাজে দীর্ঘস্বাশের করুন সাঁতকাহন।