× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

তালেবানের ক্ষমতা দখলে পরিবর্তমান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষমতার বিন্যাস

মত-মতান্তর

ড. মাহফুজ পারভেজ
২২ আগস্ট ২০২১, রবিবার

শুধু আফগানিস্তান বা দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের জন্যেই নয়, তালেবানদের পুনরায় ক্ষমতা দখল আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষমতা বিন্যাসে তীব্রভাবে নাড়া দিয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্য, আধিপত্য, শক্তিসাম্য ও বিদ্যমান মেরুকরণকেও প্রবল ঝাঁকি দিয়েছে তালেবান ইস্যু।

আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখলের বিষয়ে প্রতিবেশী চীন, রাশিয়া, ইরান, পাকিস্তান, ভারত স্ব স্ব অবস্থান জানিয়েছে। আফগান প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেন গৃহীত নীতিও স্পষ্ট। এখন আফগানিস্তানে তালেবান বিষয়ে গত কুড়ি বছরে আমেরিকার লাভ-ক্ষতির ময়নাতদন্তের চেয়ে জরুরি হলো সামনের দিনগুলোর দিকে তাকানো। ভঙ্গুর রাজনৈতিক কাঠামোর একটি দেশে অসংখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের মধ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, স্থায়ী সরকার গঠন এবং বৈধতার সঙ্কট মোচনের বিষয়গুলোই বরং আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে তালেবান ইস্যুতে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষমতা বিন্যাসের মধ্যে যে পরিবর্তন ও পালাবদল ঘটছে, তাও সামনে চলে এসেছে।

স্নায়ুযুদ্ধের পর, বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে দ্বিমেরু কেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে আমেরিকার একাধিপত্যে যে একমেরুর বিশ্ব সূচিত হয়েছিল, সেই 'আধিপত্য’র বিষয়টি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার বিশৃঙ্খল অবস্থায় ‘সরে আসা’-র বিষয়টিকে আরো কিছু ঘটনাক্রমের পাশাপাশি ফেলে দেখা যেতে পারে।
যেমন, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আমেরিকার হস্তক্ষেপের ‘হতাশাজনক’ পরিণতি, ২০০৩-এ ইরাকে সাদ্দাম হুসেনকে অপসারণের পরে সে দেশের ক্ষমতা কাঠামোর অবলোপ, ১৯৭৯-এ ইরানে ইসলামি শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আন্দাজ করতে ব্যর্থতা এবং ১৯৭৫-এ ভিয়েতনামে স্থানীয় বাহিনীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কৌশলগত রাজনৈতিক ও সামরিক পরাজয় ইত্যাদি। এই তালিকায় অবশ্যই যুক্ত আছে ‘আরব বসন্ত’-এর বিষয়টিও। যেসব পদক্ষেপ আমেরিকাকে লাভের চেয়ে ক্ষতি করেছে বেশি এবং বৈশ্বিক আধিপত্যের জায়গাটি নিরঙ্কুশ করার বদলে নড়বড়ে করেছে।

কিন্তু শুরুতে বিষয়গুলো কিংবা পরিস্থিতিগুলো এমন ছিল না। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যে স্বল্প সময় আমেরিকা একা মহাশক্তিধর হিসেবে বিরাজ করার অবকাশ পেয়েছিল, সেই সময় ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ পত্রিকার (ইউএস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্‌স কর্তৃক প্রকাশিত) নিবন্ধগুলোতে নতুন সর্বময় ক্ষমতা হিসেবে আমেরিকার এক প্রকার জয়গান গাওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয় ছিল, যা একাধিক বৈশ্বিক ঘটনায় ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে আফগানিস্তান ইস্যুতে তলানিতে এসে ঠেকেছে।

আফগানিস্তান শুধু সোভিয়েত আগ্রাসনকে রুখে সে দেশের শক্তি বহুলাংশে নষ্ট করে নি, আমেরিকাকে হটিয়ে দিয়ে তাদেরকেও ইমেজ সঙ্কটে ফেলেছে। ঐতিহাসিকভাবেই আফগানিস্তানের এমন সামর্থ্যের কথা খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক বিজেতা আলেকজান্ডারের আমল থেকেই লিপিবদ্ধ রয়েছে। খোদ আলেকজান্ডারও খুব সহজে আফগানিস্তানকে কব্জা করতে পারেন নি।

হালআমলের আফগানিস্তান ইস্যুতে আমেরিকা যেমন বিপাকে পড়েছে, তা বিশ্লেষণকালে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাঘা বাঘা বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘ অতীতকেও টেনে আনছেন। একই সঙ্গে তাদের কণ্ঠস্বরও বদলে যাচ্ছে। যারা প্রবল বেগে বলেছিলেন, একুশ শতক ‘আমেরিকার শতক’ হিসেবে বিবেচিত হবে, তারা এখন অনেকটাই মৌন। কারণ প্রেসিডেন্ট পদে তরুণতর বুশ থেকে প্রবীণতর বাইডেন— বিদেশের মাটিতে আমেরিকার কীর্তি সম্পর্কে কোনও ইতিবাচক ইঙ্গিত দিতে পারেন নি।

পাশাপাশি, চীনের উত্থান সম্পর্কে আমেরিকার যে ধারণা ছিল, সেটাও দিনে দিনে ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। আমেরিকান পণ্ডিতদের মতে 'চীন টিকবে না' মর্মে যেসব অনুমান করা হয়েছিল, তা ঠিক হয় নি। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্তরে চীন ক্ষমতা ও সম্পদবৃদ্ধিতে সমর্থ হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সফল হয়েছে। ইরান ও আফগানিস্তান ইস্যুতে তা স্পষ্ট দেখা গেছে।

তালেবানের ক্ষমতা দখলের ঘটনায় আরো যেসব বিষয় সামনে এসেছে, তাহলো একদা তালেবান শত্রু রাশিয়া ও ইরান এখন তাদের বন্ধু। আমেরিকার পরীক্ষিত বন্ধু পাকিস্তানও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আফগানিস্তানের বিষয়ে অনেক সহনশীল। বিশ্বের প্রায়-সকল দেশই তালেবানদের প্রতি অপেক্ষার নীতি গ্রহণ করেছে। নারী, শিক্ষা, গণতন্ত্রায়নের বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য পথে চলার জন্য তালেবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। 'এই' তালেবানও আগের 'সেই' তালেবানের মতো অতি কট্টর ও উগ্রপন্থা অনুসরণ করছে না।

আফগানিস্তানের মতো একটি অনুন্নত, পশ্চাৎপদ ও গোত্রীয় সংস্কৃতির দেশে রাজনৈতিক সংহতি, ঐক্য ও স্থিতিশীলতা অর্জন প্রায়-অসম্ভব একটি বিষয়। গণতন্ত্রের অতীত অভিজ্ঞতা বিহীন একটি দেশে বাইরে থেকে কিছু চাপিয়ে দেওয়াও অসম্ভব, বিপজ্জনক এবং বিরূপ প্রতিক্রয়া স্বরূপ, যে কাজ করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা বছরের পর বছর ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে আফগানিস্তানকে নিজের মতো চলার সুযোগ ও সহযোগিতা দেওয়া ছাড়া অন্য বিকল্প কমই আছে।

ইতিবাচক মনোভাব ও শান্তিপূর্ণ বিকল্প এড়িয়ে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে পরিণতি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মতোই হবে। এতে আফগানিস্তান অস্থির ও সংঘাতময় হলেও হস্তক্ষেপকারীদের বিশেষ লাভ হবে না। যে কারণে, চীন ও রাশিয়া মধ্য এশিয়ার সম্পদ, ব্যবসা ও বৈশ্বিক কানেকটিভিটির স্বার্থে আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় এবং তালেবানদের নিয়েই সে পথে এগুচ্ছে। তালেবানরা বিশ্বের সবার প্রতি প্রাথমিকভাবে উদাত্ত মনোভাব দেখিয়েছে। সেটা অনুধাবণ ও পর্যবেক্ষণ না করে অতি আগ্রহী হয়ে বিরোধিতায় অবতীর্ণ হলে রুশ-মার্কিন ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে।

তালেবানরা ভারতের কাশ্মীর ইস্যুতেও নমনীয়তা দেখিয়েছে। কিন্তু ভারত তালেবান বিরোধিতায় লিপ্ত। এতে তালেবান ইস্যুতে ভারত আমেরিকাকে উস্কানোর সুযোগ পেলেও প্রত্যাবর্তন-রত বাইডেনকে আর মাঠে নামাতে পারবে বলে মনে হয় না। বরং পাকিস্তান ও চীন তালেবানদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের ফলে আফগান ফ্রন্টের সামারিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি ভারতের দিকে মনোনিবেশ করার সুযোগ পাবে। প্রাচীন কূটনীতিবিদ কৌটিল্যের মানস-বংশধর দাবিদার ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের 'ডিপ্লোম্যাট'গণের পক্ষে এই সরল সমীকরণ না বোঝার কারণ নেই। তালেবানদের কারণে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষমতার বিন্যাসেরও যে পালাবদল ঘটেছে, বিশ্বের প্রায়-সকল দেশের মতোই ভারতেরও তা ইতিমধ্যে বোধগম্য হওয়ার কথা।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর