সন্ধ্যা নামলেই বদলে যায় সিলেটের পরিবেশ। দিনের কোলাহল ভেঙে যখন নীরব হয় শহর, তখন কেবল চোখে ভাসে এম্বুলেন্সের দৌড়ঝাঁপ। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটছেন রোগীরা। সাইরেনের শব্দে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। একটু পর পর ছুটে যায় এম্বুলেন্স। হাসপাতালের বারান্দা থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালের ভেতরে জায়গা নেই। আইসিইউ সংকট তীব্র।
অক্সিজেন সংবলিত বেডও খুঁজে পাওয়া যায় না। এ কারণে বেড়েই চলেছে মৃত্যুর মিছিল। হাসপাতালের ভেতর ও বাইরে চলছে সমান আর্তনাদ। এদিকে লকডাউনের শেষদিকে এসে অনেকটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে সিলেট। জীবিকার তাগিদে মানুষ বের হচ্ছে রাস্তায়। স্বল্প পরিসরে জীবিকা সচল রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। লকডাউনেও সিলেটের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না। ঈদের পর আশঙ্কাজনক হারে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার কারণে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হয়নি সিলেটের মানুষ। কিন্তু রোববার থেকে শহরে যানবাহন ও মানুষ চলাচল বেড়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে- সিলেটে করোনা সংক্রমণের হার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। নমুনা পরীক্ষার অর্ধেকেই হচ্ছেন শনাক্ত। গতকাল সোমবারও সিলেটে সংক্রমণের হার ছিল ৪৬ শতাংশ। মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। শনাক্তও ৮৫৩ জন। পরিসংখ্যান কোনো ভাবেই স্বস্তি দিচ্ছে না সিলেটে। মৃত্যু ও শনাক্তের হার একই মাত্রায় থাকলে ৫ই আগস্ট লকডাউন শেষ হয়ে গেলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে সিলেটে। এ নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারাও কোনো সুখবর দিতে পারছেন না। কারণ হচ্ছে- এখন আক্রান্ত ও শনাক্তদের মধ্যে গ্রামের মানুষই বেশি। গ্রামে গ্রামে চলছে করোনার তাণ্ডব। প্রতিটি উপজেলায়ও বেড়েছে মৃত্যু। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, করোনায় যে মানুষ মারা যাচ্ছে সিলেটে তারচেয়ে দ্বিগুণ মানুষ মারা যাচ্ছে উপসর্গ নিয়ে। সিলেটে সংকুচিত হয়ে এসেছে চিকিৎসাসেবা। আইসিইউ বেড যেনো সোনার হরিণ। সিলেটে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় দেড়শ’ মানুষ আইসিইউতে আছেন। কিন্তু সিরিয়ালে আছে আরও প্রায় ৩০০ রোগী। হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে আইসিইউর জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন এসব রোগীরা। নতুন করে যাদের আইসিইউর প্রয়োজন হচ্ছে তাদের সহসাই আইসিইউ সাপোর্ট দেয়ার সুযোগ নেই। সরকারি, বেসরকারি সব কোভিড হাসপাতালও রোগীতে ভর্তি। রোববার সন্ধ্যা রাতে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনেই আশঙ্কাজনক রোগী নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ১০-১২টি এম্বুলেন্স। অনেকেই উপসর্গ নিয়ে আবার কেউ কেউ করোনা আক্রান্ত হয়ে এসেছেন। সব রোগীরই বয়স ষাটের উপরে। আব্দুস সোবহান নামের জগন্নাথপুরের এক রোগীর স্বজন জানিয়েছেন, তার চাচাকে নিয়ে এসেছেন। তিনি করোনা আক্রান্ত নয়। সকালে এসে এম্বুলেন্সে অক্সিজেন সাপোর্টে রেখে নমুনা দিয়েছেন। রোগীর শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। কোথাও ভর্তির সুযোগ না পেয়ে শেষমেশ ওসমানীতে এসেছেন। কিন্তু ওসমানীতে নতুন রোগী ভর্তির জায়গা নেই। এ কারণে অনেককেই ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। একই অবস্থা ছিল করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালেও। ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে এবং পাশের রাস্তায় রোগী নিয়ে দাঁড়িয়েছিল কয়েকটি এম্বুলেন্স। গাড়িতেই অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে রোগীদের রেখে স্বজনরা একটি বেডের জন্য তদবির করছেন। কিন্তু বেড পাচ্ছেন না। সাজনা বেগম নামের মৌলভীবাজারের এক রোগীর স্বজন জানিয়েছেন, তার রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন। এ কারণে সিলেটে নিয়ে এসেছেন। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরছেন। কিন্তু কোথাও মিলছে না আইসিইউ। অথচ তার রোগীর শ্বাসকষ্ট বেড়েই চলেছে। রাতে নগরীর রাগিব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মাউন্ট এডোরা হাসপাতাল, উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এম্বুলেন্সের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। সুবহানীঘাট এলাকার আল হারমাইন, ওয়েসিস, ইবনে সিনার সামনেও সমানভাবে ভিড় ছিল এম্বুলেন্সের। ভর্তির জন্য এম্বুলেন্সে রোগী নিয়ে এসেছেন স্বজনরা। কিন্তু ভর্তির কোনো সুযোগই পাচ্ছেন না। চিকিৎসার এই সংকটে সিলেটে বেড়েছে হতাশা। নতুন করে চিকিৎসা পরিধি বাড়ানোর সুযোগও নেই। ফলে চিকিৎসা না পেয়ে রোগী মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তীব্র চাপ রোগীর। জায়গা বাড়াতে গতকাল থেকে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে করোনা রোগী ভর্তি শুরু করেছেন। আরও ৫৫ বেড বাড়ার ফলে এখন ওসমানীতে ৩০০’র উপরে করোনা রোগী রয়েছেন। ৮টি থেকে বাড়িয়ে ১০টি করা হয়েছে আইসিইউ বেড। শয্যা বাড়ালেও রোগী কমছে না বলে জানান তিনি। সিলেটের রাগিব বাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আরমান আহমদ শিপলু জানিয়েছেন, তাদের হাসপাতালে সব আইসিইউ বেডই কোভিড। এখন কোভিড রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এরপরও রোগীদের জায়গা দেয়া যাচ্ছে না। সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. এমদাদ হোসেন জানিয়েছেন, তারা তিনটি ফ্লোর করোনার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। একটি আইসিইউ ওয়ার্ড ছেড়ে দিয়েছেন। প্রায় অর্ধেক জায়গা করোনার জন্য বরাদ্দ করেও রোগীর চাপ সামলানো সম্ভব হচ্ছে না। ধীরে ধীরে তারা চিকিৎসার পরিধি বাড়াচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। সিলেটের নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সব আইসিইউই এখন কোভিড। এ ছাড়া হাসপাতালের ৭০ ভাগ ওয়ার্ড ও কেবিন করোনা রোগীদের জন্য বরাদ্দ দিয়েও তারা জায়গা করতে পারছেন না। সিলেটের বেসরকারি মেডিকেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মো. নাসিম আহমদ জানিয়েছেন, সিলেটে প্রায় সব বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর ৬০-৭০ শতাংশ স্থান করোনা রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। অক্সিজেন প্রাপ্তিতে শঙ্কা থাকার পরও সাহস করে আমরা রোগী ভর্তি করছি। কিন্তু দিনে দিনে রোগী বাড়ার কারণে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
গতকাল মৃত্যু ১৪, শনাক্ত ৮৫৩: মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সিলেটে গতকাল ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে শনাক্ত হয়েছেন আরও ৮৫৩ জন। মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে ওসমানী হাসপাতালে ৪ জনসহ সিলেট জেলায় ১০ জন, সুনামগঞ্জে ১ জন, মৌলভীবাজারে ১ জন ও হবিগঞ্জ জেলায় ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে বিভাগে করোনায় মৃতের সংখ্যা এখন ৭১৬ জন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৫৭১ জনই মারা গেছেন সিলেট জেলায়। বাকিদের মধ্যে সুনামগঞ্জে ৫২ জন, মৌলভীবাজারে ৬১ জন ও হবিগঞ্জে ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সিলেট বিভাগে নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৮৫৩ জন। তাদের মধ্যে সিলেট জেলায় ৪৭৯ জন শনাক্ত হয়েছেন। সুনামগঞ্জে ১০৭ জন, মৌলভীবাজারে ১৯০ জন ও হবিগঞ্জে ৭৭ জন রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। ১ হাজার ৯৫৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে তাদেরকে শনাক্ত করা হয়েছে।