× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

সা ক্ষা ৎ কা র /আগামী নির্বাচন নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নই

প্রথম পাতা

তারিক চয়ন
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, শনিবার

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আলী রীয়াজ ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়  স্টেট ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। তিনি সেখানকার সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রধান ছিলেন (২০০৭-২০১৭)। ২০১৭ সালে ডিস্টিংগুইশ্‌ড প্রফেসর হিসেবে তার নাম ঘোষণা করা হয় এবং ২০১৮ সালে প্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞানের থমাস ই আইমারম্যান প্রফেসরশিপ লাভ করেন। ড. রীয়াজ বাংলাদেশ এবং ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। লন্ডনে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে ‘ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট’ হিসেবে কাজ করেছেন। পাবলিক পলিসি স্কলার হিসেবে ‘উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস’- এ কাজ করেছেন। তিনি আটলান্টিক কাউন্সিল এর একজন নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো-ও। গেল বছর আলী রীয়াজ আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজ (এআইবিএস)-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
মানবজমিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে আলী রীয়াজ আফিগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসায় তার ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব, বাংলাদেশের নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া, রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ, যুক্তরাষ্ট্রের গেল নির্বাচনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন:

মানবজমিন: সম্প্রতি আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আবারো তালেবানরা  ফিরে এসেছে। বাংলাদেশ সহ এই অঞ্চলে এর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?
আলী রীয়াজ: ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর নামে আফগানিস্তান এবং অন্যান্য যেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা জড়িয়ে পড়েছিল, সে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত হয়েছে। এটা স্বীকার করতে হবে। আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের প্রতিক্রিয়াকে আমরা দু’ভাবে দেখতে পারি। একটি হলো- ভূ-রাজনৈতিক। তালেবানরা ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে অনেকের সাহায্য পেয়েছে। বিশেষ করে সুস্পষ্টভাবে চীন তাদের সমর্থন করছে। এই অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় চীন তার প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছিল। চীন এবং পাকিস্তানের যে মৈত্রী, যে সখ্য আসলে তারাই ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এছাড়া ইরানেরও পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে। এই যে মৈত্রী বা সখ্যের সমর্থন নিয়ে তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসা তা ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলবে। আফগানিস্তান এবং এই অঞ্চলে ভারতের যে প্রভাব ছিল তাও অনেকটা ক্ষুণ্ন হবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো- যারা তালেবানকে আদর্শিকভাবে অনুসরণ করে তাদের ওপর কি প্রভাব পড়বে। বিভিন্ন দেশে এটা বিভিন্নভাবে পড়বে। ভারতে পড়বে, বাংলাদেশে পড়বে, পাকিস্তানেও পড়বে। সেক্ষেত্রে তালেবানি আদর্শে তারা অনেক বেশি আগ্রহী, উৎসাহী বা উদ্দীপিত হবে এবং এটা বাড়বে। বাংলাদেশে একভাবে বাড়বে, ভারতের ক্ষেত্রে অন্যভাবে। আরেকটি বড় বিপদের জায়গা আছে- যদিও তালেবান বলেছে তারা তাদের ভূমি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে দেবে না, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় সেটা সম্ভব হবে না। আল-কায়েদার উপস্থিতির কথা বলা হচ্ছে। আইসিস’র উপস্থিতিতো আমরা সুস্পষ্টভাবে দেখতেই পাচ্ছি।

মানবজমিন: বাংলাদেশে ‘নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি’ চলছে বলে অনেকেরই অভিযোগ। আপনি প্রায়ই বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থাকে ‘হাইব্রিড রেজিম’- বলে উল্লেখ করেন। বিষয়টি যদি আরেকটু খোলাসা করে বলতেন...
আলী রীয়াজ: রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কিছু নেই। এ কথাটা এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করে। আমি বলবো যে, অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণের প্রচেষ্টা চলছে। এটা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। গত কয়েক বছর ধরে তার শক্তিশালী রূপ দেখা যাচ্ছে। রাজনীতিতো নিয়ন্ত্রণ করার কথা নাগরিকদের, দেশের মানুষদের। তারা কাউকে সমর্থন দেবেন বা দেবেন না? রাজনৈতিক দলগুলো সকল নীতি আদর্শ অনুসরণ করে, ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে চলবেন। একটা সুস্থ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কেউ বিজয়ী হবেন, কেউ হবেন না। সকলের সমাবেশের অধিকার থাকবে, কথা বলার অধিকার থাকবে। তাই নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র বা নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি না বলে বলা উচিত বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে কিছু গণতন্ত্রের উপাদান থাকছে। যেমন- আমরা মাঝেমধ্যে নির্বাচনের কথা শুনতে পাই। স্থানীয় নির্বাচনগুলো হচ্ছে। সেগুলো সম্পর্কে আপনারা সবাই কমবেশি জানেন। শুধু আমি-ই নই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যারা এসব গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করেন তারা সবাই বলছেন যে, এটাকে হাইব্রিড রেজিম বলে। হাইব্রিড রেজিম এ গণতন্ত্রের কিছু দৃশ্যমান উপাদান থাকে। যেমন- রাজনীতিতো সকলের জন্য নিশ্চিহ্ন করা হয়নি। কিন্তু রাজনীতি কি করা যাচ্ছে? সভা-সমাবেশ কি করা যাচ্ছে? বিরোধী দলগুলোর রাজনীতি কি সরকার গ্রহণ করছে? সরকার কি জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছে? এগুলোকে আমি বিরাজনীতিকরণের প্রচেষ্টা বলে মনে করি। প্রকৃতপক্ষে রাজনীতি বলতে যা বুঝায় তার অনুপস্থিতি। কিন্তু দৃশ্যত রাজনীতি আছে। কথাতো আমরা বলতেই পারছি। কিন্তু কতোটুকু কথা বলা যাবে সেটা বুঝা যায়, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের উপস্থিতি দেখে।

মানবজমিন: ২০২৩ সালের শেষ অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে উত্তেজনার পারদ শীর্ষে উঠছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন সুষ্ঠু করতে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থার জায়গায় নিতে কি ভূমিকা পালন করতে পারে? সার্চ কমিটির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন?্য নাম প্রস্তাব করার কথা শোনা যাচ্ছে। অনেকে নির্দলীয় কিংবা নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি জানাচ্ছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
আলী রীয়াজ: আমি আগামী নির্বাচন নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নই। আমার ধারণা, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে একটা নির্বাচন হবে। সেটা ২০১৮-তেও হয়েছে, ২০১৪- তেও হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন মানে হলো সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচন। রাজনীতিবিদরা বা রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করতে পারছে কিনা তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোটাররা ভোট দিতে পারছেন কিনা। আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। সার্চ কমিটির কথা বললেন। দুই দুইবার এই কাজটি করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানেতো এমন কোনো ব্যবস্থাই নেই! সংবিধানে লেখা আছে একটি আইন করা হবে। নির্বাচন কমিশনে কারা যাবেন সে বিষয়ে আইনটি করা হবে। ৫০ বছরেও তা করা হয়নি। আইন করাটা জরুরি এই কারণে যে তাহলে কার কি যোগ্যতা থাকা উচিত সেটা নির্ধারণ করা যাবে। দুই দুইবার সার্চ কমিটির লোকেরা কেন কার নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করলেন তাকি নাগরিকরা জানে? আমি কারো যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। কিন্তু যোগ্যতার ভিত্তিটাতো সবাইকে জানতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা আছে তবে সেটা কাগজে-কলমে, বাস্তবে নয়। কারণটা রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে কোন ধরনের নির্বাচন হবে। ২০১৮ সাল থেকে ভিন্ন কিছু কি দেখতে পান? আমি এখন পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচন, অবাধ নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের কিছু দেখতে পাচ্ছি না। সবকথার মর্ম কথা হলো- নিরপেক্ষ এক ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ভোটারদের সকলের ভোট দেয়ার নিশ্চয়তা বিধান করা যেন তারা ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। সে পরিবেশ আছে দেশে? অলৌকিকভাবে আগামী দুই বছরে সেটা পরিবর্তিত হবে না। সেজন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর সে সিদ্ধান্ত নেবেন ক্ষমতাসীনরা। তারা নিচ্ছেন কি? আমিতো তার কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না।

মানবজমিন: বিশ্লেষকরা বলছেন রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষের হাতে নেই। এমনকি সংসদে সরকার দলীয় এমপিরাও অভিযোগ করেছেন- রাজনীতি চালাচ্ছেন আমলারা, রাজনীতিবিদরা নন। এছাড়া, বড় দুই দলই নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
আলী রীয়াজ: এটা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমলাদের দ্বন্দ্বের প্রশ্ন নয়। আমলারা একটি শাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাশালী হয়েছে। যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছেন তারাই নির্ধারণ করেন ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা কেমন হবে। ‘ভাগ-বাটোয়ারা’ শব্দটা শুনলেই মনে হয় অশুভ একটা কিছু। কিন্তু রাজনীতিবিদরাতো তাই করেন। সেটা বৈধভাবে হতে পারে, অবৈধভাবেও হতে পারে। সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে হতে পারে, অংশগ্রহণ ছাড়া হতে পারে। সেই বিবেচনায় আমি এটাকে বলি ‘পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট’ বা রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। যে রাজনৈতিক বন্দোবস্তটি তৈরি হয়েছে তাতে ক্ষমতার কেন্দ্রে আমলা, রাজনৈতিক ‘এলিট’দের একটা একেবারে ছোট অংশ এবং যারা শক্তি প্রয়োগ করতে পারে এরকম  প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা ঐক্য তৈরি হয়েছে। তারাই ক্ষমতা চালাচ্ছে। যেসব রাজনীতিবিদ হতাশা প্রকাশ করেছেন, ‘রাজনীতি আর আমাদের হাতে নেই’ তাদেরকে আমি প্রশ্ন করতে চাই- এই প্রক্রিয়াটি তো হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়েনি। ক্ষমতাসীন দলের যারা এখন হা-হুতাশ করছেন, করুন। এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি প্রক্রিয়ার মধ্যে তো তারাই ছিলেন। এমনকি ক্ষমতাসীন জোটের বা এক সময় ক্ষমতায় ছিলেন কিন্তু এখন নেই তারাও বলছেন ‘রাজনীতি আর আমাদের হাতে নেই’। এই পরিস্থিতি কি একদিনে তৈরি হয়েছে? হাইব্রিড রেজিমে এরকম পরিস্থিতিই তৈরি হয়। সেখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। এক ধরনের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি হয়, যেখানে থাকে ক্ষমতা প্রয়োগের প্রতিষ্ঠান, সঙ্গে থাকে আমলাতন্ত্র, তার সঙ্গে থাকে রাজনৈতিক এলিটদের ছোট অংশ। ক্ষমতায় তো একটি রাজনৈতিক দল আছে। সেই দলের নেতাদের কেউ কি ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন না? করছেন। তাহলে ক্ষমতায় একেবারে যে রাজনীতিবিদরা নেই সে কথা বলবেন কি করে? কাজেই, এই হা-হুতাশ ভালো। ভালো এই অর্থে যে, এতদিন পরে হলেও এটা অনুধাবন করতে পেরেছেন। তবে এটা রাজনীতিবিদ আমলার দ্বন্দ্ব নয় বলে আমি মনে করি। যে শাসন অংশগ্রহণমূলক নয় সেখানে রাজনীতিবিদের প্রয়োজন কোথায়? যেখানে নির্বাচনই হয় আগেরদিন রাতে সেখানে তো রাজনীতিবিদের প্রয়োজন নেই। তার জন্য প্রয়োজন প্রশাসন।
মানবজমিন: তরুণরা এখন রাজনীতিবিমুখ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা সরাসরিই রাজনীতি পছন্দ করি না বা ঘৃণা করি জাতীয় মন্তব্য করে থাকেন। অনেকে ঢালাওভাবে বলছেন, দেশের মানুষ এখন রাজনীতিবিমুখ। আপনি নিজেও একসময় রাজনীতি করেছেন। সবমিলিয়ে এসবের কারণ কি বলে মনে করেন? এ থেকে উত্তরণের উপায়ইবা কি?
আলী রীয়াজ: তরুণরা রাজনীতি পছন্দ করে না এ কথাটা বিভ্রান্তিকর। ২০১৩ সাল থেকেই ধরুন, যতো আন্দোলন হয়েছে সেগুলো তরুণরাই করেছে। যেমন: শাহ্‌বাগ আন্দোলন (একমত হওয়া না হওয়া ভিন্ন প্রসঙ্গ), হেফাজত আন্দোলন (নেতৃত্ব দেয়নি, কিন্তু অংশগ্রহণ করেছে)। এছাড়া ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (শিক্ষার্থীরা শুরু করেছে) তরুণরাই করেছে। এগুলো প্রত্যেকটাই রাজনৈতিক। তাহলে তরুণরা রাজনীতি করতে চান না, তা নয়। প্রচলিত দলগুলোর আদর্শের প্রতি তাদের আস্থার অভাব রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সাথে যারা যুক্ত হচ্ছে তারা সুবিধালাভের আশায় তা করছে। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে যুক্ত তরুণ-তরুণীরা সুবিধা ভোগ করবেন- এটাই প্রধান ধারা হয়ে উঠেছে। বিরোধী দল বা দলগুলোর যে আদর্শিক অবস্থান, তারা এমন কিছু বলছে না যা তাদের আকর্ষণ করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে রাজনীতি করতে চাইলেও রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শের প্রতি এক ধরনের অনীহা তাদের রয়েছে।
এই পার্থক্যটুকু ধরতে না পারলে আপনি তাদেরই পক্ষ নেবেন যারা বিরাজনীতিকরণ করতে চাচ্ছে, যারা বলছে তরুণরাতো চায়-ই না রাজনীতি করতে। এই দেশের ভবিষ্যৎ কার? আমাদের মতো বৃদ্ধদের নয়, তরুণদের। তাকেই তো তার ভবিষ্যৎ তৈরি করতে হবে, সম্ভাবনার জায়গা সৃষ্টি করতে হবে, তাকেই তো লড়াই করতে হবে। তারা তা চায়। তাহলে প্রশ্ন আসে- তারা কেন তা করছে না? এক্ষেত্রে দুটো বিষয় কাজ করছে। একটি হলো- ভীতির সমস্যা। আইনি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে (যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন), রাজপথে ভীতির সঞ্চার করে এমন অবস্থা তৈরি করা হয়েছে যে, সে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। এ ভয়টা সবারই আছে। কিন্তু তরুণদের বেশি আছে। কারণ সে দেখছে ওই জায়গায় গেলে সে নির্যাতিত হচ্ছে। তরুণদের রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে ‘ক্রিমিনালাইজড’ করা হচ্ছে। রাজনীতি করা যেন অপরাধ! অন্যায়ভাবে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তাদের জেল খাটানো হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে এমন সব মামলা দেয়া হচ্ছে যেগুলো মাসের পর মাস ধরে চলছেই। এগুলো হয়রানি করা। দ্বিতীয় সমস্যাটা হলো কর্মসংস্থানের। এই যে লাখ লাখ তরুণ বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রাণপাত করছে এতে দেশের যে কি ভয়াবহ অপচয় হচ্ছে- এর মানে অন্য খাতগুলোতে কোনোভাবেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না।
মানবজমিন: যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুন্দর গণতন্ত্রের দেশেও গেল নির্বাচনের ‘ফল মানা’ নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা দেখা গেছে। এর প্রভাব কি এ অঞ্চলে তথা সারা বিশ্বেই পড়বে?
আলী রীয়াজ: সারা বিশ্বেই এর প্রভাব পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচন শুধু নয়; এদেশে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উত্থান, এক ধরনের বিভাজন সৃষ্টি এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করা এসব যা কিছু আমরা দেখতে পাচ্ছি সেগুলোর একটি বড় রকমের প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়ছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চেষ্টা তার সহায়ক হচ্ছে। চীন যেমন বলে, গণতন্ত্রের চেয়ে একনায়কতন্ত্র ভালো, আমাদের এখানেতো ৬ই জানুয়ারি ঘটে না, আমরাতো পরস্পরের বিরুদ্ধে এ রকম কাদা ছোড়াছুড়ি করি না- তাদের এসবকিছু বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তারচেয়ে বড় হলো, যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মানে হলো বিভাজনের রাজনীতির মধ্য দিয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তি অনেক বেশি প্রভাবশালী হচ্ছে। এগুলোর প্রভাবতো পড়বেই। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের সব জায়গাতেই তা পড়তে শুরু করেছে। সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্রকে আদর্শিকভাবে গণতন্ত্র প্রচার করতে হলে নিজের ঘর গুছাতে হবে, তার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে এবং সেটার একটা প্রক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটা একদিনে হবে না। আরেকটি জিনিস মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের দুইশ’ বছরের ইতিহাসে এই ধরনের সংঘাত সংঘর্ষ কিন্তু ছিল। এখন আমরা সেটার একটা ভিন্নরূপ দেখতে পাচ্ছি। এটা ইতিবাচক নয়। এটা গণতন্ত্রের জন্য  বৈশ্বিকভাবে ক্ষতিকারক। যুক্তরাষ্ট্রের এবং তার নাগরিকদের জন্যেও ক্ষতিকারক। কিন্তু ইতিবাচক দিকও আছে। ২০২০ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি মানুষ ভোট দিয়েছে। মহামারিকালে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ট্রাম্পের সমর্থকরা আদালতে গেলে আদালত বলেছে, ‘না, এটা ঠিকই আছে। কোনোরকম ত্রুটি হয়নি।’ চাপ তৈরি করেছে, তাতেও কোনো লাভ হয়নি। তার মানে প্রতিষ্ঠানগুলো সেই অর্থে শক্তিশালী না হলেও তাদের উপস্থিতি আছে। এগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতো একদিনে শেষ হয় না। এটা চলতেই থাকে। নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা, বর্ণগত সাম্য প্রতিষ্ঠা এসব যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের লড়াই। এটা প্রতিদিনের লড়াই। এ লড়াই চলতেই থাকবে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর