× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ডেডলাইন তালেবান

মত-মতান্তর

ডা: রফিকুর রহমান
২৭ আগস্ট ২০২১, শুক্রবার

পরাজয়ের জায়গা থেকে সমঝোতায় কখনও জেতা যায় না। বারবার ছাড় দিতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা জোটের সেরকম একটা ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তালেবান তাদের বৈধ এবং শক্তিশালী প্রতিপক্ষ।
যুক্তরাষ্ট্র দুই দশকের যুদ্ধে তালেবানকে সামাজিক শক্তি থেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। সন্ত্রাসবাদের তকমা দিয়েও তাদের পরাভূত করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র যেখান থেকে শুরু করেছিল দুই দশক আগে আবার সেখানেই ফিরে এসেছে ।পুনরায় তালেবানের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে আফগানিস্তান থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। এসব প্রমাণ করে, তালেবান আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। তালেবান একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি যারা দীর্ঘ দুই দশক যাবত বিদেশী আক্রমণের হাত থেকে আফগানিস্তানকে রক্ষা করার জন্য প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।
যুদ্ধের মাধ্যমেই তালেবান আফগান জনগণের সমর্থন কুড়িয়েছে এবং নিজেরা বৈধ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পশ্চিমা শক্তি মুখে বলুক আর না বলুক তাদের বৈধতার প্রথম স্বীকৃতি এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দোহা চুক্তির মাধ্যমে । যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবান নেতৃত্ব পরস্পরের কাছাকাছি এসে একটি চুক্তি সম্পন্ন করে। এর মাধ্যমে তালেবান বৈধতা পায় এবং যুক্তরাষ্ট্র তালেবানকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করার সকল নৈতিকতা এবং যৌক্তিকতা হারিয়ে ফেলে।আফগানিস্তানের সরকার গঠনে তালেবান তাই একমাত্র বৈধ শক্তি। আফগানিস্থানে অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের পর যুক্তরাষ্ট্রেরই প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দেশ আফগানিস্তানের জনগণই তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে কোন বিদেশী শক্তি নয়।

কাবুল এয়ারপোর্ট থেকে উদ্ধার প্রক্রিয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা আরো কিছুটা বাড়তি সময় চায়। অপ্রকাশিত দোহা চুক্তি থেকে বিস্তারিত কিছু না জানা গেলেও সময়ে সময়ে এর কিছু কিছু অংশ নানাভাবে উন্মোচিত হচ্ছে।৩১শে অগাস্ট ডেডলাইন। অর্থাৎ এরমধ্যে পশ্চিমা জোটকে আফগানিস্তান থেকে চলে যেতে হবে ।এ রকমই একটা সমঝোতা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানদের মধ্যে। তালেবানদের তরফ থেকে ডেডলাইন অতিক্রম করলে কঠোর পরিণতি হবে বলে ইতিমধ্যে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। তালেবান ডেডলাইনকে এখন রেডলাইন হিসেবে ঘোষণা করেছে।
বরিস জনসনের এবং তার ইউরোপীয় মিত্ররা ইভাকুয়েশন প্রসেসের সময়সীমা দীর্ঘায়িত করার জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। জরুরী ভিত্তিতে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পন্থা বের করার জন্য ইতিমধ্যে জি সেভেনের একটা ভার্চুয়াল বৈঠকও সম্পন্ন হয়।জি সেভেন হচ্ছে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর পরিচালিত বিশ্ব ব্যবস্থার বর্তমান সময়ের একটি কাগুজে সংগঠন । প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, তিনি ডেডলাইন অতিক্রমের পক্ষে নয় কারণ এতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে ।যত তাড়াতাড়ি আফগানিস্তান থেকে চলে আসা যায় ততই মঙ্গল বলে মন্তব্য করেন।

বাস্তবতা হলো গত সোমবার সিআইএর পরিচালক এবং তালেবানের উপপ্রধান ও রাজনৈতিক শাখার প্রধান আব্দুল গনি বারাদারের সাথে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে যুক্তরাষ্ট্রে খবর প্রচারিত হয়। এক সময় এই দুই শক্তি একে অপরকে সন্ত্রাসবাদি হিসেবে চিহ্নিত করলেও বর্তমানে তাদের বেশ সময় কাটে আলোচনার টেবিলে। বৈঠক থেকে কোন সবুজ সঙ্কেত না পাওয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এখন ৩১ আগস্ট কে এই ডেডলাইন হিসেবে পুনরায় ব্যক্ত করেছেন। তার ভাষায় আফগানিস্তানে রয়েছে অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন যেমন আল-কায়েদা এবং আইএস, এবং ডেডলাইন অতিক্রম করলে কাবুল এয়ারপোর্টে থাকা মার্কিন সেনাদের উপর মারমুখো জঙ্গি আক্রমণ হয়ে যেতে পারে।

এৱপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে ব্যাপক সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করে বিমানবন্দর কে এড়িয়ে যেতে অনুরোধ করে খবর প্রচার করতে থাকে। এই সতর্কতার মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে বিমানবন্দরের বাইরে ভয়াবহ হামলায় প্রায় শতাধিক নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।আহত হয়েছে প্রায় দুই শতাধিক।হামলার দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)।আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এই হামলা একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ এবং আফগানিস্তানে তালেবানের অর্জনকে দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য।ডেডলাইনের আগে এ রকম হামলার আরো আশঙ্কা আছে।

বর্তমান অবস্থায় আফগানিস্তান তালেবানের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সেখানে আপাতত তাদের কোনো সরকার নেই।অন্য দিকে কাবুল এয়ারপোর্ট ন্যাটো সহ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তারা ক্ষণিক সময়ের জন্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে যার ডেডলাইন ৩১অগাস্ট। অন্য কথায় বলা যায়, মার্কিন সামরিক সেনারা বর্তমানে আফগানিস্তানে কোন তালেবান সরকারের সার্বভৌমত্বের মধ্যে নয়। সরকার গঠনের পর কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ সরকারি বাহিনী নিয়ে নেবে সেটাই স্বাভাবিক ।সে ক্ষেত্রে বিমানবন্দরে পাশাপাশি মার্কিন সেনাবাহিনী থাকলে সরকারের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।দোহা সমঝোতার মাধ্যমেই এই শান্তিপূর্ণ অবস্থানের ডেডলাইন ৩১ শে অগাস্ট নিশ্চিত করা আছে।ডেডলাইন পিছিয়ে যাওয়া মানেই তালেবানদের সরকার গঠনে বিলম্ব হওয়া। সম্ভবত এই কারণেই তালেবানদের হুঁশিয়ারি যে , ডেডলাইন অতিক্রম করলেই পরিণাম হবে ভয়বহ। তালেবান আর সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে চায় না ।দেশকে পুনর্গঠন করা খুবই জরুরি।

রাশিয়া চীনসহ আঞ্চলিক শক্তি গুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানকে পুনর্গঠন এবং তার জনগণের উন্নয়নের জন্য তালেবান সরকারের সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রতিবেশী ভারত নেই। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এই অঞ্চলে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। এর মূল কারণ বাস্তবতাকে প্রাধান্য না দিয়ে তারা দীর্ঘ দুই দশক আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি দিয়ে দেখেছে। কাশ্মীর তালেবানের মাথাব্যথার কারণ নয় এই মর্মে নিশ্চয়তা দেওয়ার পরও মোদি সরকার সহযোগিতার কথা বলেনি বরং তালেবানদের বিরুদ্ধে অশালীন ও বিরূপ মন্তব্য করেছে। ভারত দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টিয়ে আধুনিকায়ন না করলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতির রেশ অনেক দিন ধরেই চলবে। এবং এর রেশ ধরে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির সফলতার মুখ দেখা প্রায় অসম্ভব।

রাশিয়া ও চীন আফগান ইস্যুতে একই ধরণের অবস্থানে রয়েছে।গত বুধবার চীন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট টেলিফোনে একমত হয়ে বলেন, তারা আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করে, তারা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার উপর জোর দেয় এবং আফগান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে তারা সবসময় গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে।

আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি ও দীর্ঘদিনের পরিবর্তনগুলি দেখায় যে, বাইরের কোনো রাজনৈতিক মডেলগুলিকে জোর করে কোন দেশে চাপিয়ে দেয়া যায় না। তা কেবল ধ্বংস ও দুর্যোগে বয়ে আনে। প্রতিটি দেশেই অপ্রতিম (unique) তাই ভিন্নতা থাকবে।প্রতিটি দেশের সামাজিক প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক কাঠামো এবং আদর্শ গড়ে উঠবে সে দেশের ইতিহাস আঞ্চলিক অবস্থান সংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং জনগনের আশা-আকাঙ্খার উপর ভিত্তি করে। বিদেশী সংস্কৃতি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সামাজিক ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক আদর্শ অন্যদেশের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা গোটা বিশ্বকে অস্থিতিশীল করবে এবং তা কোন দেশের জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।

লেখক: চিকিৎসক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক।
[email protected]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর