সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ‘শান্তি ও নিরাপত্তার’ উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যকে নতুন সামরিক জোট ‘অকাস’ ঘোষণা করেছেন। যদিওবা বহু প্রতীক্ষার পর চলতি বছরে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের আলোচিত সামরিক জোট ‘ কোয়াড’ আলোর মুখ দেখে। আগামী ২৪শে সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউজে কোয়াডের বৈঠকের আগ মুহূর্তে নতুন এই সামরিক জোটের ঘোষণা এলো।
‘অকাস’ ঘোষণায় বলা হয়েছে, সদস্য দেশসমূহ পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতা করবে এবং যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্র্রেলিয়াকে নিরাপত্তার জন্য পরমাণবিক সাবমেরিন প্রদান করবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো কোন ধরনের রাখঢাক না রেখেই এই জোটকে ‘চীন ঠেকাও’ জোট বলছে। অকাস হওয়ার পর চীন বলছে, এই সামরিক জোট ১৯৬৮ সালের এনপিটি চুক্তি বা পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির বিরোধী। ‘অকাস’ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ফ্রান্স। ফ্রান্সের সাথে সাবমেরিন কেনার চুক্তি থাকা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়া ‘অকাস’ চুক্তিতে যাওয়ায় ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছে ফ্রান্স।
‘অকাস’ গঠন ও এর প্রতিক্রিয়া বেশ কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে।
কোয়াড থাকতে আবার কেন নতুন ইন্দো প্যাসিফিক সামরিক জোট প্রয়োজন হলো! যুক্তরাষ্ট্র কোয়াড গঠনের পর আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও তুর্কেমেনিস্তানকে নিয়ে নতুন কোয়াড করারও ঘোষণা দিয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাডেজি বা আইপিএসে যোগ দিতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে আহবান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই জোট খোলার উদ্দেশ্য কি আসলেই চীন ঠেকানো! যেখানে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের বাজার চীনা পণ্যে সয়লাভ। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ও হাজারো প্রকল্প নিয়ে আগানো অর্থনৈতিক চীনকে কেন সামরিকভাবে ঠেকানোর পরিকল্পনা হোয়াইট হাউজের!
কোয়াড হওয়ার সময় নিরাপত্তা, প্রযুক্তি ও উৎপাদন, সরবরাহ চেইন তৈরির কথা বলা হয়েছিল। ভারতের উৎপাদন ক্ষমতা, অস্ট্রেলিয়ার প্রযুক্তি, জাপানের অর্থ আর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের একটা সমন্বয় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোয়াডের সামরিক সম্পর্কই দৃশ্যমান শুধু। বিপরীতে চীন তার অর্থনীতিকে চাঙা রেখেছে। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে চীন-ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক ৬৭% বেড়েছে বলে দ্য হিন্দু খবর প্রকাশ করেছে। এই ছয় মাসে দুই দেশের মধ্যে ৫৭.৪৮ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। দু’দেশের সম্পর্ক মধুর না থাকলেও ২০১৯ সালে ৮৫.৫ বিলিয়ন ও ২০২০ সালে ৭৭.৭ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করে চীন ভারতের শীর্ষ বাণিজ্য সহযোগী হয়েছে।
করোনা নিয়ে চীনকে দোষারাপ আগ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ছিল চীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, ২০১৯ সালে দুই দেশের মধ্যে ২৪০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। ২০১০-২০২০ সালের ১.১ ট্রিলিয়ন বিদেশী বিনিয়োগের ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ও চীন অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ট বিদেশী বিনিয়োগকারী দেশ। ২০০৭ সালের পর শুধুমাত্র ২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় চীনের বিনিয়োগ নি¤œমুখী ছিল, সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা রিপোর্ট বলছে তবুও সে বছর ২.৫ বিলিয়ন ডলারের চাইনিজ বিনিয়োগ হয়েছে। ২০২০ সালে চীন যে ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে তার প্রায় ৫০০ বিলিয়ন গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, ২০% গিয়েছে ইউরোপে, এখনো জাপান চীনের তৃতীয় বাণিজ্য অংশীদার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি আমদানি করে চীন থেকে আর চীন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় রফতানি বাজারও।
তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে এখন খাদ্য সংকট দূর হওয়ার পর অবকাঠামো উন্নয়নের যে চাহিদা তৈরি করেছে সেখানে একচেটিয়া দখল নিচ্ছে চীন। চায়না এশিয়ান ইনফ্রাসট্রাকচার ব্যাংকে ১০০ বিলিয়ন বিনিয়োগ করে এডিবির একটা বিকল্প তৈরী করে দিয়ে এশিয়ার ছোট দেশগুলোকে। চাইনিজ ডেভেলভমেন্ট ব্যাংক বর্তমাানে বিশ্বের ৩৭ টি দেশে ৪০০ টি প্রজেক্টে ১১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। চীনের বিআরই প্রকল্পের অধীনে চীন বিশ্বের ৪০% জিডিপি ও ৬০% জনসংখ্যার উপর তার নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়। এমনকি বিআরইয়ের জন্য যে ৪-৮ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে তা বিশ্বের ৬০ টি দেশের জিডিপির সমান।
চীন তার বৈরি দেশসমূহের বাজারও দখলে রেখেছে। সে বিনিয়োগ দিয়ে তার প্রভাব তৈরি করতে চায়। গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ‘ওয়ার অন টেরর’ ঘোষণা দিয়ে তার ভূরাজনীতি, অস্ত্রের ব্যবসা করেছে। এখন ‘চীন ঠেকাও’ নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র তার অস্ত্রের ব্যবসা ও ভূ-রাজনীতি প্রসার করছে। ‘কোয়াড’ ও ‘অকাস’ গঠন তা অনেকটা স্পষ্ট করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বলে শত্রুদেশ ও গোষ্ঠীকে শায়েস্তা করেছে। আরব বসন্তের নামে আরব অঞ্চলে গণতন্ত্রের রফতানি করে নিজের ফায়দা হাসিল করেছে। তাদের দৃষ্টি এখন ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে এবং অস্ত্র চীনাফোবিয়া। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালে সৌদি সফরে গিয়ে ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি চুক্তি করলেন, তার পরপরই কাতারের উপর অবরোধ দিলো সৌদি জোট। ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা যুক্তরাষ্ট্রকে তার অস্ত্রের বাজার তৈরি করে দেয়। ফলে প্রধান বিনিয়োগকারী যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সাবমেরিন কিনতে হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াকে। ২০২০ সালের শুরুতে ট্রাম্প ভারত সফর করে ৩০০ কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি করিয়ে নিলেন ভারতকে। ধীরে ধীরে ভারতের সামরিক বাহিনীকে রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রমুখী করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সামনের দিনে চীন-ভারত সংঘাত ও ভারত-পাকিস্তান সংঘাতকে উৎস করে ভারত হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় অস্ত্রের বাজার।
কিন্তু চীনকে ঠেক্কা দিতে ভারতের দরকার বিনিয়োগ, বিশ্ববাজারে নিজের পণ্য পাঠানো, মানবম্পদ উন্নয়ন, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি। অস্ত্র কিনে বা বিক্রি করে অথবা সামরিক জোট গঠন করে চীনকে ঠেকানো যাবে না। চীনের লক্ষ্য বিশ্বের প্রতিটি মানুষের হাতে তার পণ্য পৌঁছানো। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক প্রতিযোগিতায় তার আগ্রহ বা সক্ষমতা নেই। বিশ্বের ৮০টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ৮০০ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে যার জন্য পেন্টাগন প্রতিবছর ব্যয় করে ১৫০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে চীনের একটি বিদেশি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে জিবুতিতে। ৯/১১ পরবর্তী ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বলে ৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের সামরিক ব্যয় করেছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট যেখানে ৭১২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে চীনের ২০৯ এবং ভারতের ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফলে সামরিক দিক দিয়ে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহু পিছিয়ে আর ভারত চীন থেকে বহু পিছিয়ে রয়েছে। চীন চায় অর্থনৈতিক শক্তি হতে। সে অর্থনৈতিক শক্তিকে মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করছে সামরিক জোট। কারণ যুক্তরাষ্ট্রকে তার অর্থনীতি চাঙা রাখতে অস্ত্র বিক্রি করতে হবে। আর অস্ত্র বিক্রি করতে তার মিত্রদের সামনে একটি শত্রু দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র সে শত্রু পেয়েছে চীনকে। চীনকে মোকাবেলায় জোট জোট খেলায় অস্ত্র বাণিজ্যে ফেলে ফুঁপে উঠবে যুক্তরাষ্ট্র।
লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগসাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি