× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার , ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ গঠনে উদারনীতি গ্রহণ প্রয়োজন

মত-মতান্তর

গাজী মিজানুর রহমান
৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, সোমবার

অনেকের মনে প্রশ্ন – কেন আফগানিস্তান বিষয়ে এত কথাবার্তা আর এত লেখালেখি চোখে পড়ছে? এর প্রধান কারণ আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চলে যাওয়া। এতে কেউ কেউ বেশি উৎসাহিত এবং আনন্দিত, আবার কেউ কেউ বেশি উদ্বিগ্ন। দ্বিতীয় কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়া কর্তৃক দেশটির বর্তমান অবস্থার উপর অবিরত সংবাদ প্রচার করা। আবার এর কোনো কোনো সংবাদ-প্রতিবেদন মানুষের কাছে একপেশে মনে হওয়ায় এগুলি উল্টোভাবে ঘটনাবলীর উপর আগ্রহ উস্কে দিচ্ছে। আফগানিস্তান বিষয়ে এ দেশের মানুষের আকর্ষণ বোধ করার আরো অনেক কারণের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– দেশটির সাথে আমাদের ঐতিহাসিক সম্বন্ধ। ভারতে বৃটিশ শাসনের সময়ে আমাদের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশি আফগানিস্তান সবসময় একটি ঘটনাবহুল দেশ ছিল। এর পাসতুন জনগোষ্ঠীর মানুষ আফগানিস্তান এবং উপ-মহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভাজিত হয়ে বসবাস করে। তাই দেশটির প্রতি এ অঞ্চলের মানুষকে আগে যেমন আগ্রহী করে তুলতো, এখনও তার রেশ রয়েছে।


৩১ আগস্টের সময়সীমা মেনে ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার পর নতুন এক আফগানিস্তানের যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে। সকলের মধ্যে একটা উৎকন্ঠা বিরাজ করছে যে, কেমন হবে সামনের তালেবান-শাসন। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের মত এখানে শক্ত শরিয়তী আইন চালু হবে, নাকি অন্য কিছু কিছু দেশের মত মিশ্র আইনী ব্যবস্থা চালু হবে – এ প্রশ্ন এখন সকলের মনে। তালেবান যেহেতু একটা ধর্মভিত্তিক দল, তাই তারা শরিয়তের সাথে সাংঘর্ষিক কিছুর অনুমোদন দেবে না, এটা আন্দাজ করা সহজ। তবে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটুকু বলা যায় যে, শরিয়ত-সমর্থিত উদার ইসলামিক শাসন ব্যবস্থার ভেতরে অনেকগুলি বিষয় নিষ্পত্তি না করলে তালেবানদের জন্য নানারূপ সংকট আসতে পারে ।

মানুষের উদ্বেগের একটা বড় জায়গা হচ্ছে, আফগানবাসীকে যেন ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ করে বিশ্বের নানা দেশে শরণার্থী হয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে না হয়। পবিত্র কোরআনের ২৩ নং সূরা (সুরা মুমিনুন) এর আয়াত নং ৮ এ বলা হয়েছে যে, মুমিন বা বিশ্বাসীদের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা প্রাপ্ত দায়িত্বকে এবং চুক্তিকে বিশ্বস্ততার সাথে রক্ষা করে। কুরআনের প্রখ্যাত অনুবাদক এবং তফসিরকারক আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী এই অনুশাসনের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, প্রাপ্ত দায়িত্ব দুই রকমের। একটা স্পষ্ট (এক্সপ্রেস ) এবং আরেকটা ইমপ্লায়েড (পরোক্ষ)। চুক্তির শর্তের মধ্যে লেখা না থাকলেও শাসন-ক্ষমতা গ্রহণের পর দল-বেদল নির্বিশেষে সাধারণ জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা শাসকের দায়িত্ব। এটা চুক্তিভূক্ত পারস্পরিক আস্থার অপ্রকাশ্য (ইমপ্লায়েড) একটি দফা। তাই বিশ্ববাসী আশা করে ইসলামী চিন্তাধারার নিশান-বরদার হিসেবে পরিচিত তালেবান তার ওয়াদা রাখবে ।

পবিত্র কোরআনের সুরা নং ৪৭ এর আয়াত ৪ এ বলা হয়েছে যে, যুদ্ধের সময় শত্রু কব্জায় এলে, তাকে হেফাজতে নিয়ে বেঁধে ফেলতে হবে । তারপর যুদ্ধ শেষে উদারতা অথবা মুক্তিপণের মাধ্যমে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা) ৬৩২-৬৩৪ সালে সিরিয়ায় পরিচালিত অভিযানের আগে গমনোদ্যত সেনাপতি ও সেনাদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন এভাবে – “ সৈনিকেরা দাঁড়াও । আমি তোমাদের কয়েকটি উপদেশ দিতে চাই । বিশ্বাসঘাতক হয়ো না । মৃতের শরীরে আঘাত করো না । কোনো নারী , শিশু , অতি বৃদ্ধ মানুষকে হত্যা করো না । ফলবান বৃক্ষ কেটে ফেলো না । বসতি ধ্বংস করো না । শত্রুর গরু , উট অথবা ভেড়া মেরে ফেলো না , যদি তা তোমাদের খাওয়ার প্রয়োজনে না হয় । খেজুর বাগান জ্বালিয়ে দিয়ো না বা পানি দিয়ে ডুবিয়ে দিয়ো না । যুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পদ আত্মসাৎ করো না । কাপুরুষতা প্রদর্শন করো না । ধর্মের উপাসনার জন্য ব্যবহৃত স্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার অভ্যন্তরে প্রার্থনারত মানুষদের অনিষ্ট করো না ।” এগুলি অনেকটা জেনেভা কনভেনশনের সাথে মিলে যায় । জেনেভা কনভেনশনের তের শত বছর আগে খোলাফায়ে রাশিদিনের যুগে ইসলামের এই যুদ্ধনীতি অনেক অগ্রগামী চিন্তার ফসল , এ কথা বলাই বাহুল্য ।

ন্যাটো বাহিনী চলে যাওয়ার পর দেশবাসীর নিজস্ব এবং টেকসই শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে আফগান সরকারের প্রধান দায়িত্ব । কাজেই ইসলামিক আদর্শের কথা বলে অন্য কারো দ্বারা বোমাবাজি , হত্যা , ধ্বংসযজ্ঞ আসবার পথ প্রশস্ত করতে বিন্দুমাত্র সুযোগ দেয়া উচিত নয় । যারা এটা করতে চাইবে তাদের নিবৃত করাই হবে শাসকের কাজ , সে যে সরকারই আসুক না কেন । আফগান জনগণের মধ্যে যারা আগের সরকারের সাথে কাজ করেছে , বিনা বিচারে তাদের শাস্তি আরোপও সমীচীন নয় ; অপরাধ করে থাকলে বিচার হতে হবে , তারপর শাস্তি । ধর্মীয় অনুশাসনের কথা ব’লে কোনো কাজ করতে হলে , এটাও দেখতে হবে যে , সেই অনুশাসনের পাশাপাশি ক্ষমা করার , উদারতা দেখানোর এবং সীমা অতিক্রম না করার উপর কোনো প্রাধান্য দেয়া আছে কিনা ; যদি থাকে তাহলে সেটাই করা উচিত ।

আত্মকলহে ক্ষতবিক্ষত আফগানিস্তান পুনর্গঠনে এখন দক্ষ জনশক্তি দরকার । দরকার শাসনব্যবস্থায় অংশীদারিত্ব নিতে পারঙ্গম নাগরিক । শিক্ষা এবং কারিগরি-জ্ঞান অর্জনকে প্রাধান্য না দিলে পরের উপর নির্ভশীল জাতি ছাড়া ভালো কিছু উপহার দেয়া যাবে না । নারীরা আগে যেসব জায়গায় কাজ করেছে , সেসব জায়গায় নতুন কর্মী পাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে । ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যত্যয় না করে শালীন পোশাকে নারীদের দেশ-সেবা করার আর শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ দেয়া উচিত বলে মনে করি । সেইসাথে চলমান নীতিমালা অনুযায়ী কৃষ্টি-কালচার মেনে যে সব বিদেশী উন্নয়ন কর্মী সাময়িকভাবে কাজ করতে আগ্রহী , তাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করাই শ্রেয় । দীর্ঘদিন থাকতে পারলে একটু-একটু করে সব সংস্কারের সুযোগ পাওয়া যায় । অন্যদিকে দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে গেলে অবস্থান হয় স্বল্পকালের ; স্বল্প সময়ে খুব বেশি কাজ করা যায় না । এসব কথা চিন্তা করে টেকসই শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে উদারনৈতিক মনোভাব পোষণ উপযুক্ত বলে প্রতীয়মান হয় । আফগানিস্তান কোন পথে হাঁটে এখন তা দেখার বিষয় ।

( লেখক সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট )
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর