× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার , ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আমার স্মৃতিতে নাজমা আপা

মত-মতান্তর

ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবির
১১ আগস্ট ২০২১, বুধবার

গত ০৮ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অসংখ্য স্টুডেন্টের শিক্ষক, বহু গুণে গুণান্বিতা, প্রফেসর ড. নাজমা চৌধুরী (নাজমা আপা/নাজমা ম্যাডাম) আশি-উর্ধ্ব বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমার সহকর্মী ও আপার সাবেক ছাত্র প্রফেসর ড. সফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহবুবসহ অনেকেই আপার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। প্রথম আলো পত্রিকায় (১০ আগস্ট) আমার বন্ধু, আপার ঘনিষ্ঠ সাহচর্যলাভকারী ছাত্রী ও সহকর্মী, প্রফেসর ড. তাসনীম সিদ্দিকী (রিয়া), আপাকে নিয়ে একটা সুন্দর লেখা লিখেছেন। লেখাগুলো পড়ে মনে পড়ে যায় আপার সাথে আমার স্মৃতি। আপাকে নিয়ে আমার যেটুকু স্মৃতি আছে, তা বিবৃত করে প্রয়াত শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

আপার কথা ভাবতে ভাবতে আমিও আপার ক্লাশরুমে, আমার ছাত্রজীবনে ফিরে গিয়েছিলাম। আমি সারজীবন মনের দিক থেকে ছাত্রই রয়ে গিয়েছি, 'শিক্ষক মন' নিজের ভিতর গড়ে তুলতে পারিনি। শিক্ষক বলতে যেমন মনে করা হয়, ঠিক তেমনটা আমার হয়ে উঠা হয়নি।

অনেকের মত আমিও নাজমা আপার একজন মন্ত্রমুগ্ধ ছাত্র ছিলাম।
ক্লাশের সবকিছুই যে ঠিকঠাক বুঝতাম, সে দাবি হবে হাস্যকর। তিনি লেকচার দিতেন বসে এবং ইংরেজিতে। তো, জেলা শহর থেকে আসা ছাত্র হিসাবে একটু বাড়তি চেষ্টাই করতে হতো আমাকে। ইংরেজিতে লেকচার। কতটুকুই আর বুঝতাম। মফস্বলের ছেলে।

যাহোক! আপার কোর্সে খারাপ করিনি। কিন্তু, আপাকে আমার সে সময় কেন যেন বেশ প্রাইভেট পার্সন বলে মনে হতো। হতে পারে, আমার মফস্বল ব্যাকগ্রাউন্ড ও আমার ব্যক্তিগত কিছু কারণে তেমন মনে হতো। তাঁকে অনেক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও রিজার্ভ মনে হতো। তবে, আপা হয়তো আমাকে অকারণেই ভালো ছাত্র বলে ভাবতেন।

আমি ছিলাম আপার সেকশানে। এখানে এটা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা যে, আমাদের সময় অনার্সে তিনটি সেকশান ও এমএসএস ক্লাশে দুটো সেকশান ছিল। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স সিস্টেমের প্রথম ব্যাচ। প্রতি সেকশানে, আমার ধারনা, সোয়াশো- দেড়শ স্টুডেন্ট ছিল। কারণ, সেশন জট ম্যানেজ করার জন্য সে বছর ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালের এইচ. এস. সি. পাশ করা ছাত্রছাত্রীদেরকে একসঙ্গে ভর্তি করা হয়। ফলে, বাংলাদেশে ১৯৭৯ সালের অনার্স এবং ১৯৮০ সালের মাস্টার্সের কোন ব্যাচ নাই।

আপার কোর্স ছিল 'সোস্যাল চেঞ্জ'। কোর্সের এক পর্যায়ে কি এক কারণে আমি গ্রামের বাড়ি পাবনা গিয়ে আটকা পড়ে যাই। এর ভিতর 'ইন-কোর্স' পরীক্ষা আপা নিয়ে ফেলেন। আমি তো পেরেশানিতে পড়ে যাই। অন্য সেকশানে একই কোর্স টিচার ছিলেন প্রফেসর বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (বি. কে. জাহাঙ্গীর স্যার)। আমাকে তিনি অনেক ভালবাসতেন। ওনার সেকশনের ইন কোর্স পরীক্ষা তখনো হয়নি। তো, আমি বি. কে. জাহাঙ্গীর স্যারকে বিষয়টা খুলে বললাম এবং ওনার ক্লাসের সাথে 'ইন-কোর্স' পরীক্ষা দিতে চাইলাম। উনি বললেন, "কেন, আপনি আমার সেকশানের স্টুডেন্ট নন! আমি তো ভেবেছি, আপনি নিয়মিত ক্লাস করেন, এই সেকশানেরই ছাত্র।" উল্লেখ্য, বি. কে. জাহাঙ্গীর স্যার সবাইকে আপনি বলে সম্বোধন করতেন। আমি বললাম, "না স্যার। আপনার ক্লাস শখ করে করি"। তখন উনি বললেন যে আমাকে ওনার সেকশানে পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি দিতে ওনার কোন আপত্তি নেই। তবে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই প্রফেসর নাজমা চৌধুরীর অনুমতি লাগবে। আমি স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। প্রমাদ গুনলাম।

ঐ মূহুর্তে আপার অনুমতি পাওয়ার প্রসঙ্গ তো আসেই না, অনুমতি চাওয়াটাকেই দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ বলে মনে হলো। কি বলব আপাকে? ওনার সামনে তো দাঁড়াতেই ভয় করে। তবুও যেতে তো হবেই, অনুমতি চাইতেদ তো হবেই। অগত্যা গেলাম। আমাকে দেখেই আপা বললেন, "তোমার নাম কি? পরীক্ষা দিয়েছ? পরীক্ষার হলে তো দেখলামনা!!" আমি জড়িয়ে পেঁচিয়ে কোনভাবে আমার বিষয়টা বললাম। অবস্থা কেমম হতে পারে, তা আশা করি পাঠক বুঝতেই পারছেন।

এখানে একটা কথা বলে রাখি। ছাত্রছাত্রী মহলে আপাকে অনেকেই ইন্দিরা গান্ধী বলে ডাকত। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আপার চেহারার ও দৃঢ়তার কিছুটা মিলের কারণে এমনটা বলা হতো। তো, আপা বললেন, "ঠিক আছে দিও। আর তুমি তো ওঁর সাথে ক্লাস করেছ, খারাপ হবেনা পরীক্ষা। আমি জানি যে তুমি ওঁর ক্লাস করো।"

আমি খুব লজ্জিত হলাম। আমি কিছু একটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করতেই আপা বললেন, "থাক্, ব্যাখ্যার দরকার নাই"। আমি রুমে এসে আপার জন্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম। যাকে ভেবে এসেছিলাম একজন কঠিন মানুষ হিসাবে, তাঁর কাছ থেকে এমন মাতৃবৎ স্নেহপূর্ণ ব্যবহারে আমার নিজের ভিতর ভীষণ অপরাধবোধের সৃষ্টি হয়। এরপর আপার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভক্তি আরো বেড়ে যায়।

পরীক্ষা শেষ। আপার কথা আর মনে থাকেনা। রেজাল্ট হয় ১৩ ফেব্রুয়ারি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেই জুলাই ১৯৮৩ সালে। এরপর একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাউঞ্জে দেখা হয়েছিল। আমি ব্যাখ্যা যতোই দিতে চেষ্টা করি দেখা না করতে পারার, আপা ততোই আমাকে অভিনন্দন জানাতে থাকেন। এরপর আপার সাথে দেখা চট্টগ্রামে প্রফেসর রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর (আর. আই. চৌধুরী) স্যারের বাসায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে কি একটা কাজে যেন আপা চিটাগাং এসেছিলেন এবং আর. আই. চৌধুরী স্যারের বাসায় উঠেছিলেন। আমাকে দেখিয়ে স্যার আপাকে বলেন, "এই যে আপনাদের ছাত্র। চেনেন"। আপা হেসে আমার কুশলাদি জানতে চাইলেন। তারপর বিভাগের নিয়োগ সংক্রান্ত ও অন্যান্য কথাবার্তায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন তাঁরা। আমি চুপচাপ শুনলাম। তখনতো আমি "কলিগ"!!!

আমি চিটাগাং ভার্সিটির সোস্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির জার্ণালে একটা লেখা জমা দিয়েছিলাম ছাপানোর আশায়। লেখাটির রিভিউয়ার ছিলেন নাজমা আপা। আমার জানার সুযোগ ছিলনা। আমি জানলাম, যখন এডিটর প্রফেসর সিকান্দার খান স্যার আড়াই পৃষ্ঠার টাইপ করা রিভিউয়ারের কমেন্ট ধরিয়ে দিলেন। তিনি অনেক সংশোধনী দিয়ে ছাপতে সম্মতি দিয়েছেন। ওনার কথায়, কনটেন্টের গুরুত্বের জন্য। সিকন্দার স্যারের সহায়তায় শেষাবধি সংশোধিত প্রবন্ধটি ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। এটা জেনে আপা খুশি হয়েছিলেন।

বছর তিনেক আগের একটা অভিজ্ঞতা হলো আপার সাথে। ২০১৮ সালের শেষ দিকের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক সিলেকশান কমিটির সভায় আপার সাথে আমার দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতা।

আমরা সিলেকশান কমিটির সদস্যগণ ভিসি প্রফেসর আখতারুজ্জানের রুমে বসা। খবর এলো প্রফেসর ড. নাজমা চৌধুরী এসেছেন। আমি দরজার দিকে তাকাতেই দেখি হুইল চেয়ারে আপা বসা। একজন সেটা পুশ করে ভিসি মহোদয়ের রুমাবধি নিয়ে এলেন। আমি এগিয়ে গেলাম। আপাকে মিটিং পর্যন্ত আনতে সহায়তা করলাম। আমার পাশের চেয়ারে বসালাম। ওনাকে নিজ হাতে ফলমূলের প্লেট এগিয়ে দিলাম। সেগুলো খুলে দিলাম। টিস্যু পেপার এগিয়ে দিলাম। আপার অস্পষ্টভাবে বলা প্রশ্নগুলো আমি ঠিকভাবে বুঝিয়ে বললাম। সবশেষে, আবার হুইল চেয়ার পুশ করে নিয়ে গেলাম আপাকে। টেবিলের অপরপ্রান্তে আমার বন্ধু প্রফেসর ড. নাজনীন (খুকু) ছিল। কিন্তু সে ছিল দূরে ও ভিতরের দিকে। ফলে, আপার জন্য এটুকু করার সুযোগটা আমিই পেয়েছিলাম।

সবশেষে, আপার সাথে দেখা হয়েছিল, সালাম দিতে পেরেছিলাম জাতীয় অধ্যাপক, আমার ওস্তাদ, তালুকদার মনিরুজ্জামানের স্মরণসভায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ সে সভার আয়োজন করেছিল। আপা অতিথি হিসাবে এসেছিলেন। আমার সাথে আমার ছাত্র ও সহকর্মী মুহাম্মদ ইসহাকও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

তিনি অসুস্থ হলেও বুঝিনি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারীর ৮ বা ৯ তারিখের সেই সালামটাই হবে ওনার প্রতি আমার শেষ বাহ্যিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।

এমন শিক্ষকের প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধা থাকে চিরকালের জন্য। স্মৃতি থাকে অমলিন। আপার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ আপার ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা করুন। আপাকে বেহেশত নসীব করুন।

ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবির, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ এবং পরিচালক, সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর