× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

অনুদার গণতন্ত্র ও উত্তম 'জার' পুতিন

মত-মতান্তর

ড. মাহফুজ পারভেজ
৫ অক্টোবর ২০২১, মঙ্গলবার

'ইলিবারেল ডেমোক্রেসি'র বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে 'অনুদার গণতন্ত্র'। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর রুশ দেশে ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক চর্চায় 'অনুদার গণতন্ত্র' কথাটি জোরেশোরে আলোচিত হতে থাকে।

সর্বপ্রথম ব্যাপক আকারে এই সংক্রান্ত আলোচনা পাওয়া যায় ফরিদ জাকারিয়ার 'দ্য ফিউচার অব ফ্রিডম: ইলিবারেল ডেমোক্র্যাসি অ্যাট হোম অ্যান্ড এবরোড' গ্রন্থে। চট্টগ্রাম ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মো. আবদুর রশীদ বইটির অনুবাদও করেছেন, যাতে রাশিয়ার বর্তমান নেতা ভ্লাদিমির পুতিন সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য রয়েছে। যেমন, 'পুতিন হলেন একজন উত্তম জার। তিনি একটি আধুনিক রাশিয়া গড়তে চান। তিনি বিশ্বাস করেন যে, রাশিয়ায় প্রয়োজন শৃঙ্খলা এবং কার্যকর রাষ্ট্র-ব্যবস্থা, যার ভেতর দিয়ে দেশটির অর্থনীতি উদার করা সম্ভব। এ ধরনের যুক্তি উদার স্বৈরশাসকদের পক্ষের।
তবে মোটেও গণতন্ত্রের পক্ষে নয়।'

কমিউনিস্ট-পূর্ব রাশিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের শাসকদের পদবি ছিল 'জার'। গণতন্ত্রেও যে স্বৈরতান্ত্রিক-রাজতান্ত্রিক জার হওয়া যায়, তার প্রমাণ পুতিন। এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে। যেমন হিটলার। প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা নিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গণতান্ত্রিকভাবে বিজয়ী হয়েছিলেন হিটলাম। কিন্তু প্রকৃত মূল্যায়নে তিনি ছিলেন একনায়ক, স্বৈরশাসক। শুধু হিটলার বা পুতিন নন, গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে এমন রূঢ় চরিত্র আরও রয়েছে। ফরিদ জাকারিয়ার সৌভাগ্য হলো, মার্কিন দেশের মুক্ত পরিবেশে থেকে তিনি সেসব কথা বলতে পারেন। অন্যত্র এসব অনুধাবণ করা গেলেও বলা যায় না।

২০ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণকারী ফরিদ রফিক জাকারিয়া হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন লেখক ও সাংবাদিক। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তার লেখালেখির মূল বিষয়বস্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতি। তিনি সিএনএনের ফরিদ জাকারিয়া জিপিএস অনুষ্ঠানের উপস্থাপক এবং দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর কলাম লেখক। এছাড়া তিনি নিউজউইক-এর কলাম লেখক, নিউজউইক ইন্টারন্যাশনাল সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক, টাইম ম্যাগাজিনের সহ-সম্পাদক, এবং ফরেন অ্যাফেয়ার্স-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন। ফলে তিনি অবলীলায় তার নিজের দেশ ও বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থার চুলচেরা মূল্যায়নে পারঙ্গম। গগণতন্ত্রের বাতাবরণে 'অনুদার গণতন্ত্র'কে শনাক্ত করতেও তিনি সক্ষম।

শুধু গণতন্ত্রেই নয়, সমাজতান্ত্রিক শাসনেও বহু অসঙ্গতি দৃশ্যমান। যেমন, বর্তমান চীনে সমাজতন্ত্রের কোন চিহ্নই নেই। তারপরও 'কমিউনিস্ট পার্টি' নামটি ব্যবহার করা আসলেই অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। অথচ সেখানে দলের নামে ব্যক্তি ও নেতার শাসন চলছে।

বিশ্বায়নের ফলে উদার ব্যবস্থা ও আর্থিক উন্নতির সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্কও নানাভাবে বদলে গেছে। বৈশ্বিক আর্থিক উন্নয়ন ধারায় গরিবের একদম কিছু হচ্ছে না, তেমন নয়। গরিবও এগোচ্ছে বটে। তবে, ধনী এগোচ্ছে ঢের বেশি। বাস্তবতা হলো এই যে, ধনী এগোচ্ছে খরগোশের গতিতে আর গরিব এগোচ্ছে শামুকের গতিতে। বিশ্বের দেশে দেশে অতি ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির সুতীব্র হার সুস্পষ্ট। এতে দেশগুলোর গড় আয় বৃদ্ধির পরিসংখ্যানও বাড়ছে। কিন্তু এই বৃদ্ধি ভারসাম্যপূর্ণ নয়। কারণ, অর্ধেক শরীর ফ্রিজে, অর্ধেক শরীর চুল্লির মধ্যে থাকলে সব মিলিয়ে গড়ে নাতিশীতোষ্ণ বলা গেলেও তা কিন্তু বিপজ্জনক। সেজন্য মানুষ এসব উন্নতির পরও সমতা ও সুশাসনের অভাবে অসন্তুষ্ট। গণতন্ত্র ও অনুদার গণতন্ত্র সম্পর্কে চিন্তিত।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও পণ্ডিতগণ রাষ্ট্র এবং সমাজ নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন এবং প্রতিনিয়ত করছেন। এসব মৌলিক গবেষণার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ে তাত্ত্বিক ধারণা তৈরি হয়, এমন গবেষণা। অনেক গবেষণাগ্রন্থে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতান্ত্রিক নাম ধারণ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক চরিত্রের হয় না। সমাজে, দলে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ও চর্চায় অনুদার গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রহীনতার প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়। গণতান্ত্রিক মাস্কের আড়ালে লুক্কায়িত থাকে স্বৈরতন্ত্র, দলতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, একনায়কতন্ত্রের কুৎসিত মুখ।

পৃথিবীর প্রায়-সকল দেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা—এসব সুন্দর সুন্দর কথা আছে অনেক। সংবিধান হলো সর্বোচ্চ আইন, যা রাষ্ট্রের ও জনগণের ‘ইচ্ছার’ প্রকাশ। কিন্তু ঘোষণা দিলেই অটোমেটিক তার বাস্তবায়ন হয়ে যাবে, এমন কোনেও কথা নেই। যেজন্য তা সঠিকভাবে কার্যকর এবং জনস্বার্থে পরিচালিত হতে হয়। দলীয় বা কোটারি স্বার্থে নয় এবং এটি প্রয়োগও হতে হবে জনগণের স্বার্থে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এবং বহু দেশেই তা হয় না। ফলে ভোট ও ভাতের অধিকার সমান্তরালে চলে এবং গণতন্ত্র ও আর্থিক মুক্তির লড়াইও চলতেই থাকে। অনুদার গণতন্ত্র ও নব্য 'জার'দের চিহ্নিত করা থেমে থাকে না। অতএব, শুধু রাশিয়ার পুতিন নন, এশিয়া-আফ্রিকার আরও বহু দেশে অনেক শাসকের চেহারায় প্রতিবিম্বিত জারের প্রচ্ছায়া বিদূরিত করা গণতন্ত্রের একটি আবশ্যিক প্রত্যাশা রূপে স্বীকৃতি লাভ করে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর