× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

অমার্জনীয় অপরাধের সন্ধানে

মত-মতান্তর

যুক্তরাজ্য থেকে ডাঃ আলী জাহান
১১ আগস্ট ২০২১, বুধবার

১. ইংল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশি ডাক্তার দম্পতির চোখে ঘুম নেই। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফোন করে যাচ্ছেন। অনবরত ফোন করছেন। হাসপাতালগুলোতে সরাসরি ফোন করছেন। পরিচিত ডাক্তার বন্ধুদের কাছে ফোন করছেন। সিনিয়র ভাইদের ফোন করছেন। প্রশ্ন এবং অনুরোধ একটাই। কোথাও আইসিইউ বেড খালি আছে? উনাকে কি ভর্তি করা যাবে? অক্সিজেন সেচুরেশন ৬৫% এখন।
আইসিইউ বেড না পাওয়া গেলে উনাকে বাঁচানো যাবে না। ওনার কোভিড ধরা পড়েছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বাসায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তোমরা/আপনারা কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন?

২. না, কেউই সাহায্য করতে পারেনি। ছাতক পেপার মিলের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শফিক মনসুর এখন বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন। সিলেটের সবকটি হাসপাতালে ফোন করে কোনো আইসিইউ বেড যোগাড় করা যায়নি। গতরাতে ওনার মেয়ের স্বামীর সাথে কথা হয়। অসহায়ত্বের কথা শুনতে থাকি। আমার বাংলাদেশে থাকা পরিচিত লোকজনের কথা বলি। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। আইসিইউ সাপোর্ট ছাড়া জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন মনসুর সাহেব। হয়তো বাঁচবেন। হয়তো নাও বাঁচতে পারেন। তিনি এখন পরম করুণাময়ের হাতে সোর্পদ হয়ে আছেন। গত কয়েকদিন থেকে সিলেটে করোনা রোগীর জন্য আইসিইউ খালি নেই। জীবনের গতি শ্লথ হয়ে আছে। জীবিত আত্মীয়-স্বজনের চোখেমুখে হতাশা, অব্যক্ত কান্না এবং একরাশ অভিশাপ। কাকে অভিশাপ দেবেন?

৩. গত দুদিনে আইসিইউ সাপোর্টের অভাবে সিলেটে আমার ২ আত্মীয় পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। কথাটা অন্যভাবে বলতে গেলে আমরা তাদেরকে হত্যা করেছি। বিনা চিকিৎসায় তাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি। যে রাষ্ট্র এবং সমাজ অসুস্থ হলে তাদেরকে চিকিৎসা দেবার কথা সেই রাষ্ট্র এবং সমাজ চিকিৎসার পরিবর্তে তাদেরকে হত্যা করেছে। অসহায় মানুষগুলো হাসপাতালের ফ্লোরে মারা যাচ্ছেন। গাড়িতে মারা পড়ছেন। বিনা চিকিৎসায় বাড়িতে মারা পড়ছেন। এসব দেখে আমাদের কোনো বিকার নেই। আমরা অনেকেই উৎসবে ব্যস্ত আছি। মানুষের মৃত্যুর দীর্ঘ মিছিল আমাদের ভেতরে শোক জাগাতে পারছে না। কারণ আমরা 'সুখে' মগ্ন আছি। মৃত্যু এসে আমাদের ঘাড় মটকানো না পর্যন্ত আমরা আনন্দ উৎসবে ব্যস্ত থাকবো। আমাদের কেউ থামাতে পারবে না!

৪. বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ম্যাচের জয় নিয়ে আমরা উৎসবে ব্যস্ত আছি। সিনেমার নায়িকাদের/ মডেলদের গ্রেফতার আর লাইভ শো নিয়ে আমরা আনন্দে বিভোর আছি। সেই সুযোগে দেশে করোনা সবকিছু শেষ করে দিচ্ছে। সাজানো সংসার তছনছ করে দিচ্ছে। মানুষকে পথে বসিয়ে দিচ্ছে। সেদিকে আমাদের খেয়াল নেই। আমরা আছি এক রঙিন দুনিয়ায়।

৫. এপ্রিলে শুরু হওয়া বাংলাদেশের তথাকথিত লকডাউন বুধবার (১১ আগস্ট) শেষ হচ্ছে। অর্জনটা কি? তথাকথিত বিভিন্ন রঙ্গের লকডাউন দেওয়ার পর সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা হু হু করে বাড়লো কেন? পৃথিবীর সব প্রান্তে লকডাউন দেওয়ার পর সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসলো কিন্তু বাংলাদেশে কমেনি কেন? এ প্রশ্নগুলো করার মানুষের বড্ড অভাব বাংলাদেশে। সরকারকে এ প্রশ্নগুলো কেন করা হচ্ছে না? আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা মানুষগুলো এসব প্রশ্ন না করে নায়ক-নায়িকাদের ফেইসবুক লাইভ আর গ্রেপ্তারে আনন্দ পাচ্ছেন। তারা ব্যস্ত আছেন ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে। নায়িকার সাথে পুলিশ কর্মকর্তার কেক কাটার ভিডিও নিয়ে। ব্যস্ত আছেন নায়িকার বাসা থেকে উদ্ধার করা রঙ্গিন বোতলে ডিস্টিলড ওয়াটার না রুহ আফজা আছে তা নিয়ে গবেষণা করতে।

৬ কিন্তু, আফিমের সে আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। মৃত্যু আপনার দিকেও হানা দেবে। আপনাকে না নিয়ে গেলেও পরিবারের কাউকে না কাউকে ঠিকই নিয়ে যাবে। অক্সিজেনের অভাবে আপনি যেদিন হাসপাতালের বারান্দায় বা ফ্লোরে মারা যাবেন সেদিন বুঝবেন ভুলটা আপনিও করেছেন।

৭. কারণ আপনি যখন সুস্থ ছিলেন তখন আপনার বিবেককে কাজে লাগাননি। আপনার সামনে একে একে সবগুলো প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু আপনি ছিলেন নির্বাক। সে আগুনটা এখন আপনার ঘরে এসেছে। অন্যের ঘরের আগুন নেভাতে যাননি। আপনার ঘরের আগুন নেভাতে কেউ এগিয়ে আসবে না। আজ আপনি নিজেই আপনার মৃত্যুদূত।

৮. আপনি এ লেখা পড়ে মনে কিছু কষ্ট পেতে পারেন। সেই কষ্টকে শক্তিতে পরিণত করে একটিবার শির উঁচু করে দাঁড়াতে পারবেন? নাকি অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচের জয়, বাংলা সিনেমার নায়িকা আর মডেলদের কাহিনী নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন তা আপনার সিদ্ধান্ত।

৯. আপনি চলে গেলে সরকারের কিছু হবে? দেশের কিছু হবে? কিছুই হবে না। আপনার আগে দেশের অনেক রথি-মহারথি চলে গেলেও কিছুই হয়নি| কিন্তু আপনি চলে যাবার সাথে সাথে আপনার পরিবারটিও আপনার মৃত্যুর সাথে সাথে বিলীন হয়ে যেতে পারে। কল্পনায় একটিবার দেখার চেষ্টা করুন। জেগে উঠুন। না হয় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হোন।

১০. ছাতক পেপার মিলের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শফিক মনসুর সাহেবের জন্য মহান করুণাময়ের কাছে দোয়া করি। তবে মনসুর সাহেব একটি ভুল করেছেন এবং সেই ভুলের খেসারত এখন দিচ্ছেন। আপনারা কি জানেন সেই ভুলটি কী? এই অভাগা দেশে জন্ম নেওয়া হচ্ছে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল, অমার্জনীয় অপরাধ!

---
ডা: আলী জাহান
কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য।
[email protected]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর