× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার , ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ইতিহাসের কঠিনতম যুদ্ধপ্রান্তর আফগানিস্তান

মত-মতান্তর

ড. মাহফুজ পারভেজ 
২৫ আগস্ট ২০২১, বুধবার

কেন বছরের পর বছর যুদ্ধ চলে আফগানিস্তানে? কেন একের পর এক যুদ্ধেও ক্লান্ত হয় না আফগানিস্তানের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠী? ১৯৭৯ সাল থেকে সাম্প্রতিক অতীতের দিনগুলো পেরিয়ে চলতি ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪২ বছর কেটেছে রুশ, মার্কিন আর নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে। আর এখনও সেখানে বহাল যুদ্ধাবস্থা। যুদ্ধ যেন পিছু ছাড়ছেই না মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গমস্থলের দেশটকে। 
 
আসলে আফগানিস্তান হলো ইতিহাসের কঠিনতম যুদ্ধপ্রান্তর। খ্রিস্টপূর্ব আমলের সেই গ্রিক মহাবীর আলেকজান্ডার থেকে আর্য, শক, হুন, দল, তুর্কি, পারসিয়ান, মোঙ্গল ইত্যাদি বহু জাতি দক্ষিণ এশিয়ায় যাওয়ার পথে আফগানিস্তানে তুমুল যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে। প্রাচীন হেরাত, কান্দাহার, মাজার-ই-শরিফ, গজনি শহরের ধ্বংসস্তূপে মিশে আছে অসংখ্য দূর্গ ও যুদ্ধক্ষেত্র।
 
যে আফগানিস্তান একদা মধ্য এশিয়া থেকে আজকের পাকিস্তানের পেশোয়ার পর্যন্ত প্রসারিত ছিল বিভিন্ন পার্বত্য উপজাতি গোত্রে, তার পুরোটা কেউই দীর্ঘ সময়ের জন্য অধীনস্থ করতে পারেনি। অতীতেও যেমন পারে নি, বর্তমানে কেউ পারছে না।
 
এখনকার আমেরিকার মতো ১৯ শতক পরাক্রমশালী বিশ্বশক্তি ছিল বৃটিশরা। পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে দখল করলেও হিন্দুকুশ পর্বতের আদি বাসিন্দারা মাঝেমধ্যেই বৃটিশদের নাকাল করেছে। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে লড়াইয়ে নেমে পড়তেন তাঁরা যখন-তখন । 
 
বিব্রত ও বিরক্ত তৎকালীন ভারতের ব্রিটিশ শাসকগণ প্রথমে 'ধীরে চলো নীতি' গ্রহণ করলেও পরে হিন্দুকুশের ঝামেলা মেটাতে সামনে থেকে লড়তে শুরু করে ঔপনিবেশিক শক্তি।
একের পর এক পার্বত্য প্রদেশ দখল করে তারা। তৈরি করে রাস্তা, দূর্গ। সীমান্তের ওয়াজিরিস্তান এলাকায় উন্নয়নের কাজও করে।
 
 
কিন্তু তাতেও লাভ বিশেষ হয়নি। পার্বত্য-জঙ্গলের নিজস্ব স্বাধীন নিয়মে অভ্যস্ত আফগানদের অসুবিধাই হয়েছে এই অনভ্যস্ত জীবনে। স্বাভাবিকভাবে বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে শুরু হয় সম্মিলিত ‘জেহাদ’। ১৮৪২ সালে ১৬ হাজার ভারতীয়-বৃটিশ সেনার মধ্যে বেঁচে ফিরেছেন মাত্র অত্যল্প সংখ্যক। নতজানু হয়ে কাবুল ছেড়েছিল বৃটিশরা। বিজয়ী আফগান যোদ্ধাদের মতো সেই ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ কাবুলের কবরগাহ থেকে হয়তো দেখেছিলেন ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর, যার বংশধরদের নৃশংসভাবে হত্যা করেই বৃটিশরা দখল করেছিল দিল্লির দরবার, ময়ূরসিংহাসন এবং কোহিনূর খচিত রাজমুকুট।
 
মধ্য এশিয়ান বাবর আফগানিস্তানকে ভালোবাসতেন। কাবুলকে বলতেন 'আমার প্রিয় বাগিচা'। মধ্য এশিয়ার ফারগানায় জন্ম গ্রহণকারী এই বীর প্রথমে পিতা ও মাতার উত্তরাধিকার মোঙ্গল ও চুকতাই তুর্কিদের শহর সমরখন্দ, বোখারা দখল করতে চেয়েছিলেন। বার বার চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হন এবং ইরানি পারসিয়ান, উজবেকদের ধাওয়া খেয়ে চলে আসেন কাবুলে। কাবুল শুধু বাবরকে আশ্রয়ই দেয় নি, যে বিশাল ভারতবর্ষ শাসনের কল্পনাও তিনি করেন নি, সেটাকে হাতে তুলে নেওয়ার পথ দেখায়। 
 
অভাবণীয়ভাবে ভারতের রাজনৈতিক বিধাতা হলেও বাবর কখনোই কাবুলকে ভুলেন নি। অসিয়ত করেন, তাকে যেন কাবুলে সমাহিত করা হয়। সাম্রাজ্য উদ্ধারে ক্লান্তপুত্র হুমায়ুন অবশেষে ভারতের অস্থায়ী কবর থেকে বাবরের মরদেহ কাবুলে তুলে এনে পুনঃসমাধিস্থ করেন এবং সেখানে সৌধ ও উদ্যানে ভরিয়ে দেন।
 
বৃটিশদের মতো একই ঘটনা ঘটেছে রুশদের সঙ্গেও। আফগানিস্তানের দখল স্থায়ী করতে না পেরে ১৯৭৯ সালে অনুপ্রবেশের ১০ বছর পর ১৯৮৯ সালে পাততাড়ি গুটিয়েছে সাবেক কমিউনিস্ট রাশিয়াও। কেউ কেউ বলেন, সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পিছনেও আফগানিস্তানে পরাজয় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। 
 
রাশিয়া ও বৃটেনের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি, আমেরিকার কাছে ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতাও ছিল। ১৯৭৩ সালে প্রায় এক যুগ ধরে চলা সেনা অভিযান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল ওয়াশিংটন। ভিয়েতনামে একটি জোট সরকার গড়তে চেয়েছিল আমেরিকা, কিন্তু লাভ হয়নি। দুর্বল সেই প্রশাসন আসলে ভিয়েতনাম থেকে আমেরিকার চলে যাওয়ার রাস্তা প্রসারিত করেছিল। 
 
একই পুরনো ছবি দেখা যাচ্ছে আজকের কাবুলে। বৃটিশ ও রুশদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে আমেরিকা। যদি আমেরিকানরা টিকেছিল অনেক বেশি দিন, কুড়ি বছর, তথাপি আমেরিকাকে হটাতে লড়ে সফল হয়েছে তালেবান বাহিনী। ভিয়েতনামের জোট সরকারের মতো এক মেরুদণ্ডহীন, আমেরিকার বশংবদ আফগান সরকার তালেবানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছিল। আলাপের টেবিলের মতো মাঠের যুদ্ধেও তালেবানদের সামনে টিকতে পারে নি তাবেদার সরকার।
 
বরং আফগান মসনদে দ্রুত কর্তৃত্ব করেছে তালেবানরা। আমেরিকা চলে যাওয়ায় তারা রাজনৈতিক দিকের মতোই আরও শক্তিশালী হয়েছে সামরিক দিক থেকে। মনোবল ও মেরুদণ্ডহীন আফগান সরকার ও সৈন্যরা তাদের পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা চলে যেতেই তালেবান অগ্রাভিযানের মুখে সব কিছু ফেলে জান নিয়ে পালায়। সেইসব জব্দকৃত অস্ত্রে আরও শানিত ও সবল হয়েছে তালেবানরা। 
 
আফগানিস্তানে কখনোই অবৈধ অস্ত্রের অভাব ছিল না। সেসবের সঙ্গে আরও বিপুল অস্ত্র কাঁধে উঠেছে তালেবানের। তাতেই শক্তি বেড়েছে তাদের, বেড়েছে শক্তি প্রদর্শনও। তালেবানদের যে ছবি মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে, তাতে যেসব অস্ত্র দৃশ্যমান, যেগুলো আমেরিকা দিয়েছিল আফগান সরকারকে। যার মূল্য প্রায় ২৮০ কোটি ডলার। ২০০২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অস্ত্রভান্ডারের জন্য দেওয়া এই অর্থের পাশাপাশি সেনার প্রশিক্ষণ ও উন্নতির কাজে প্রায় ৮৩০ কোটি ডলার খরচ করেছিল আমেরিকা। ক্ষমতা দখলের পর এই বিপুল যুদ্ধ-সরঞ্জাম দখল করেছে তালেবান। দু’হাজার অস্ত্রবাহী গাড়ি, হামভি, যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার (যেমন, ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার), স্ক্যান ইগল ড্রোন ও বিমান, এ সবই এখন তালেবানের দখলে। 
 
সরজমিন তথ্যে কোনও কোনও মিডিয়া তালেবানদের কব্জায় আরও অস্ত্রের তালিকা দিয়েছে। যার মধ্যে অ্যাসল্ট রাইফেল এম ১৬, মর্টার, হাউৎজার, বডি আর্মার, নাইট গগল্স, আইইডি বিস্ফোরক, গ্রাউন্ড রকেট রয়েছে। এছাড়াও বিপুল অস্ত্র ভান্ডার, আমেরিকার তৈরি করা ‘বায়োমেট্রিক ডেটাবেস’, আমেরিকার সেনার ছেড়ে যাওয়া ঘাঁটি এসেছে তালেবান নিয়ন্ত্রণে। 
 
চলে যাওয়ার সময় আমেরিকানরা ইতিহাসের কঠিনতম যুদ্ধপ্রান্তর আফগানিস্তানকে আরও কঠিন পরিস্থিতি এবং আরও যুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে রেখে গেছে, যা থেকে শান্তিপূর্ণ উত্তরণ সত্যিই দুরূহ বিষয়। সামনের দিনগুলোতে আফগানিস্তানে বছরের পর বছর চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটবে, নাকি যুদ্ধাবস্থাই প্রলম্বিত হবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে, এসব প্রশ্নের উত্তর এবং বিদ্যমান সঙ্কটের সমাধান কেবলমাত্র আফগানিস্তানের মানুষের হাতে নেই। তারচেয়ে বেশি নির্ভর করছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির ইতিবাচক ভূমিকা এবং সদিচ্ছার উপরও।     
 
 
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর