২০১৩ সালে তালেবানরা আমেরিকার আশীর্বাদে কাতারের রাজধানী দোহায় একটি অফিস খুলেছিল। আন্তর্জাতিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে শান্তি-আলোচনায় ব্যস্ত থাকায় অফিসটি তালেবান কর্মকর্তাদের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে ওঠে। সেই সময়ে, তালেবান প্রতিনিধি মোহাম্মদ নায়েম কাতারের রাষ্ট্র-সম্প্রচারকারী আল-জাজিরা টেলিভিশনে গিয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে 'ইসলামপন্থী এই আন্দোলন বিশ্বের সব দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।'
দৃশ্যত 'এই' তালেবান আগের দফায় ক্ষমতাসীন 'সেই' তালেবানের চেয়ে ছিল পার্থক্যযুক্ত। মনে করা হয়েছিল যে, নতুন তালেবান ইনক্লুসিভ নীতিতে সবার সঙ্গে সমন্বয় ও সমঝোতার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকতার ভিত্তিতে চলবে। কিন্তু আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের পটভূমিতে ক্ষিপ্রগতিতে আফগানিস্তান দখল করে তালেবানরা তাদের অন্তর্নিহিত শক্তির প্রমাণ দিয়েছে। ২০২১ সালের মে মাসে আফগানিস্তান থেকে বাইডেন প্রশাসনের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা পর তালেবানের সশস্ত্র আঘাত বিশ্বকে হতবাক করেছিল। ১৫ আগস্ট তালেবানদের কাবুল প্রবেশের বীরোচিত ঘটনা বিস্মিত করেছিল সবাইকে।
আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রতিপক্ষের সমালোচনার বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করলেও 'প্রত্যাহারটি খারাপভাবে কার্যকর করার' অভিযোগ থেকে রেহাই পান নি। আফগান নাগরিকদের একটি সমুদ্রের মধ্যে হাবুডুবু খাওয়ার পরিস্থিতিতে একটি মার্কিন বিমান উড্ডয়নের ভাইরাল ভিডিওর মাধ্যমে এই বিশৃঙ্খলাটি সবচেয়ে ভালোভাবে প্রতীয়মান হয়েছিল।
তথাপি আফগান সামরিক বাহিনীর অযোগ্যতাকে বাইডেন কাবুলের পতনের জন্য দায়ী করেন এবং তালেবানদের সাথে একটি চুক্তি করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও অভিযুক্ত করেন। যে চুক্তি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিল।
গুরুত্বপূর্ণ সেই চুক্তিটি কাতারের রাজধানী দোহায় মার্কিন দূত এবং তালেবান উপ -নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার কর্তৃক ২ ফেব্রুয়ার ২০২০ সালে সম্পন্ন হয়। চুক্তি মতে, শান্তির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রধান শর্ত ছিল: তারা চায় যে তালেবান গোষ্ঠী আল-কায়েদা বা আইএস-এর মতো সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেবে না, যা পশ্চিমা জীবন ও স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলে। অস্থিতিশীল আফগানিস্তানে তালেবানদের শক্তি বৃদ্ধির পটভূমিতেই শান্তি আলোচনা হয়েছিল। সেই সময়ে দেখা গেল যে তালেবানরা যুদ্ধক্ষেত্রে লাভ করে আলোচনায় তার লিভারেজ নিতে চেয়েছে। তালেবানরা জানতেন, মদদপুষ্ট আফগান সরকারকে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম যুদ্ধকে একই রণাঙ্গনে হারাতে হবে। দোহায় আলোচনায় বসেই তারা রণাঙ্গনে বিজয়ের ছক কষেছিলেন।
আলোচনার প্রথমেই আফগান কর্মকর্তাদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করে তালেবানরা। কয়েক মাস ধরে ব্যর্থ আলোচনার পর কাতার অবশেষে জুনে যুদ্ধরত পক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠানিক মধ্যস্থতাকারী হওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কাতার তালেবানকে সামরিক দখল বন্ধ করতে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়। কাতারের মতোই আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুলরহমান আল-থানি, যিনি ক্ষমতাচ্যুত আফগান সরকার এবং তালেবানদের মধ্যে মধ্যস্থতা করেছিলেন, তিনিও শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেন। আলোচনার ফায়সালা যুদ্ধের ময়দানে নির্ধারণ করা ছাড়া আর কোনও বিকল্পই তখন অবশিষ্ট থাকে নি।
যদিও কাতারের মধ্যস্থতাকারীরা আফগান পক্ষগুলোর মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের টেবিলে ধরে রাখার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছেন, তথাপি দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির উপর তাদের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ কমই ছিল। তালেবান নেতৃত্ব আলোচনায় কখনোই একমত হন নি। তাদের একদল আলোচনায় একমত হলেও বাকি অর্ধেক তা মান্য করেন নি। তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আগ্রহী ছিলেন না।
কাতারের সমঝোতামূলক প্রচেষ্টা ছিল নিরপেক্ষ ও আনুষ্ঠানিক, যা তার বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। কারণ আরব বিশ্বে এবং এর বাইরেও দ্বন্দ্ব আর রাজনৈতিক বিরোধের প্রাথমিক মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠতে চেয়েছে কাতার। মধ্যপ্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হতে কাতারের আগ্রহ স্পষ্ট। সমালোচকরা যুক্তি দেখান যে, আফগানিস্তান ইস্যুতে দোহার ভূমিকা সামান্য হলেও তালেবানকে বৈধতা দিয়েছে। অন্যরা যোগ করেন যে, কাতারকে স্পষ্টভাবেই কাজে লাগানো হয়েছিল চরমপন্থী গোষ্ঠীকে তার শাসন পদ্ধতিগত দিক থেকে নরম করতে এবং ইসলামপন্থী বিশ্বদর্শনের সহিংসতা কমাতে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালের অক্টোবরে, কাতার একটি তালেবান প্রতিনিধি দলকে খ্যাতিমান ইসলামিক স্কলার শেখ ইউসুফ কারাজাভির সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করেছিল, যিনি আল-জাজিরা টিভিতে আরবি ভাষায় একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। ইউসুফ কারজাভির দায়িত্ব ছিল তালেবানদেরকে তাদের শাসন কাঠামোতে ইসলাম যে সহনশীল ভূমিকা পালন করতে পারে তা পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহিত করার। এই পদক্ষেপটি কাতারকে ঝুঁকি ফেললেও বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন যে, উদ্যোগটি শেষ পর্যন্ত ফল দিয়েছে।
কাতারের মধ্যস্থতাকারীর অবস্থান প্রসঙ্গে ইউরোপীয় কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনের উপসাগরীয় গবেষণা ফেলো সিনজিয়া বিয়ানকো বলেন, এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাজি ছিল, বিশেষ করে বৃহত্তর জনসাধারণের স্বার্থের প্রশ্নে যুদ্ধরত গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তিপূর্ণ মীমাংসা কঠিন কাজ। তবে কাতার আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনার প্রথম যোগাযোগ স্থান হিসাবে এবং শান্তি উদ্যোক্তা হিসাবে ভাল ভূমিকা পালন করেছে।
এমনকি, মার্কিন সেনাদল আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার মুখে হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনার জন্য দোহা তালেবানদের সাথে ফলপ্রসূ যোগাযোগ করেছে। দেশত্যাগী হাজার হাজার আফগানকে নতুন স্থায়ী দেশে স্থানান্তরিত না করা পর্যন্ত সাময়িকভাবে পুনর্বাসনের বিষয়ে তালেবানদের সম্মত করতে কাতারের প্রচেষ্টা সহায়ক হয়েছে।
তবে, কাতারের জন্য আসল পরীক্ষা হবে তালেবানদের বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোকে তুষ্ট করা এবং সেখানে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন অব্যাহত রাখা। কারণ, আফগানিস্তানের অর্থনীতির অর্ধেকেরও বেশি বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভরশীল, ৯০% জনসংখ্যা প্রতিদিন ২ ডলারে কমে জীবন চালায়। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো তালেবানকে যদি স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তাও বন্ধ করে দিতে পারে, যা ভয়াবহ আর্থিক বিপদের কারণ হবে। যদি কাতার সামনের দিনগুলোতেও বিশ্ব সম্প্রদায় এবং তালেবানকে আফগানদের স্বার্থে পারস্পরিক সহযোগিতায় রাজি করাতে পারে, তাহলে দেশটিতে একটি বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হতে পারে।