× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

একটি ধর্ষণের ঘটনা ও বিয়ে...

শেষের পাতা

মাহবুব খান বাবুল, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে
৫ আগস্ট ২০২১, বৃহস্পতিবার
ফাইল ছবি

১৩ বছর আগের কথা। সরাইলের পল্লী এলাকা পাকশিমুল ইউনিয়নের বড়ইচড়া গ্রামে বেড়ে ওঠা মেয়েটির বয়স তখন ২০ বছর। দরিদ্র পিতা-মাতা বিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েটিকে। টিকেনি দাম্পত্য জীবন। ২-৩ বছর পরই ভেঙে যায় সংসার। মারা যান পিতামাতা। কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে মেয়েটি। ছোট দু’চালা একটি টিনের ঘরে কোনোরকমে জীবন যাপন করছে।
মানুষের মালপত্র মাথায় বা হাতে করে স্থানান্তর ও ঘরের কাজ করেই চলছিল তার জীবন। এতিম ওই মেয়েটির (৩৩) উপর কুনজর পড়ে একই গ্রামের রহমত আলীর ছেলে ৩ সন্তানের জনক নূর আলীর (৪৮)। ঘরে স্ত্রী রেখেও নূর আলী পিছু নেয় মেয়েটির। নানান চলচাতুরি করে। বিয়ের প্রলোভনে এক সময় মেয়েটিকে ধর্ষণ করে নূর আলী। এক সময় মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে যায়। সটকে পড়ে ধর্ষক নূর আলী। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় মেয়েটি। মেডিকেল রিপোর্টে দেখা যায় মেয়েটির গর্ভের বাচ্চার বয়স ৫ মাসের বেশি। মেয়েটি বলে, আমার পেটের বাচ্চাটি নূর আলীর। বাচ্চা আসার আগে আমাকে বলেছে তোরে বিয়ে করুম। এখন পালিয়ে গেছে। বিয়ে করছে না। তাই ভাইকে বিষয়টি জানায় ধর্ষিতা। আইনি সহায়তা নেয়ার চেষ্টা করে ভাই-বোন। কিন্তু পারেনি। নূর আলীকে বাঁচাতে ওঠে পড়ে লেগে যায় একটি মহল। অতীতেও তারা এমনটি করে নূর আলীকে অপকর্ম করতে সাহস জুগিয়েছিল। এবারও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। তারা অর্থ ও জায়গার লোভ দেখিয়ে মেয়েটির গর্ভের বাচ্চাটি নষ্ট করার প্রস্তাব দেয়। গত সোমবার থানায় আসার কথা থাকলেও তারা আসতে পারেননি। প্রভাবশালী এক জনপ্রতিনিধির লোকজন তাদেরকে আটকিয়ে সরাইল সদরের পাঠান পাড়ায় এক বাড়িতে সভায় বসেন। দীর্ঘ সময় তাদের বিভিন্ন লোভ-লালসা দেখিয়ে গ্রাম্য সালিশ-বৈঠকের মাধ্যমে ঘটনাটি নিষ্পত্তি করতে রাজি করায়। পরে থানায় না এসে তারা চলে যায় গ্রামে। এর প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বড়ইচড়া গ্রামের আবু তালেবের ছেলে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সোহেল (২৭) ও ব্যবসায়ী হেলেম মিয়ার (৪৮) উদ্যোগে সাবেক ইউপি সদস্য জালাল উদ্দিনের বাড়িতে বসে সালিশ সভা। সভায় আবদুল খালেকের ছেলে বাচ্চু (৩৯) ও আজগর আলী মাস্টারসহ আরও কয়েকজন সর্দার উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় প্রথমেই মেয়েটির ইজ্জতের প্রাথমিক মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১০ হাজার টাকা। পরে নূর আলীর সঙ্গে মেয়েটিকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়। এটা হবে তার তৃতীয় বিয়ে। এ সভায় নূর আলীর বর্তমান প্রথম স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই গ্রামের একাধিক ব্যক্তি ও সালিশকারক বলেন, এটা চরিত্রহীন নূর আলীর ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার একটি সাজানো নাটক। কিছুদিন পর বাচ্চাটি নষ্ট করে নির্যাতনের মাধ্যমে স্বামীর সংসার ছাড়াতে মেয়েটিকে বাধ্য করা হবে। গ্রামের একাধিক সূত্র জানায়, দেড় বছর আগে আরেক বার নূর আলী জোরপূর্বক এই মেয়েটিকেই ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল। এ ঘটনায় থানায় মামলাও হয়েছিল। তখনো ওই গ্রামের এই সালিশকাররাই মেয়েটির ইজ্জতের মূল্য নির্ধারণ করেছিল ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। রাত ৮টার পর পূর্বপাড়ায় নূর আলীর প্রবেশে জারি করা হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। পূর্বপাড়ার অনেক মহিলা ধর্ষক নূর আলীর বিচার না হলে নিজের স্বামীকে ডিভোর্স দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। একই মেয়ের ইজ্জতের মূল্য এবারও নির্ধারণ হলো ১০ হাজার টাকা ও বিয়ে। গত ৩-৪ বছর আগে নূর আলী গ্রামের পূর্বপাড়ার এক মেয়েকে জোর করে ধর্ষণ করেছিল। গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ায় বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। সেটা ছিল তার দ্বিতীয় বিয়ে। বিয়ের কিছুদিন পর গর্ভের বাচ্চা ফেলে নির্যাতন করে মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। সর্দার হেলেম মিয়া ধর্ষণের ঘটনা ও রাত ২টা পর্যন্ত সালিশ করার কথা স্বীকার করে বলেন, সমস্ত গ্রামের লোকজন বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ে হবে। বাজার করতেও চলে গেছে। আগের বিষয়টি এমন নয়। নূর আলীর সঙ্গে মেয়েটির কথা কাটাকাটি হয়েছিল। মেয়েটির মাথা ভেঙে দিয়েছিল নূর আলী। আমরা বসে জরিমানা করেছিলাম ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। খরচপাতি করে ৫০ হাজার টাকা সর্দারদের কাছে আছে। মাসে হাজারখানেক টাকা মেয়েটিকে লাভ দেয়া হয়। সালিশে উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করেছেন সর্দার আলী আজগর মাস্টারও। সোহেল নামের এক ব্যক্তি কর্তৃক নূর আলীকে মাসোয়ারা দেয়ার বিষয়টিও চাউর রয়েছে গ্রামে। সালিশের আয়োজক সেই সর্দার সোহেল মিয়ার মুঠোফোনে চেষ্টা করে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে ওই গ্রামের পূর্বপাড়ার বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, গোটা গ্রাম নয়। শুধু নির্দিষ্ট একটি মহল সালিশ করেছে। আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি এ বিয়ে ঠিকবে না। নূর আলী অপকর্মের শাস্তি পায়নি। তাকে দেয়া হয়েছে প্রমোশন। দেড় বছর আগে রাত ৮টার পর নূর আলীর পূর্বপাড়ায় প্রবেশ নিষেধ ছিল। নিষেধ টিকেনি। পূর্বপাড়াই কয়েকজন তাকে ডেকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। অনেকে রশিকতা করে বলেন, নূর আলী হচ্ছে এই গ্রামের রশো খাঁ। ধর্ষিতার আপন ভাই বলেন, আমরা দুর্বল। তাই অত্যাচারিত হচ্ছি বারবার। সালিশে নূর আলীর লোকজনই রায় করেছেন। আমার কোনো লোক ছিল না। নিকাহ নিবন্ধনকারীর মাধ্যমে ৪ লাখ টাকার দেনমোহরে বিয়ে হবে। এর ব্যাতিক্রম হলে আমি মানবো না। সরাইল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. হোসনে মোবারক বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় শান্তি-শৃঙ্খলার লক্ষ্যে গ্রামবাসী বসে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ৪ লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ের আয়োজন চলছে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর