পৃথিবীতে যদি কোন স্বর্গ থাকে, এটিই সেটি, এটিই সেটি! পারস্য ভাষার বিখ্যাত ভারতীয় কবি আমির খসরু এভাবেই তার কবিতার মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীরের সৌন্দর্য্য বর্ণনা করেছিলেন। ভারতের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মানুষ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এ সবকিছুর হৃদয় বলা চলে জম্মু-কাশ্মীরকে। অঞ্চলটি ভারতের শতবর্ষ পুরনো সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা, ঐতিহ্য, স্থাপনা এবং শিল্পের ঐতিহ্য বহন করছে। পাশাপাশি পর্বত, সবুজ পাহাড় ও পাথরের অদ্ভুত সংমিশ্রণে ঘেরা এ জায়গাটি। এরকম রাজনৈতিক বৈচিত্রতার কারণে অঞ্চলটি পরিবেশগত তথ্যের রীতিমতো খনি হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতো বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য্য সত্ত্বেও জম্মু কাশ্মীরের পর্যটন সম্ভাবনা পুরোপুরি ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলা। আরেকটি বড় কারণ পর্যটন গন্তব্য হিসেবে এর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রচার-প্রচারণা না থাকা।
অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, ‘জম্মু কাশ্মীরের জিডিপির ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। তবে সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো পর্যটক সংখ্যার দিক থেকে জম্মু কাশ্মীর দেশের সেরা ১০ স্থানের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারেনি।
যদিও জম্মু কাশ্মীর উপত্যকা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে কাশ্মীর উপত্যকা প্রাথমিক পর্যটক গন্তব্য হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দাল লেক ও গুলমার্গ একটি আন্তর্জাতিক পর্যটক গন্তব্য হয়ে উঠেছে। এর আগে পর্যন্ত কাশ্মীর উপত্যকায় পর্যটক সংখ্যার দিক থেকে কোনো তুলনা হতো না। ১৯৪৭ সালের পর থেকে কাশ্মীর উপত্যকার পর্যটন খাত প্রচুর মনোযোগ পায়। কিন্তু ১৯৮৯ সাল থেকে চলমান সহিংসতার কারণে কাশ্মীর উপত্যকায় পর্যটক প্রবাহ প্রভাবিত হয়। পুরো বিশ্ব থেকে পর্যটক আকৃষ্ট করা গুলমার্গও এসব হামলার কারণে প্রভাবিত হয়।
পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনার পরও জম্মু অঞ্চল কখনো আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠতে পারেনি।
গত দুই দশকে জম্মু অঞ্চলে স্থানীয় তীর্থযাত্রী পর্যটকদের ব্যাপক সমাগম দেখা যায়। এই তীর্থযাত্রীদের মূল গন্তব্য মাতা বিষ্ণু দেবির মন্দির, যা বর্তমানে বিখ্যাত অমরনাথ যাত্রায় পরিণত হয়েছে। চৌদ্দ রাজৌরি এবং পুঞ্চ জেলায় প্রচুর সুফি মাজার এবং শিখ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মাজার রয়েছে। শাহদারা শরীফ (রাজৌরির কাছেই), ছোট মিয়া (মেন্ধার) এবং বুধা অমরনাথ,সাই মিরান এবং নানগালি সাহেব এই মাজারগুলি শুধুমাত্র পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ নয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রেও অনুপ্রেরণা দেয়। এর মধ্যে শাহদারা শরীফ মাজার দেখতে গোটা দেশ থেকেই পর্যটক আসে।
অবশ্য নতুন সৃষ্ট ইউনিয়ন টেরিটরি অব জম্মু কাশ্মীরে স্থানীয় এবং পর্যটকদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিসহ শ্রমশক্তির উন্নয়ন ঘটাতে ভারতীয় সরকার নিজেদের প্রচেষ্টা আরো বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন পর্যটন ও সংস্কৃতি বিষয়ক ইউনিয়ন মন্ত্রী প্রহলাদ সিং প্যাটেল। তিনি আরো জানিয়েছেন, উপত্যকায় পর্যটন উন্নয়নে স্থানীয়দের সঙ্গে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। 'বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট স্কিমের’ আওতায় পর্যটকদের খাবার ও আশ্রয় দানকারী স্থানীয়দের পারিশ্রমিক দেয়ার কথা জানিয়েছে সরকার।
জম্মু ও কাশ্মীর সত্যিকার অর্থেই ভারতের হৃদয়। বর্তমানে ভারতের অস্থিতিশীলতার সময়ে জম্মু ও কাশ্মীর সান্তনার জায়গা হয়ে উঠেছে, যেখানে প্রবল ঝড়ের মধ্যে মানুষ শান্তি পেয়েছিল। কোভিড সংক্রমণ কমে আসায় অঞ্চলটিতে পর্যটক আবার বাড়তে শুরু করেছে। আর এ কারণে কাশ্মীরে পর্যটন ও ভ্রমণ নিয়ে পুনরায় চিন্তা করার আহ্বান উঠছে। অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া নতুন উদ্ভাবনমূলক পদ্ধতির মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প খাত পুনরুজ্জীবিত করতে রাষ্ট্রকে আরো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জম্মু ও কাশ্মীরের ঐতিহ্য প্রচারে কিছু উদ্ভাবনী উপায় বের করতে হবে যাতে করে এর সমৃদ্ধ সমকালীন সংস্কৃতি সবার কাছে পৌঁছুতে পারে।
জম্মু-কাশ্মীরের পর্যটন পুরোটাই প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি এ অঞ্চলটি থেকে অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হওয়া যায়। পর্যটনের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের যেমন আয়ের পথ খুলবে তেমনি সরকারের কোষাগারও ভারী হবে। কারণ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সফরের ফলে আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস খুলে যাবে। পর্যটকদের ব্যয় সরকারি ও বেসরকারি খাতের আয় বৃদ্ধি করবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
সূত্র: ইয়াহু নিউজ