× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ফিরে দেখা /হিরোশিমা-নাগাসাকি বোমা বিস্ফোরণের নেপথ্য ইতিহাস

মত-মতান্তর

শামছুন্নাহার
৯ আগস্ট ২০২১, সোমবার

বিংশ শতাব্দীর, অন্যকথায়, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহতম ও নির্মম ঘটনা হল ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ। যা মানবসভ্যতার ইতিহাসে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের এক জ্বলন্ত উদাহরণ হিসাবে খচিত হয়ে আছে। কেন, কিভাবে ও কোন অভিপ্রায়ে এই মারণাস্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল এবং কেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কুশীলবরা তা ব্যবহার করে এই নৃশংসতার অনুঘটক হতে চেয়েছিল, তা আলোকপাত করাই এই আলোচনার মুখ্য বিষয়।

প্রাথমিকভাবে, বিজ্ঞানের কিছু সূত্রের আবিষ্কার এই বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, বিজ্ঞানের সূত্রের খাতায় যোগ হয় বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব। তিনি বলেন, পদার্থের আত্মবিলোপ ঘটলে তা শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। একে বাস্তবের কষ্টিপাথরে যাচাই করতে শুরু হয় তার অনুজ বিজ্ঞানীদের গবেষণা।যা ক্রমশ পরমানুর গঠন রহস্য ও তার অভ্যন্তরীণ শক্তি সম্বন্ধে জ্ঞাত হতে সাহায্য করে। মূলত, পরমাণু ও তার অভ্যন্তরীণ শক্তি রহস্যের এ অন্তর্ভেদের মধ্যে দিয়েই পরমাণুর বোমার বীজ রোপিত হয়।পরমাণুর গঠন রহস্য সম্পর্কে জ্ঞাত হবার ক্ষণকালের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক শক্তির সন্ধানে ব্রতী হন। এখানেও মূখ্য ভূমিকা পালন করে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব।

পরীক্ষাগতভাবে বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন পরমানুর কেন্দ্রই হলো সমস্ত শক্তির আধার। যদি এই পরমানুর কেন্দ্রে অবিরাম আঘাত হানা সম্ভবপর হয়, তবে তা থেকে প্রবল অপ্রতিরোধ্য শক্তির অবমুক্তি ঘটবে। বস্তুত, আণবিক শক্তির পূর্ণ বিকাশ ঘটে ১৯১৯ থেকে ১৯৩৮ এর মধ্যে। তবে, এ শক্তিকে যে বাস্তবে অবমুক্ত করা সম্ভব- সেটা বিজ্ঞানীদের কাছে তখনও বিশ্বাসযোগ্য ছিলনা। বিজ্ঞানীরা বললেন, পরমাণুর ঘুমন্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে এক অদৃশ্য ও অনতিক্রম্য বাঁধা, যা মানুষের পক্ষে কখনোই অতিক্রম করা সম্ভব নয়। তবে, এবিষয়ে তখনও উপসংহারে পৌছাতে রাজি ছিলেন না হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী জিলার্ড। সেলক্ষ্যে সন্ধিহান জিলার্ড সন্দেহমুক্ত হতে তার অর্জিত জ্ঞান ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের প্রদানকৃত ধারণাকে অবলম্বন করে এক গ্রাম ইউরেনিয়াম, এটম বোমা তৈরির দুটি মূল উপাদানের একটি, নিয়ে শুরু করেন তার সুচিন্তিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরীক্ষালব্ধ ফলাফল দেখে তিনি আঁতকে উঠেন। প্রবল ধীশক্তির অধিকারী জিলার্ড বুঝতে পারেন, যদি পরীক্ষিত ধাতুর পরিমান বেশি হয় তবে তা থেকে এমন এক দানবীয় শক্তির উদ্ভব হবে- যা পৃথিবীকে মুহূর্তেই গ্রাস করার ক্ষমতা রাখে। এই জিলার্ড-ই অনতিকাল পরে পরমাণুর বোমা ও তার জননী ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’ এর অগ্রণী কর্ণধারদের অন্যতম হয়েছিলেন।

এতো গেল পরমানু বোমার বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের কথা। এবার আসা যাক পরমাণু বোমার নেপথ্যের নায়ক ও এর পটভূমির বিষয়ে। বিংশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে বিজ্ঞানের জগতে যখন এক অভূতপূর্ব নিরস্ত্র বিপ্লব চলছিল, ঠিক সে সময়েই ইউরোপের রাজনীতির মঞ্চে চলছিল দখলদারিত্বের খেলা। এ প্রতিযোগীতার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী খেলোয়াড় ছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলার। দরিদ্রতার কষাঘাতে নিষ্পেষিত পরিবারের সন্তান, স্বজাতির নিপীড়ন, বঞ্চনা ও দুর্ভাগ্যের প্রত্যক্ষদর্শী হিটলার শুরু থেকেই জাতিকে তার নিজস্ব গৌরব ফিরিয়ে দিতে আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন। সেজন্য সমাজে চলমান অসংগতি ও তার কারণ খুঁজতে সদাসচেতন ও ব্যতিব্যস্ত ছিলেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে, ধীরে ধীরে তার মনে এই বদ্ধমূল ধারণার জন্ম হয় যে, ইহুদীরাই তার জাতির মর্যাদা ও উন্নতির অন্তরায়। অতঃপর, একসময়কার ইহুদীপ্রীত হিটলারের মনে ক্রমেই জন্ম নেয় তীব্র ইহুদী বিদ্বেষী মনোভাব। অবশেষে, হিটলার হয়ে উঠেন সর্বনাশের মহানায়ক। একদিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মান জাতির প্রতি কৃত অন্যায়-অবিচার ও চরম অবমাননার প্রতিশোধ নিতে এবং স্বজাতির হারানো গৌরব ফিরিয়ে দিতে উচ্চাভিলাষী হিটলারের মনে জেগে ওঠে দেশ-দখলের সীমাহীন নেশা;যার সাথে সাথেই আরম্ভ হয় পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম কালো অধ্যায়- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অপরদিকে, একই সময়ে তার ইহুদী-বিদ্বেষী প্রবৃত্তিও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠায়, শুরু হয় ইহুদী নিধনযজ্ঞ, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘হলোকাস্ট’ নামে আখ্যায়িত। তারই অংশ হিসাবে, ১৯৩৪ সালে এক মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে এবং তাকে পরবাসী হতে বাধ্য করা হয়। উপরন্তু, আধুনিক যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূতিকাগার- জার্মানির গাটেনগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদচ্যুত করা প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের; যারা ছিলেন ইহুদি। একদিকে জার্মানিতে হিটলার এবং অন্যদিকে ইতালিতে মুসোলিনি কর্তৃক নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের অনেকেই একে একে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হন। পরবর্তীতে, এই স্বদেশ-বিতাড়িত বিজ্ঞানীরাই ম্যানহাটন প্রজেক্টের যাবতীয় কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ সহযোগীতা ও পরমানু বোমা তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এবার জানা যাক, কোন প্রেক্ষাপটে ও কিভাবে পৃথিবীর প্রথম দানবীয় মারণাস্ত্র “এটম বোমা” তৈরির আঁতুড়ঘর, ম্যানহাটন প্রজেক্টের জন্ম হয়েছিল? পারমাণবিক বোমা তৈরিতে যে সমস্ত বিজ্ঞানীর সুচিন্তিত মতামত, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য তাদের মধ্যে-  আইনস্টাইন, অটোহ্যান, হাইজেনবার্গ, লিও জিলার্ড, ম্যাক্সপ্লাঙ্ক, এনরিকো ফের্মি, ওয়াইৎসেকার, ফনলে, ওপেনহেইমার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে কেবল ওপেনহেইমার আমেরিকান, বাকি সবাই ইউরোপিয়ান। আইনস্টাইন, অটোহ্যান, ওয়াইৎসেকার, ফনলে, লিও জিলার্ড, হাইজেনবার্গ ও ম্যাক্সপ্লাঙ্ক ছিলেন খোদ জার্মান। এসব বিজ্ঞানীরা শুধু পরমানু শক্তির অনুসন্ধানেই ব্রতী ছিলেন না, বরং চাইলেই হিটলারের হাতে এই মারণাস্ত্র উঠিয়ে দিতে পারতেন। উল্লেখিত বিজ্ঞানীদের অনেককেই দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়, যারা আমেরিকাতে সাদরে আমন্ত্রিত হন। এর মধ্য দিয়েই আমেরিকা যেন কুড়িয়ে পেতে শুরু করে ভবিষ্যৎ সৌভাগ্যের পরশমণি।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী লিও জিলার্ডের কথা, যিনি সর্বপ্রথম পারমানবিক শক্তি ও তা থেকে তৈরিকৃত অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক ভয়াবহতা অনুমান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হিটলার যখন ক্ষমতায় আরোহণ করেন, জিলার্ড তখন জার্মানিতে কর্মরত। হিটলারের আগ্রাসী মনোভাব অবলোকন করে তিনি বিজ্ঞানীদের একটি সভা আহ্বান করেন; এবং তাদেরকে পরমাণু শক্তির বিষয়ে অবহিতকরণ পূর্বক একথাও বলেন যে- যদি এই অস্ত্র কোনভাবে হিটলারের হস্তগত হয় তবে তা সারা পৃথিবীকে একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে। সময়টা ১৯৩৯ সালের মধ্যবর্তী। জার্মানত্যাগী বিজ্ঞান পুরোধা জিলার্ড ও ইতালিত্যাগী বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি তখন আমেরিকায় অবস্থানরত। তাঁরা দুজনেই হিটলার কর্তৃক পরমাণুবোমা হস্তগত হবার বিষয়ে চিন্তিত। তাঁরা ভাবছেন কিভাবে হিটলারকে প্রতিরোধ করা যায়। সিদ্ধান্ত নিলেন এ বিষয়ে তারা আমেরিকান সরকারকে অবগত করবেন। কিন্তু বহিরাগত হওয়ায় তাদের সাহসের সংকুলান হলোনা। অনতিবিলম্বেই তাদের মনে হলো- স্মরণকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কথা। আইনস্টাইনও তখন  আমেরিকায় বসবাসরত। তারা আইনস্টাইনকে পরমাণুর অভ্যন্তরীন শক্তি ও হিটলারের বিষয়ে অবহিত করার সাথে সাথে আমেরিকান সরকারের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। সার্বিক বিষয়াদি বিবেচনা করে, আইনস্টাইন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে উদ্দ্যেশ্য করে একটি পত্র লিখেন, যার বক্তব্য ছিল অনেকটা এরকম- “সাম্প্রতিক গবেষণায় এটা প্রমানিত হয়েছে যে, ইউরেনিয়াম পরমানুতে চক্রাকার আবর্তন সৃষ্টি করা সম্ভব; যা থেকে এযাবৎকালের সবচেয়ে শক্তিধর ও ধ্বংসাত্মক বোমা তৈরি করা যেতে পারে। জার্মানিও একই বিষয়ের উপর কাজ করছে”। বলা আবশ্যক, আইনস্টাইনের চিঠি রুজভেল্টের হাতে পৌঁছাবার ১৫ দিন আগেই জার্মানিতে “ইউরেনিয়াম প্রজেক্ট” এর কাজ শুরু হয়েছিল। যাইহোক, আইনস্টাইন নিজে নয় বরং তাঁর এক বন্ধু যার প্রেসিডেন্ট হাউজে যাতায়াত ছিল তার মারফত চিঠিটি প্রেরণ করেন। রুজভেল্ট প্রথম পর্যায়ে গুরুত্ব না দিলেও অব্যবহিতকাল পরেই আইনস্টাইনকে চিঠির মাধ্যমে আশ্বস্ত করেন যে, আমেরিকাও শীঘ্রই ইউরেনিয়াম নিয়ে কাজ করা আরম্ভ করতে যাচ্ছে। আর এলক্ষ্যে তিনি ইতোমধ্যেই সামরিক ও বেসামরিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেছেন।

এ বিষয়ের উপর গবেষণা কার্যক্রম শুরু করার জন্য সর্বপ্রথম ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৬০০০ মার্কিন ডলার প্রদান করা হয়। এভাবেই শুরু হয় পারমাণবিক বোমা তৈরির কারখানা ম্যানহাটন প্রজেক্টের অগ্রযাত্রা, যেখানে পৃথিবীর প্রথম মানব বিধ্বংসী বোমা ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’ তৈরি করা হয়েছিল।প্রজেক্টিতে মোট বিনিয়োগ করা হয় ২ বিলিয়ন ডলার (যা বর্তমানে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি) এবং নিয়োগ দেয়া হয় আনুমানিক ১,৩০,০০০ জনবল। তবে মূল ভূমিকা পালন করেন জার্মানি, ইতালি ও হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানীরা। প্রকল্পের সর্বময় ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয় ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যান্ডার্ড এর পরিচালক জেনারেল লেসলি গ্রোভস্ এর হাতে,এবং বেসামরিক কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় পদার্থ বিজ্ঞানী ওপেনহেইমারকে। গোপনীয়তা ছিল এই প্রজেক্টের প্রাণস্বরূপ। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা এবং নিয়োগপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীরা ব্যাতীত কেউই এই প্রজেক্টের ব্যাপারে জ্ঞাত ছিলেন না; এমনকি স্বয়ং ট্রুম্যানও নয়, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পূর্বেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতি সংগোপনে প্রজেক্টেরসকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ করা হয়। যেমন- প্রকল্পের সর্বময় কর্তা জেনারেল লেসলি গ্রোভস্’কে “ওভারসিজ অ্যাসাইনমেন্ট” এই শিরোনামে বদলিপত্র পাঠানো হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের প্রত্যেককে ছদ্মনাম দেয়া হয়। প্রজেক্টিকে সম্ভাব্য বর্তমান (জার্মানি, ইতালি, জাপান) ও ভবিষ্যৎ (রাশিয়া) সকল প্রতিপক্ষের দৃষ্টির অগোচরে রাখতে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। সেলক্ষ্যে ১০ টি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়; এবং সেগুলোর সামনে এমন কতকগুলোনাম দিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলানো হয় যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে ভেতরে আসলে কিসের কাজ চলছে। প্রজেক্টে নিযুক্ত প্রত্যেকের খুঁটিনাটি বিষয়াদিও গভীরভাবে তদন্ত করা হয়।যেমন- তদন্তকালীন বিজ্ঞানী ওপেনহেইমার- এর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তিনিপূর্বে কমিউনিজমের সমর্থক ছিলেন;যদিও পরবর্তীতে তিনিনিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সমর্থ হন। প্রজেক্টের কাজে গতি প্রদান করতে এক পর্যায়ে একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগারবাল্যাবরেটরিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে, এখানেও সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষার্থে, বেছে নেয়া হয় নিউ মেক্সিকোতে অবস্থিত এক জনমানবহীন প্রান্তর। নাম ‘লস অ্যালামস’। লস অ্যালামসেপরীক্ষাগারস্থাপনের পর সেখানে প্রায় ৬০০০ বিজ্ঞানীকে জড়ো করা হয়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন নোবেল বিজয়ী। এভাবে অতি গোপনীয়তার সাথেই সমস্ত কার্যক্রম চলতে থাকে। সেই সাথে, বিজ্ঞানী ওপেনহেইমার- এর পরামর্শে বিমান ও নৌ-বাহিনীকেও প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। তবে কতিপয় আর্মি জেনারেল এবং বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ব্যতীত কেউই জানতেন না যে- এই প্রজেক্ট আসলে কীসের জন্ম দিতে যাচ্ছে! অবশেষে, ১৯৪৫ সালের ৫ই জুলাই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক তিনটি বোমা প্রস্তুত হয়ে যায় এবং কার্যকারীতা যাচাইয়ের জন্য তা ১৬ই জুলাই ‘লস অ্যালামস’- এর দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত মরুভূমি ‘অ্যালোমগর্ডো’তে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যা ইতিহাসে “ট্রিনিটি টেস্ট” নামে আখ্যায়িত। বোমা দু’টির বিস্ফোরণে ‘অ্যালোমগর্ডো’র আকাশ-বাতাস যেন ঝলসে গিয়েছিল! সেদিনের সেই ভয়াবহতা উপস্থিত সকলেই প্রত্যক্ষ করে। অথচ, ট্রিনিটি টেস্টের মাত্র ২৬ ও ২৯ দিনের মাথায় আমেরিকা জাপানের উপর সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক সেই মারণবোমারই বিস্ফোরণঘটায়এবং তাকে পঙ্গু করে দেয়। এখানেই প্রশ্নজন্ম নেয়, যে- কেন অস্ত্র হিসাবে পারমাণবিক বোমাকেই বেছে নেয়া হয় এবং কেনইবা জাপানকে টার্গেট করা হয়?

কেন অস্ত্র হিসাবে পারমাণবিক বোমার মত এত ধ্বংসাত্মক অস্ত্রকে বেছে নেওয়া হয়- তার সম্ভাব্য কারণ কয়েকটি হতে পারে। এক, হিটলারের জার্মানিসহ অক্ষশক্তির অন্যান্য সকল দেশকে চিরকালের মতো পরাভূত করা। দুই, কমিউনিজমের ভবিষ্যৎ বিস্তৃতি ও তার কর্ণধার রাশিয়াকে ঠেকানো। এবং তিন, যুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের পূর্বাভাস দেয়া। কিছু কিছু ঘটনা থেকে এর স্বপক্ষে প্রমাণও পাওয়া যায়। যেমন-

এক, ১৯৪২ সালে আমারিকার গোয়েন্দা বিভাগ এই তথ্য প্রদান করে যে- ২৫’শে ডিসেম্বর বড়দিন উৎসবের প্রাক্কালে জার্মানি আমেরিকায় এটমবোমাদ্বারাআঘাত হানতে পারে। অতএব, বিষয়টি যাচাই করতে আমেরিকান প্রশাসন এক বছরের মধ্যে জার্মানিতে ‘এ্যালসস্ মিশন’ নামে বিশেষজ্ঞদের একটি দল প্রেরণ করে। এই দলটি সূক্ষ্মভাবে সংশ্লিষ্ট সার্বিক বিষয়াদি বিচার-বিবেচনা ও গভীর তদন্ত করার পর বুঝতে পারে যে জার্মানির এটম বোমাবানানোর বিষয়টি একটি গুজব বই আর কিছু নয়। কারণ, এটম বোমা বানানোর মত জ্ঞান, প্রযুক্তি, বা লোকবল (নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট)- কোনটাই তখন জার্মানির কাছে ছিলনা। যাইহোক, পরবর্তীতে ‘এ্যালসস্ মিশন’- এর দেয়া এই তথ্যই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছিলো।

দুই, ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় কমিউনিজমের উদ্ভবহবার পর থেকে তা সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অপরদিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অপমানজনক পরাজয়ের পর জার্মানি আল্ট্রা-ন্যাশনালিস্ট বা অতি-জাতীয়বাদী হয়ে উঠে। এবং তৎকালীন সময়ে ইতালি ও জাপান সাম্রাজ্যবাদী নীতি অবলম্বন করে। তখন ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ফ্রান্স বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে নীরব দর্শক মাত্র। ব্রিটেনসেসময়বরং,রাশিয়ার কমিউনিস্টপন্থি সাম্রাজ্যবাদ রুখতে বদ্ধপরিকর হওয়ারকারণে, জার্মানিকেই পরিতুষ্ট রাখার নীতি গ্রহণ করেছে।এমনকি,১৯৩৬ সালে, জাপান যখন মাঞ্চুরিয়া দখল করার মাধ্যমে চীন’কে আক্রমন করে বসে ব্রিটেন তখনওনীরব দর্শকের কাতারেই উপবিষ্ট। ব্রিটেন প্রথমবারের মত নড়েচড়ে বসে যখন জাপান ভারতীয় উপমহাদেশেরঅবস্থিত ব্রিটিশ উপনিবেশ আক্রমন করে। বিশ্বরাজনীতিতে যখন এরূপ নাজুক, বিশৃঙ্খল ও উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে তখন আমেরিকায় পারমাণবিক বোমা ভূমিষ্ঠ হবার পথে। একমাত্র আমেরিকাই জানে যে- ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক বোমা জন্মলাভ করতে এবং তা কোথাও না কোথাও যাচ্ছে বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে। এ থেকে এটা সহজেই অনুমেয়, ত্রিপক্ষীয়-শক্তির (জার্মানি, ইতালি ও জাপান) কোন একটি রাষ্ট্র যে এর শিকার হবে তা তখনই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো।

তিন, ১৯৪৫ সালের ১২ই এপ্রিল আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট এর অন্তর্ধান হয় এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান। তিনি প্রেসিডেন্টের আসনে আসীন হবার পর যুদ্ধসচিব হেনরি এল. স্টিমসন তাকে ম্যানহাটন প্রজেক্ট ও পারমাণবিক বোমা তৈরির ব্যাপারে অবহিত করেন, এবং ১৯৩৯ সালে আইনস্টাইনের লেখা পত্রটি দেখান। এসময় ট্রুম্যান উৎসুক কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করেন, “যখন জার্মানি পতনের মুখে তখন আর পারমাণবিক বোমার কী দরকার?” এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে,পরিবর্তে, স্টিমসনপ্রেসিডেন্টকে বোমা বিস্ফোরণ সংক্রান্তবিষয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে না পৌঁছে বরং এ বিষয়েচূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য উচ্চ-পর্যায়ের একটি গোপন কমিটি গঠন করতে পরামর্শ দেন। ফলে, ২৫শে এপ্রিল জার্মানির আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের দিন, যুদ্ধবাজ মনোবৃত্তির ৫জননেতার সমন্বয়ে বোমার ভবিষ্যৎ ব্যবহার বিষয়ক একটি কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে অবশ্য এই কমিটিতে চারজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা না জানলেও, তারা ইতোমধ্যে সকলে মিলে বোমা ফাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। একটি ঘটনা থেকে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। একদিন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীদের একজন এক সামরিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেন, “যুদ্ধও শেষ এবং আমরা জার্মান জুজু’র ভয় থেকেও মুক্ত। তাহলে বোমা বিস্ফোরণের আর কী প্রয়োজন আছে?” তখন কর্মকর্তাটি বিস্ময়ে জবাব দেন এই বলে যে, “স্যার, আপনি এসব কী বলছেন? বোমা বানাতে আমরা প্রচুর অর্থ খরচ করেছি!”অতএব এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তারা বোমা ফাটাতেই বদ্ধপরিকর ছিল। অন্য দু’টি ঘটনাথেকে বিষয়টা আরো জোরালো হয়। বিজ্ঞানী জিলার্ড, যিনি এই পদক্ষেপে অগ্রগণ্যদেরঅন্যতমছিলেন, বোমা ফাটানো রুখতে আমেরিকান প্রশাসনকে রাজী করাবার ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলেন। তার এই চেষ্টাকে তাচ্ছিল্য জ্ঞান করে এবং তাকে উপহাস করেতৎকালীন মার্কিন সিনেটর বার্নেসতাকে বলেন, “যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। তাছাড়া আপনি কীভাবে জানেনযে রাশিয়াতে বোমা তৈরির রাসায়নিক উপাদান ‘ইউরেনিয়াম’ নেই?” অন্যদিকে, ক্লাউস ফুকস্- যিনি বোমার ক্রিটিক্যাল সাইজ হিসাব করাতে নিয়োজিত ছিলেন- বলেন, “বোমা বানাতে ২ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গেছে! অতএব এটা কাজ শুরু করলেই আমি আনন্দিত হব”।

এখন আসা যাক, শেষ পর্যন্ত কেন জাপানেই এই বিধ্বংসী বোমা নিক্ষেপিত হয়েছিল? কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে এই বিষয়টি স্পষ্ট করা যেতে পারে। এক, ১৯৪৩ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর মুসোলিনি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং ইতালি মিত্রশক্তির নিকট আত্মসমর্পণ করে। অন্যদিকে, ২৫শে এপ্রিল ১৯৪৫ হিটলারের কথিত আত্মহত্যার মধ্যে দিয়ে জার্মানির পতন ঘটে। কিন্তু, জাপান তখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলো। ফলে, একমাত্র জাপান-ই টার্গেট লিস্টে রয়ে যায়। দুই, ১৯৪৫ সালের ১৭ই জুলাইতেআরম্ভ হওয়া পটসডাম সম্মেলন চলাকালীন যুদ্ধসচিব স্টিমসন বিজ্ঞানী ওপেনহেইমার কর্তৃক টেলিগ্রাম মারফত অবগত হন যে- পারমাণবিক বোমার প্রজেক্ট পুরোপুরি সফল হয়েছে। অতঃপর, স্টিমসন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট স্ট্যালিনের চক্ষুর অন্তরালে নিভৃতে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ও মিত্রশক্তির সর্বাধিনায়ক জেনারেল আইজেনহাওয়ারকে পরমাণু বোমার সফল উদ্ভাবনের বিষয়ে অবগত করেন। সব শুনে আইজেনহাওয়ার মন্তব্য করেন, “যেহেতু জাপান আত্মসমর্পণের পথে সেহেতু বোমার ব্যবহার নিরর্থক হবে”। কিন্তু, সেদিন স্টিমসন তার ডায়েরিতে লিখেন ‘যদি জাপান বশ্যতা স্বীকার না করে, তবে আমি তার উপর বোমা নিক্ষেপের পক্ষপাতী’। ২৬শে জুলাই মিত্রশক্তি জাপানকে সর্বশেষ এই আল্টিমেটাম বা চরমপত্র দেয় যে- যদি সে মাথা নত না করে, তবে তার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হওয়া কেউ কোনভাবেই আটকাতে পারবে না। অতএব, এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে- তারা ততক্ষণে জাপানকে পুরোপুরি ধ্বংসের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো। তিন, ১৯৪৫ সালের আগস্টে জাপান ‘আত্মসমর্পণ’ অথবা ‘মরণপণ যুদ্ধ’-এ দুইঅবস্থার মাঝামাঝি এসে দাঁড়ায়। অবশেষে জাপান যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।বলা বাহুল্য, পারমাণবিক বোমা তৈরি কোন সাধারণ ঘটনা ছিলো না। এর পেছনে ব্যয় হয়েছিল হাজার হাজার মানুষের হাজার হাজার ঘণ্টার শ্রম এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, এটা কোন তাত্ত্বিক প্রজেক্টও ছিলোনা। বরং এটা তৈরিই হয়েছিল ব্যাপকহারে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার জন্য। যাইহোক, যুদ্ধের ইতি টানতেএই বোমা আদৌ ব্যবহার করা হবে কি না-সেটা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছিলো প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সিদ্ধান্তের উপর। তিনি এ ব্যাপারে তার ডায়েরিতে লিখেন ‘এটা একটা ভয়ানক দায়িত্ব,যা আমাদের উপর এসে পড়েছে’। সেসময় ট্রুম্যানের সামনে মূলত৪টি বিকল্প ছিল। এক, জাপানের উপর তখনও সাধারণ বোমা বর্ষণ চালিয়ে যাওয়া; দুই, জাপানকে আক্রমণ করা; তিন, কোন জনমানবহীন দ্বীপে বোমাগুলো ফাটানো; চার, জাপানের কোন জনবহুলশহরে বোমাগুলো নিক্ষেপ করা। কিন্তু, তিনি এর মধ্যে থেকে বোমা নিক্ষেপ করাকেই বেছে নিয়েছিলেন। এ থেকেও অনুমান করা যায় যে, জাপানকে ধ্বংসের নকশা আগে থেকেই প্রণয়ন করা হয়ে গিয়েছিলো।

কেন জাপানে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিলো- এ বিষয়ে বিশ্লেষকদের মতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সনাতনবাদীরা (the traditionalists), যারা অর্ধ-গ্লাস পূর্ণ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী;তাদের মতে- জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতেএবং ত্বরিত গতিতে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানতে পারমাণবিকবোমার মত ভয়ানক শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহার করা আবশ্যক ছিলো। তারা এই যুক্তিও দাঁড় করায় যে- আমেরিকানদের জীবন বাঁচাতে, সেই সাথে জাপানকে আমেরিকা ও সোভিয়েত দখলদারিত্ব থেকে রক্ষা করতেও এধরণেরবোমা বিস্ফোরণ প্রয়োজন ছিলো। কেননা বোমা যত মানুষের জীবন কেঁড়ে নিয়েছে, জাপানে দু’দেশের দখলদারিত্বতার থেকেও বেশি মানুষের জীবন হরণ করত। পক্ষান্তরে, যারা সংস্কারপন্থী (the revisionists) এবং অর্ধ-গ্লাস খালি এই দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত; তারা দাবী করেন, এই মারণাত্মক বোমা নিক্ষেপের কোন প্রয়োজনই ছিলোনা। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো- জাপান আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত ছিলো। অতএব বোমার ব্যবহার এড়ানো যেত, শুধু যদি যুক্তরাষ্ট্র জাপানি সম্রাটকে তার সিংহাসনে বহাল থাকার নিশ্চয়তা দিতো। তারা এর স্বপক্ষে যুক্তি দেখান যে,৮ থেকে ৯ আগস্টের মধ্যে সোভিয়েত বাহিনী কর্তৃক মাঞ্চুরিয়া দখলেই জাপানের আত্মসমর্পণ অবধারিত ছিলো। অতএব পারমাণবিক বোমা নিঃসন্দেহে নিস্প্রয়োজন ছিলো। এতদসত্ত্বেও, জাপানের উপর পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মানব বিধ্বংসী দানবাকৃতির দু’টিবোমা ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’ নিক্ষেপ করা হয় এবং এর দুটি শান্তজনবহুল শহর ‘হিরোশিমা’ ও ‘নাগাসাকি’ কে পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দেয়া হয়;যার চাক্ষুস সাক্ষী এ শহর দু’টিতে বসবাসরত হাজার হাজার হিবাকুশা।

যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সমস্ত ঘটনাবলীর সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণথেকে এই উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় যে-সম্ভবতশুধু জাপানের প্রতি অতি বিদ্বেষ থেকে নয়; বরং আমেরিকাবিশ্বরাজনীতিতে তার দাপুটে আবির্ভাব সারা পৃথিবীরকাছেজানান দিতে,এবং বিশেষ করে,সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে স্বীয় সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার অভিপ্রায় থেকেও জাপানের উপর এই বোমা নিক্ষেপ করেছিলো। প্রমাণস্বরূপ, ১১ই আগস্ট, নাগাসাকিতে বোমা হামলার ঠিক দু’দিনের মাথায় সোভিয়েত গুপ্তচরদের দ্বারা পারমাণবিক বোমা তৈরির ফর্মুলা চুরি হয়ে যায়।উপরন্তু, যুদ্ধের পরপরই আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়ন জোট ভেঙে যায় এবং তারা পরস্পর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়; এবং এর প্রভাবে সারা পৃথিবী দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে যায়। যা বৈশ্বিক সম্পর্ককে আজও অনেকাংশে প্রভাবিত করছে।

(প্রফেসর মতিয়র রহমান রচিত বই “পরমানু বোমার নেপথ্য ইতিহাস এবং হিটলার” ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিশ্লেষণধর্মী তথ্যসূত্রের আলোকে।)

লেখকঃ সহযোগী গবেষক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ।

অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর