গত ৩০শে জুন চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর ২ নম্বর গেইট এলাকায় অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নালায় পড়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এরপর ২৫শে আগস্ট মুরাদপুর এলাকায় নালার পানিতে পড়ে তলিয়ে যান সালেহ আহমদ নামে এক দোকানি। গেল একমাসেও তার কোনো হদিস মেলেনি। ঠিক এক মাস ব্যবধানে সোমবার রাতে আগ্রাবাদে নালায় পড়ে সেহরিন মাহবুব সাদিয়া নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী নিখোঁজ হন। প্রায় ৫ ঘণ্টা তল্লাশি শেষে এই শিক্ষার্থীর লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। সোমবার রাত ৩টা ১০ মিনিটে ওই ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত শিক্ষার্থী সেহরিন মাহবুব সাদিয়া হালিশহর থানার বড়পুল মইন্যাপাড়া শুক্কুর মেম্বারের বাড়ির মোহাম্মদ আলীর মেয়ে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড় সাদিয়া চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল।
জানা গেছে, সাদিয়া তার নানা ও মামার সঙ্গে আগ্রাবাদের চশমা মার্কেট থেকে চশমা কিনে বাড়ি ফিরছিলেন।
তবে ফেরার পথে বাদামতলী মোড়ে পা পিছলে হঠাৎ নালায় পড়ে যান। এরপর সঙ্গে থাকা তার মামাও সঙ্গে সঙ্গে ড্রেনে ঝাঁপ দিয়ে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা ফায়ার সার্ভিসে খবর দিলে আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল এসে অভিযান শুরু করে। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি স্থানীয়রাও উদ্ধার অভিযান চালায়। শেষ পর্যন্ত রাত ৩টা ১০ মিনিটে সাদিয়ার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৩০ ফুট দূরে গভীরে নালায় আবর্জনার মধ্যে আটকে ছিলেন সাদিয়ার দেহ। প্রায় ৫ ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশনের দু’টি ক্রেন দিয়ে প্রায় এক টন আবর্জনা অপসারণের পর মিলে তার নিষ্প্রাণ দেহের সন্ধান। এই বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক নিউটন দাশ বলেন, রাত ১০টার দিকে সাদিয়া নামে এক তরুণী নালায় পড়ে যায়। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস এসে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। প্রায় ৫ ঘণ্টা উদ্ধার অভিযান শেষে আমরা তার মৃতদেহ উদ্ধার করি। এদিকে দিন দিন নগরবাসীর কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এইসব নালা ও খাল। নালায় পড়ে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। সবমিলিয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা এইসব অরক্ষিত নালায় পড়ে সর্বশেষ ৩ মাসে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই মারা যাওয়াদের ২ জন নারী।
জানা যায়, জলাবদ্ধতার নিরসন প্রকল্পের আওতায় নগরের নালা ও খালগুলোর সংস্কার কাজ চলছে। চলতি বছরের এপ্রিলে শুরু হওয়া এই মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে এখনো। কাজের সুবিধার জন্য খুলে ফেলা হয়েছে নালার ঢাকনা। ইতিমধ্যে অধিকাংশ নালার সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সেখানে এখনো ঢাকনা তথা পাটাতনগুলো বসানো হয়নি। অনেক পাটাতন ইতিমধ্যে চুরি হয়ে গেছে বলে জানা যায়। পাশাপাশি খালগুলোর পাশে নিরাপত্তা দেয়াল দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। যার ফলে ড্রেন ও খালগুলো এখন পুরোপুরি অরক্ষিত হয়ে নাগরিকদের মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে ওঠেছে।
এদিকে এইসব নালা ও খাল অরক্ষিত রাখার দায়ভার নিতে নারাজ এখানকার দুইটি প্রধান সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশন বলছে, এইসব নালা ও খালের যে সংস্কার কাজ চলছে তার নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। আর সিডিএ বলছে, সংস্কার কাজ চালাচ্ছে সিটি করপোরেশন। তাই নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্বও তাদের।
এদিকে নগরের বিভিন্ন নালা অরক্ষিত থাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর মৃত্যুসহ সব দুর্ঘটনার দায়ভার কার জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন মানবজমিনকে বলেন, ‘বিষয়টা আমাদের জন্য আসলেই লজ্জাকর। সংস্থাগুলোর মাঝে কোনো সমন্বয় নেই। যার ফলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। আর সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে।’ চট্টগ্রামের এই প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘সিডিএ বলে নালার উপর পাটাতনগুলো লাগানো, ঘেরাও দেয়া সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। আবার সিটি করপোরেশন বলে সিডিএ’র দায়িত্ব। এভাবে দোষারোপ করে তো কাজ হবে না। দায়িত্ব সকলের। আমরা যখন দায়িত্বে আছি, আমাদের সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। কোনোভাবেই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।’