প্রথম পাতা

স্বীকার করলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী

রাজনৈতিক কারণেই বৃটেনের রেডলিস্টে বাংলাদেশ

কূটনৈতিক রিপোর্টার

২০২১-০৯-১৪

রাজনৈতিক কারণে বৃটেন বাংলাদেশকে রেড লিস্টে রেখেছে এমনটা স্বীকার করলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। গতকাল নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক কারণ হতে পারে। তা না হলে তারা আমাদের প্রতি এ বৈষম্য করবে কেন? আটকে পড়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিকদের লন্ডন ফেরায় অনিশ্চয়তা এবং এ নিয়ে প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ার কারণে এ দিনে অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৃটেন সফরের রেশ কাটতে না কাটতেই মন্ত্রী দেশটির নেতৃত্বকে রীতিমতো একহাত নেন। বৃটিশ সরকারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের নাগরিক যারা আপনার (বৃটেন) দেশ ভ্রমণে যেতে চায় তাদের গ্রহণ না করতে পারেন! কিন্তু যাদের জন্ম বৃটেনে, তাদের স্কুল-কলেজ খুলেছে, তাদের গ্রহণ করছেন না কেন? বাংলাদেশকে রেড লিস্টে রাখার কী রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে তা অবশ্য মন্ত্রী খোলাসা করেননি। ধারণা করা হচ্ছে বৃটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস প্রচারিত বৈশ্বিক মানবাধিকার রিপোর্ট নিয়ে ঢাকা-লন্ডন যে টানাপড়েন চলছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় তার প্রভাব রয়েছে। ওই রিপোর্ট প্রকাশের পর ঢাকা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। বৃটেনের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে আনা হয়েছিল। ভবিষ্যতে এমন রিপোর্ট তৈরি এবং প্রচারে বৃটেনকে আরও সচেতন থাকতে সতর্ক করা হয়েছিল। বৃটেনের তরফে অবশ্য এ নিয়ে প্রকাশ্যে পাল্টা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। তবে সর্বশেষ স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগে মানবাধিকার রিপোর্টে উল্লিখিত কয়েকটি বিষয় স্মরণ করে উদ্বেগ পুনর্ব্যক্ত করেছে বৃটেন। যার মধ্যে ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাব, বিধি-বহির্ভূত আটক, বিধি-বহির্ভূত বিচারপ্রক্রিয়া এবং বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। একই সঙ্গে তারা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চেয়েছে। তারা জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ এবং মতপ্রকাশ ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতের কথা বলেছে। লন্ডনে ৯ই সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ওই ডায়ালগে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনীতি, কূটনীতি, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ইস্যু, বাণিজ্য-উন্নয়ন অংশীদারিত্ব, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষাসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে কার্যকর আলোচনা হয়। তার দু’দিন আগে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাবের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল বৈঠক হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের। উভয় বৈঠকেই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে জোর অনুরোধ করে বাংলাদেশ। সেই সব অনুরোধের প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন গতকালের আলাপে বলেন- বৃটেন একটি নতুন নিয়ম করেছে রেড লিস্ট। ওই রেড লিস্টের কারণে আমাদের দেশে বহু বৃটিশ নাগরিক এসে আটকা পড়ে আছেন। সেই সংখ্যা ৫ থেকে ৬ হাজার হবে। এর মধ্যে আমার কিছু ভোটারও রয়েছেন, যাদের বাড়ি সিলেট এলাকায়। রেড লিস্ট হওয়ার কারণে তারা বৃটেনে ফিরতে পারছেন না। আমাদের দেশেরও অনেকে যেতে চান। অনেক বড় বড় নেতা যেতে চান, তাদের কাজ আছে। কিন্তু তাদের বাধা একটাই তা হলো ১০ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন। এজন্য প্রত্যেককে ২ হাজার ২শ’ ৮৫ পাউন্ড গুনতে হয়। এটা খামাখা, এক্সট্রা খরচ। তাই অনেকে যাচ্ছেন না। তারা প্রতিনিয়ত আমাদের ফোন করছেন। বলছেন, আপনারা রেড লিস্ট থেকে বাংলাদেশের নাম কাটানোর ব্যবস্থা করেন। আমি বৃটিশ সরকারকে বলেছি, আমাদের নাগরিকদের কথা বাদ দেন। যেসব বৃটিশ নাগরিক বাংলাদেশে আটকা পড়ে আছেন, যারা ফেরার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে গেছেন তাদের অন্তত গ্রহণ করুন। আপনারা আপনাদের নাগরিকদের নিচ্ছেন না, নাগরিকদের প্রতি সুবিচার করছেন না। অথচ সেই বৃটিশ নাগরিকদের প্রতি বৃটিশ সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাদের সুবিধা-অসুবিধা সরকারের (বৃটিশ) দেখা উচিত। মন্ত্রী ফের বলেন, আমাদের লোকজনের কথা ভুলে যান। আপনারা আপনাদের নাগরিকদের সেই সেবা দিবেন তো, নাকি? মন্ত্রী বলেন, বৃটেনে বসবাসরত নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য বাইরে থাকা দেশটির নাগরিকদের প্রতি সরকার অবহেলা করছে। দ্বিতীয়ত আফগানদের নিয়ে আসছে। অথচ আফগানরা এক ডোজ টিকাও গ্রহণ করেনি। টিকাবিহীন ওই লোকদের জন্য দরজা খোলা, অথচ নিজের নাগরিকদের ঢুকতে দিচ্ছে না! এটা ঠিক না মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, লন্ডন সফরকালে বিরোধী দুই-তিন জন এমপি’র সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। বাংলাদেশ কমিউনিটির অনেকে কথা বলেছেন। আমি সবাইকে বলেছি, আপনাদের এ নিয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত। বৃটিশ এমপিদের বলেছি আপনারা বাংলাদেশে আটকে থাকা বৃটিশ নাগরিকদের অসুবিধার কথা পার্লামেন্টে বলুন। অবশ্যই বৃটিশ সরকারকে তার নাগরিকদের দেখভাল করা উচিত। এটা সেই সরকারের দায়-দায়িত্ব। তারা পার্লামেন্টে বিষয়টি উত্থাপন করবেন বলে আশা করেন মন্ত্রী। ঢাকার  অব্যাহত অনুরোধ সত্ত্বেও বৃটেন কেন বাংলাদেশকে রেড লিস্টে রেখেছে? গণমাধ্যমের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী মোমেন বলেন, তারা এ নিয়ে একটা আর্গোমেন্ট করেছে। বলেছে, বাংলাদেশে নাকি ভ্যাকসিনেশন কম হয়েছে। আমি তাদের বলেছি, বাংলাদেশে করোনার কারণে মাত্র ক’জন লোক মারা গেছে। বৃটেনের লোক সংখ্যা বাংলাদেশের অর্ধেক। অথচ দেশটিতে যত লোক মারা গেছেন তার চেয়ে অর্ধেকের কম মারা গেছেন বাংলাদেশে। মন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশী ভারতে কত লোক মারা গেছেন। অথচ তাদের রেড লিস্ট থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে বৃটেন। এটাকে অন্যায্য সিদ্ধান্ত (আনফেয়ার) বলে মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, তখন তারা আমাকে একটি অংক দেখিয়েছে। বলেছে তোমার দেশে তো ভ্যাকসিন কম। আমি বললাম তোমরা তো আমাদের একটি ভ্যাকসিনও দেওনি। দ্বিপক্ষীয়ভাবে না দাও, কোভ্যাক্সের অধীনে তো দিতে পারতে। তখন অবশ্য বলেছে ভ্যাকসিন দিবে। তারা ভ্যাকসিন দিলে ভালো, না দিলেও সমস্যা নাই। বাংলাদেশ ২৪ কোটি ভ্যাকসিনের লাইনআপ করে ফেলেছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বাংলাদেশ ভ্যাকসিনেশন কম হওয়া সংক্রান্ত বৃটেনের অভিযোগ নাকচ করেন। একটি পরিসংখ্যান দেখিয়ে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত লোক সংখ্যা হচ্ছে ৪৯.৯ ভাগ। ষোল কোটি জনসংখ্যার দেশে প্রায় ৫০ ভাগ অর্থাৎ ৮ কোটি লোক হচ্ছে তরুণ। তাদের ভ্যাকসিন অপরিহার্য নয়। বাকি ৮ কোটির মধ্যে প্রায় ২৬ ভাগ লোককে সরকার প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন দিয়ে দিয়েছে। এটা কিন্তু একটা দেশের ভ্যাকসিনেশন প্রোগামে জন্য একেবারে কম না। প্রশ্ন ছিল বৃটেন তো টিকাধারীদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন থেকে অব্যাহতি দিতে পারে? সরকার এমন কোনো প্রস্তাব দিয়েছে কি-না? জবাবে মন্ত্রী বলেন, তারা করবে না। এ নিয়ে গণমাধ্যমকে ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশনকে প্রশ্ন করার পরামর্শ দেন মন্ত্রী। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুনিয়াতে ১৩৫টি দেশ বাংলাদেশের চেয়ে কম ভ্যাকসিন দিয়েছে। বড় লোকের দেশ, আমাদের চেয়ে উন্নত অনেক রাষ্ট্র এত লোককে ভ্যাকসিন দিতে পারেনি। এর মধ্যে ইউরোপের দেশও রয়েছে। কিন্তু বৃটেন সেই সব দেশের নাগরিকদের অ্যালাও করছে। এটা স্ট্রেইট ডিসক্রিমিনেশন।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status