× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ইতিহাসের খেরোখাতা: কাছের দেশ আফগানিস্তান

মত-মতান্তর

গাজী মিজানুর রহমান
২৩ আগস্ট ২০২১, সোমবার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা এবং সৈয়দ মুজতবা আলীর আব্দুর রহমানের দেশ আফগানিস্তান সম্পর্কে উপ-মহাদেশবাসী মানুষের জানবার আকাঙ্ক্ষা অনেক দিনের। সম্প্রতি তালেবানদের অগ্রযাত্রায় রাজধানী কাবুলের পতনের পর বিবিসি, সিএনএন এবং অন্যান্য চ্যানেলে প্রচারিত সংবাদের বদৌলতে আফগানিস্তানের হাড়ির খবর জানবার আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে। যদিও আফগানিস্তান এখন এক হত-দরিদ্র সার্কভুক্ত দেশ, এর রয়েছে এক সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এই উপমহাদেশের লোকেদের ভুললে চলবে না যে, মধ্যযুগের হিন্দুস্তানের শাসক শ্রেণির সবচেয়ে বড় অংশের যোগানদার ছিল এই আফগানিস্তানে জন্ম নেয়া বা আফগানিস্তানে থিতু হওয়া নানা গোত্রের মানুষ। আধুনিক যুগেও উপমহাদেশের রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য, সিনেমা-সংগীত, ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া অনেক খানেরা, কাপুরেরা, আফ্রিদিরা আজও স্বীয় মহিমায় উজ্জ্বল। তাদের পূর্বপুরুষের শিকড় ছিল আফগানিস্তানে। যে খাইবার গিরিপথ দিয়ে অতীতে পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই, মরুর ঝাঁঝালো বৈরিতা ফেলে সিন্ধু, পাঞ্জাব, গঙ্গা-যমুনার উর্বর ভূমির দিকে আসতো অভিবাসন প্রত্যাশী মানব সন্তানেরা, সেই গিরিপথের উপরে সরাইখানার মতো দাঁড়িয়ে থাকা আফগানিস্তানের আতিথ্য, নয়তো শত্রুতা-দুটোর যেকোনো একটা গ্রহণ করে তারপর এগুতে হতো। ইতিহাসের খেরোখাতায় তাই আফগানিস্তানের নাম সূচিপত্রের ধারে কাছেই রয়েছে।

আফগানিস্তানের নিজস্ব এলাকার ঘুর এবং গজনীতে গড়ে ওঠা শক্তিশালী রাজবংশের শাসনকালীন সময় ছাড়া বাকি সময়ে দেশটি পারস্য, গ্রীস, সেলুসিড, মৌর্য, কুশান, আরব, মঙ্গল, খোয়ারিজম, তিমুরীয় শাসকগণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাদশা বাবর পরগনায় তার পিতৃরাজ্য হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে দক্ষিণ ভারতে আসেন। ১৫০৪ সালে তিনি কাবুল এবং কান্দাহার দখল করেন। সেখান থেকে শক্তি সঞ্চয় করে নিজ পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় বিফল হলেও বাবর অন্য একটা চাঁদ হাতে পেয়ে যান। ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে ১৫২৬ সালে তিনি দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। তখন যুগপৎ ভারতের শাসক এবং কাবুল কান্দাহারের শাসক ছিলেন সম্রাট বাবর। কাবুলের সঙ্গে বাবরের বিশ বছরের সখ্যের কাছে ভারতের চার বছরের মিতালী অনেকটা মøান। তাই মৃত্যুর পর নিজের সমাধির জায়গা হিসেবে কাবুলকে বেছে নিয়ে সেখানে তার মৃতদেহ দাফন করার কথা বলে গিয়েছিলেন বাবর। তিনি তার জ্যেষ্ঠপুত্র হুমায়ুনকে দিল্লির উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। আর অপর তিন পুত্র কামরান মির্জা, আশকার মির্জা এবং হিন্দাল মির্জাকে কাবুল, কান্দাহার, গজনী ও বদকশান শাসনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এভাবে মোগলদের সময়ে কাবুল তথা আফগানিস্তান দিল্লি-আগ্রার সঙ্গে একসূত্রে গ্রথিত হয়।
বাবরের পুত্র হুমায়ুনের সঙ্গেও আফগানিস্তানের বন্ধুত্ব নিবিড়। হুমায়ুন যখন দিল্লির সম্রাট তখন তার ভ্রাতাগণ তার অনুগত আঞ্চলিক অধিপতি হিসেবে স্ব-স্ব এলাকা শাসন করতেন। দশ বছর হিন্দুস্তান শাসন করার পর হুমায়ুন যখন তার অধীনস্থ বিহারের শাসক শের শাহ কর্তৃক ১৫৪০ সালে আগ্রার সিংহাসন থেকে বিতাড়িত হন, তখন তিনি তার ভাই কামরান এবং আশকার মির্জার দিকে সাহায্যের আশায় দৌড়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু ভ্রাতাগণ তার দিকে হাত বাড়ালেন না। তখন আশ্রয়ের জন্য কোথায় যাবেন, সে চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত এবং নিঃস্ব হুমায়ুন প্রথমে সিন্ধুর থাট্টাতে গিয়ে কিছুদিন অনুগত এক অমাত্যের আশ্রয়ে থাকেন। তারপর সেখান থেকে যান পারস্যের শাহ তামাসপের দরবারে। তিনি হুমায়ূনকে সৈন্য-সামন্ত এবং অর্থ দিয়ে সহায়তা দেন। অতঃপর শাহের সহায়তায় এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতা হিন্দাল মির্জাকে সঙ্গে নিয়ে হুমায়ুন প্রথমে কান্দাহার, তারপর কাবুল দখল করেন। সেটা ১৫৪৫-৫১ সালের ঘটনা। তারপর হুমায়ুন কাবুল, কান্দাহার, গজনী, বদকশানের একচ্ছত্র শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৫৫৫ সালে শের শাহের মৃত্যু হয়। তার পুত্র ইসলাম শাহের দুর্বল শাসনের সুযোগে হুমায়ুন তখন দিল্লি পুনরুদ্ধার করেন। এভাবে দ্বিতীয়বার হিন্দুস্তানে মোগলদের বাদশাহী কায়েমের সোপান হিসেবে আফগানিস্তান কাজে লাগে। সেই থেকে মোগলের অধীন অন্য প্রদেশের মতো আফগানিস্তানের প্রদেশগুলি আগ্রা অথবা দিল্লি থেকে শাসিত হতো।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরীদের দুর্বল শাসনের সুযোগে মারাঠা, রাজপুত, শিখ, এসব আঞ্চলিক রাজ্য যেমন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তেমনি কাবুল, কান্দাহার, হেরাত, গজনী, পেশোয়ার নিয়ে এক আধুনিক আফগানিস্তানের জন্ম হয়। এই নতুন রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শাহ দুররানি ছিলেন ভয়ঙ্কর সেনাপতি নাদির শাহের অনুগত একজন সেনাধ্যক্ষ। তেহরানে নাদির শাহের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের খবর পেয়ে দুররানি ছুটে গিয়েছিলেন প্রভুকে রক্ষা করতে। কিন্তু তার পৌঁছাবার আগেই নাদির শাহ নিহত হন। দুররানি শুধু প্রভুর মৃতদেহটাকে দেখতে পেরেছিলেন, আর কব্জা করেছিলেন মহামূল্যবান রতœ কোহিনূর ও দরিয়া-ই-নূর। ১৭৪৭ সালে নাদির শাহের হত্যাকা-ের পরের বছর দুররানি আফগানিস্তানে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন এবং কালক্রমে এক শক্তিশালী শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। মারাঠাদের সঙ্গে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে ১৭৬১ সালে এই আফগান শাসক মারাঠাদের পরাজিত করেন। সেই পরাজয়ে উদীয়মান মারাঠাদের মেরুদ- ভেঙে গেলে বাংলা থেকে পশ্চিমে এগুতে ইংরেজের কাজ সহজ হয়ে যায়। ইংরেজরা ১৮১৮-১৯ সালে প্রথমে মারাঠাদের পদানত করে। ইতিমধ্যে শিখ এবং আফগান শাসকের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব উভয়কে দুর্বল করতে থাকে। আহমদ শাহ দুররানির দুর্বল উত্তরাধিকারীদের নিকট থেকে শিখ রাজা রণজিৎ সিং ১৮২৩ সালে পেশোয়ার দখল করে নেয়, যা আর আফগানদের কাছে ফেরত যায়নি। ১৮৪৯ সালে গুজরাটের যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিখ রাজা রণজিৎ সিংয়ের পুত্র দুলিপ সিংকে পরাজিত করে তার রাজ্য দখল করে নেয়। তার আগে ইংরেজরা ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের উপর আক্রমণ চালিয়ে দেশটি দখলে করে রাখে। তখনকার শাসক দোস্ত মোহাম্মদকে সরিয়ে দুররানি বংশের নির্বাসিত শাসক শাহ সুজাকে ক্ষমতায় বসানো হয়। কিন্তু ইংরেজদের এই আফগাননীতি সফল হয়নি। ১৮৪৩ সালে তারা বেকায়দা দেখে আবার দোস্ত মোহাম্মদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয় এবং ফেরার পথে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ১৮৭৮ সালে দ্বিতীয়বার ইংরেজরা কাবুল দখল করে। সেবার ক্ষমতায় ছিল দোস্ত মোহাম্মদের পুত্র শির আলী খান। তাকে সরিয়ে ইংরেজরা তার পুত্র ইয়াকুব খানকে আমির মেনে তার সঙ্গে চুক্তি করে যে, কাবুলে একজন বৃটিশ প্রতিনিধি থাকবে এবং আফগানিস্তানের বৈদেশিক নীতির দেখভাল করবে সেই প্রতিনিধি। অভ্যন্তরীণ শাসন থাকবে আফগানদের নিজেদের হাতে। এভাবে আফগানিস্তান একটি পরাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে আফগান শাসক ছিলেন হাবিবুল্লাহ খান। তিনি কোনো বিশ্ব শক্তির পক্ষে যুদ্ধ লড়তে চাননি। ফলে ১৯১৯ সালে তুরস্কের অনুসারী বিদ্রোহীরা তাকে হত্যা করে। তার স্থলাভিষিক্ত হন পুত্র আমানুল্লাহ খান। সিংহাসন গ্রহণের পর বৃটিশদের পররাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা খর্ব করে আমানুল্লাহ খান আফগানিস্তানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। ওই বছর আগস্ট মাসে রাওয়ালপি-িতে একটা চুক্তির মাধ্যমে বৃটিশ প্রশাসন আফগান স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯২৯ সালে আবার অস্থিরতা নেমে আসে। ক্ষমতা দখল করেন হাবিবুল্লাহ কালাকানি নামের এক দস্যু সরদার। তিনি মাত্র এক বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এরপর পিতা নাদির শাহের স্বল্পকালীন রাজত্বের পর আফগানিস্তানের বাদশাহ হন জহির শাহ। তিনি ৪০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী দাউদ খানের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে রাজার শাসন বিলুপ্ত হয় এবং রাষ্ট্রপতির শাসন আসে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে স্থিতি বজায় ছিল।
বিদেশি শক্তি যখন কোনো দেশ দখল করে সরাসরি শাসন করতে থাকে, তখন তাকে জোরপূর্বক নারীর সম্মানহানির সঙ্গে তুলনা করা যায়। আর যখন তারা ভেতরের পুতুল সরকার খাড়া করে সুবিধা লোটে, তখন তাকে পরকীয়া বলা যায়। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত আফগানিস্তান বৃটিশদের পরকীয়ার শিকার হয়েছিল। একই আদলে এবার সোভিয়েট রাশিয়ার আনাগোনা শুরু হয় ঊনিশ শত আশির দশক শুরুর আগে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন আফগানিস্তানকে কব্জা করে নেয়। তাদের অনুগত তাবেদার সরকারগুলি তখন দেশ চালাতে থাকে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এই বিদেশি আধিপত্য বজায় ছিল। চাপের মুখে ওই বছর সোভিয়েট বাহিনী চলে যাওয়ার পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আধিপত্য বিরোধী এবং আধিপত্য-সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলে। তাতে বাস্তুচ্যুত হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ, ধ্বংস হয় মূল্যবান স্থাপনা এবং প্রতিষ্ঠান। অবশেষে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটো জোটের শরিকগণ আফগানিস্তানকে পরকীয়ার রাহুমুক্ত করে নিজেরা সাক্ষী হয়ে তালেবানের সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দেয়। কিন্তু তালেবানের চালচলন ভালো নয়, তালেবান কট্টর, তালেবানের স্ত্রী পান-তামুক সেজে দেয় না, তালেবানের ঘরে সন্ত্রাসীরা প্রশ্রয় পায়, ইত্যাদি নানা অজুহাতে- যার কিছু কিছু কথা হয়তো সত্য- ২০০১ সালে ন্যাটো জোট বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আর-একজনের সঙ্গে আফগানিস্তানকে বিয়ে দেয়। কিন্তু ২০ বছর পর ২০২১ সালের আগস্ট মাসে এসে সে সংসারও গেল ভেঙে। সেই সুযোগে তালেবানের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ের সংসার শুরু হলো। তালেবানের প্রথম বিয়ে সুখের হয়নি। এবার দেখা যাক, এই দ্বিতীয় বিয়ে কতটা শান্তির হয়, কতটা মানিয়ে চলতে পারে তালেবান, আর কতটা তারা বিশ্ববাসীকে দেখাতে পারে যে, তাদের সংসার সুখের। তার জন্য কালের পরিক্রমার উপর নির্ভর করতে হবে আমাদের।
( গাজী মিজানুর রহমান সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট ও লেখক )
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর