× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সুভাষ বোস সহায়তা চেয়েছিলেন হিটলারের

রকমারি

শোয়ায়েব চমক
১৫ আগস্ট ২০২১, রবিবার

১৯১৩ সালের গ্রীষ্মকাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের ওরেগন রাজ্যের এস্টোরিয়ায় ১৫ই জুলাই মাসে রাতের বেলা একদল প্রবাসী ভারতীয় গোপনে একত্রিত হলেন। বেশির ভাগই ভারতীয় পাঞ্জাবি। অনেকেই আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে এসেছেন। আবার অনেকে এসেছেন কানাডা থেকে। উদ্দেশ্য ভারতে বৃটিশ শাসনকে উৎখাত করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে আন্দোলন শুরু করা। দীর্ঘ সেই বৈঠকে প্রবাসে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শপথ নিয়ে গঠন করা হয় ‘ঘাদার পার্টি (Ghadar Party)’। উর্দু এবং আরবি মিশ্রিত ঘাদার শব্দের অর্থ ‘বিদ্রোহ’।
ঘাদার পার্টির সদর দপ্তর হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিস্কোর ঠিকানা ব্যাবহার করা হয়, সেখান থেকে হিন্দুস্তান ঘাদার নামে একটি পত্রিকাও বের করা হয়।

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ঘাদার পার্টির কিছু সদস্য ভারতের পাঞ্জাবে ফিরে এসে ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য ভারতে অস্ত্রোপচার করে সশস্ত্র বিপ্লবে সবাইকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় ঘাদার পার্টির ৪২ জন সদস্যকে ফাঁসি দেয়া হয়। বাকিদের বেশির ভাগই পালিয়ে লিবিয়া, তুরস্ক হয়ে ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন।


কিন্তু ঘাদার পার্টির সেই আন্দোলনের বাতাস তখন ভারতে ভালোভাবেই বইতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯১৫ সালে ঘাদার পার্টির সহযোগিতায় ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ শুরু করার পরিকল্পনা করে। জার্মানির সহযোগিতায় হংকং হয়ে পাঞ্জাবে এই বিদ্রোহ হওয়ার কথা। কিন্তু বৃটিশ গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে সেই বিদ্রোহও ব্যর্থ হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ ভারতীয় সেনা বাহিনী বৃটেনের রাজা ষষ্ঠ জর্জের অধীনে নৈপুণ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল এবং যুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিভিন্ন পদকও অর্জন করছিল। কিন্তু ভারতের অনেক নেতাই তখন বৃটিশ রাজের পক্ষে যুদ্ধ না করে বরং ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা যুক্তিযুক্ত মনে করছিলেন।
১৯৪১ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানির বার্লিনে আসেন। ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা সুভাষ চন্দ্র বোস তখন মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য অবশ্যই অস্ত্র হাতে নিতে হবে এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের এখনই সময়।


তাই বৃটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি জার্মানির সহায়তা চান। তিনি জার্মানের নাৎসি বাহিনী প্রধান এডলফ হিটলারের সঙ্গে দেখা করেন এবং এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
হিটলার অত্যন্ত খুশি মনেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ভারত যেহেতু রাজি আছে তখন বৃটিশ সাম্রাজ্যকে শায়েস্তা করার এর থেকে আর ভালো উপায় কি হতে পারে!!
হিটলারের বিভিন্ন কন্সান্ট্রেশন ক্যাম্পে তখন অনেক ভারতীয় বন্দি ছিল যারা আফ্রিকাতে বৃটিশ রাজের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করছিল। সুভাষ চন্দ্র বসু তখন নাৎসি বাহিনীর সহায়তায় ভারতীয় বন্দিদের এবং জার্মানিতে বসবাস করা ভারতীয় ছাত্রদের নিয়ে দ্য ইন্ডিয়ান লিজিওন দল গঠন করেন। পরবর্তীতে একে টাইগার লিজিওন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ নামেও ডাকা হতো। তিনি চেয়েছিলেন ভারতীয় এই সেনারা যেন জার্মান ইউনিটের মতই একই স্তরের প্রশিক্ষণ, বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। হিটলার সব মেনে নেন এবং যে বৃটিশ ভারতীয় সৈন্যরা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বন্দি হয়েছিল, তাদের হাতেই জার্মান সেনাবাহিনীর পোশাক এবং অস্ত্র তুলে দেন বৃটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। প্রথম দফায় ২৭ জন ভারতীয় বন্দিকে নির্বাচন করে জার্মান আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে আরো কয়েক হাজার ভারতীয় বন্দিকে ট্রেনিং দেয়া হয়।
প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা ছিল হিটলারের অধীনে এমন একটি ভারতীয় আক্রমণাত্মক সেনাবাহিনী তৈরি হবে যারা ভারতের পশ্চিম সীমান্তে জার্মানিদের সমর্থনে বৃটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে আর এই ইন্ডিয়ান লিজিওনদের সহায়তায় এক সময় নাৎসি সৈন্যেরা ভারতে আসবে বৃটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। সেই হিসেবে ছোট্ট একটা দলকে ভারতে পাঠানো হয়েছিল যারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সঙ্গে কাজ শুরু করে।
কিন্তু জার্মানরা বেশির ভাগ ইন্ডিয়ান লিজিওনের সদস্যদের ইউরোপেই রেখে দেয় বিভিন্ন ট্রেনিং এর অংশ হিসেবে। মিত্র বাহিনীর আক্রমণের আগ পর্যন্ত এই সব ভারতীয় সেনারা নেদারল্যান্ডস এবং ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গায় নন কমব্যাট কাজে নিয়োজিত থাকে।
বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে ধর্ম, অঞ্চল বা বর্ণের ভিত্তিতে রেজিমেন্ট বা ইউনিট তৈরি করা হতো। কিন্তু সুভাস চন্দ্র বোস ইন্ডিয়ান লিজিওনে এই ব্যাপারটা রাখতে চাইলেন না। সব ধর্ম, বর্ণের মিশেলে তিনি শুধু ভারতীয় সেনার দল তৈরি করতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছিলেন কারণ ১৯৪৩ সালে সুভাস চন্দ্র বোস জার্মানি ত্যাগ করার পর নাৎসি নেতা হাইনরাইখ হাইমলার মুসলমানদের নিয়ে একটি আলাদা ইউনিট করতে চেয়েছিলেন। সেই ইউনিটে ইন্ডিয়ান লিজিওনের মুসলমান সেনারা যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায় এই বলে যে তারা মুসলমান হিসেবে নয় বরং তারা ভারতীয় হিসেবে যোগ দিতে চান। তেমনি বসনিয়ান মুসলমানেরাও সেই ইউনিটে যোগ দিতে অনাগ্র্রহ দেখান কারণ তারা নিজেদের মুসলমান হিসেবে পরিচয় না দিয়ে ইউরোপিয়ান হিসেবে পরিচয় দিতে আগ্রহী ছিলেন। হিটলার শুধু মুসলমানদের নিয়ে তৈরি এই ইউনিটের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখান এবং তাদেরকে সে সময়কার আধুনিক অস্ত্র প্রদান করেন। ভারতীয় মুসলমান সেনাদের এই ইউনিটে যোগ না দেয়ায় তিনি বেশ বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করেন ইন্ডিয়ান লিজিওন একটা রসিকতা।
ইন্ডিয়ান লিজিওন যখন জার্মানিদের তত্ত্বাবধানে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, তখন ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের প্রভাব কমতে শুরু করেছে। ফ্রান্স, পোল্যান্ড, ইংল্যান্ড নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো শুরু করেছে।
সুভাস চন্দ্র বোস এক সময় বুঝতে পারেন যে তিনি যা চাচ্ছিলেন আসলে তা হবে না। হিটলার এবং অন্য সব নাৎসি নেতারা আসলে তাকে বৃটিশদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। জার্মানরা কখনই ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে সাহায্য করবে না। বরং তারা ইন্ডিয়ান লিজিওনের সৈন্যদের নিজেদের স্বার্থেই ব্যবহার করবে। তাই তিনি সময় নষ্ট না করে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গোপনে সাবমেরিনে করে জাপানের দিকে চলে যান। সেখানে তিনি জাপানিদের সহায়তায় ৬০,০০০ সৈন্যের একটি দল তৈরি করে ভারতে রওনা হন।
এদিকে সুভাস চন্দ্র বোসের গোপনে জার্মান ত্যাগের কারণে ইন্ডিয়ান লিজিওন সেনাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। অনেক মতবিরোধ এবং বিদ্রোহের পরেও জার্মান হাই কমান্ড তাদেরকে প্রথমে হল্যান্ড এবং পরে দক্ষিণ পশ্চিম ফ্রান্সে প্রেরণ করে। সেখানে সাগর পাড়ের ঘাঁটিগুলো সুরক্ষিত রাখতে বলা হয়। কিন্তু যেহেতু সেখানে কোনো নেতৃত্ব ছিল না, দিকনির্দেশনা দেবার কেউ ছিল না। জার্মানরা তাদের মোটামুটি অবহেলায় সাগর পাড়ে ফেলে রেখেছিল। ইন্ডিয়ান লিজিওনের অনেক সদস্য ফ্রান্সের আশেপাশের শহরগুলোতে চুরি ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এই জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীতে তাদের প্রতি প্রচ- ঘৃণার জন্ম হয়।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ইন্ডিয়ান লিজিওনের সমস্ত সেনাদের জার্মানিতে ফেরত নিয়ে আসা হয়। এরমধ্যে অনেকে হাঁটা পথে আল্পস পর্বত পাড়ি দিয়ে নিরপেক্ষ দেশ সুইজারল্যান্ডে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু তারা আমেরিকান এবং ফরাসি সেনাদের কাছে ধরা পড়েন এবং তাদেরকে ইউরোপের বৃটিশ ইন্ডিয়ান সেনাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ধরা পড়া ইন্ডিয়ান লিজিওনের সব সদস্যকে জাহাজে করে ভারতে ফেরত পাঠানো হয় বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য।
ভারতের স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক পরিবর্তনে শুরুর দিকে নাৎসিদের সঙ্গে কাজ করার জন্য ইন্ডিয়ান লিজিওনের সদস্যদের কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো খারিজ করে তাদের মুক্ত করে দেয়া হয়।
প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে জাতীয়তাবাদী ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে ইন্ডিয়ান লিজিওন তৈরি হয়েছিল। স্বাধীন ভারতে এই নিয়ে খুব কমই চর্চা হয়েছে। ভারত থেকে অনেক দূরে ইউরোপে এর কর্মকা- সীমাবদ্ধ থাকায় হয়তো এদের নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মান ইতিহাসেও অন্যান্য সব বিদেশি স্বেচ্ছাসেবকদের তুলনায় ইন্ডিয়ান লিজিওনের ব্যাপারে অনেক কম তথ্যই পাওয়া যায়। ২০০৩ সালে জার্মান লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মার্লে ক্রগার ফ্রান্সের উপকূলে জার্মানদের তত্ত্বাবধানে থাকা ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে একটি রহস্য উপন্যাস লেখেন। এ ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ইন্ডিয়ান লিজিওন সেনাদের আল্পস পর্বত পাড়ি দিয়ে সুইজারল্যান্ডে প্রবেশের হল্প নিয়ে ২০১১ সালে বলিউডে ডিয়ার ফ্রেন্ড হিটলার নামে একটি সিনেমা তৈরি হয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর