× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

উত্তর কোরিয়া: মাদক অস্ত্র, সন্ত্রাস ব্যবহার করে শাসকগোষ্ঠী যেভাবে ক্ষমতা ধরে রেখেছে

দেশ বিদেশ

লরা বিকার, বিবিসি নিউজ, সিউল
১৬ অক্টোবর ২০২১, শনিবার

গোপনীয়তার অভ্যাসটা এতোদিনেও ছাড়তে পারেননি কিম কুক-সং। তার একটি ইন্টারভিউ পেতে কয়েক সপ্তাহ ধরে তাকে বোঝানো হয়েছে। তবু তার ভয় যায় না। ইন্টারভিউ শুনে কে না কী বলে!
তিনি ক্যামেরার সামনে এলেন কালো সানগ্লাস পরে। তিনি যে নাম ব্যবহার করছেন, সেটি সত্যি যদি তার আসল নাম হয়, তাহলে সেই নাম আমরা মাত্র দু’জন জানি।

মি. কিম উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাধর গুপ্তচর সংস্থায় ৩০ বছর ধরে কাজ করেছেন। এই সংস্থাটি হচ্ছে ‘উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতার চোখ, কান এবং মগজ,’ বলছেন তিনি। তিনি দাবি করছেন, তিনি উত্তর কোরিয়ার নেতাদের সব গোপন খবর জানেন, তাদের সমালোচকদের হত্যা করতে তিনি হত্যাকারী পাঠাতেন, এবং এমনকি ‘বিপ্লবের’ জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে অবৈধ মাদক কারখানাও খুলেছিলেন।

এখন উত্তর কোরিয়ার এই সাবেক কর্নেল বিবিসির কাছে সবকিছু ফাঁস করে দিয়েছেন। প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমের কাছে পিয়ংইয়াংয়ের কোনো শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার এটাই প্রথম সাক্ষাৎকার।
এই এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে মি. কিম বিবিসিকে বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট সরকারের মধ্যে তিনি ছিলেন ‘লালের চাইতেও লাল’- অর্থাৎ একজন খুবই অনুগত কমিউনিস্ট।
কিন্তু উত্তর কোরিয়াতে আপনার সামরিক মর্যাদা কিংবা আনুগত্য আপনার নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারে না, বলছেন তিনি।
প্রাণ বাঁচানোর জন্য তিনি ২০১৫ সালে পক্ষ ত্যাগ করেন। তখন থেকে তিনি সিউলে বসবাস করছেন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি জানালেন কীভাবে অর্থ সংগ্রহের জন্য উত্তর কোরিয়ার সরকার মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকাতে অস্ত্র ও মাদক বিক্রি করছে। পিয়ংইয়াং সরকারের মধ্যে কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কীভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয় এবং উত্তর কোরিয়ার গোপন গুপ্তচর বাহিনী ও সাইবার টিম কীভাবে বিশ্বড়ুড়ে তৎপরতা চালাতে পারে, মি. কিম সেই বর্ণনাও দিয়েছেন। তবে কোনো নিরপেক্ষ সূত্র থেকে বিবিসি এসব দাবি যাচাই করতে পারেনি। কিন্তু আমরা তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে, তার দাবির পক্ষে প্রমাণ খুঁজে পেয়েছি। এজন্য আমরা লন্ডন এবং নিউ ইয়র্কে উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তবে তারা কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়নি।

সন্ত্রাসের টাস্ক ফোর্স
উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ গুপ্তচর সংস্থায় মি. কিমের শেষ কয়েকটি বছরে তিনি বর্তমান নেতা কিম জং আন-এর রাজনৈতিক কেরিয়ারের গোড়ার দিকটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি জানালেন, কিম জং আন ছিলেন একজন তরুণ যিনি নিজেকে একজন ‘যোদ্ধা’ হিসেবে প্রমাণ করতে সচেষ্ট ছিলেন।
উত্তর কোরিয়া ২০০৯ সালে নতুন একটি গুপ্তচর সংস্থা গঠন করে, যার নাম রিকনিস্যান্স জেনারেল ব্যুরো। সে সময়টাতে কিম জং আন-এর বাবার স্ট্রোক হয়েছিল। কিম জং আনকে গড়ে তোলা হচ্ছিল নতুন নেতা হিসেবে। ওই ব্যুরোর প্রধান ছিলেন কিম ইয়ং-চোল, যিনি এখনো উত্তর কোরিয়ার নেতার খুবই আস্থাভাজন সহচর।

উত্তর কোরিয়ার সাবেক প্রধান কিম জং ইল। পেছনে তার ছেলে কিম জং আন, যিনি এখন সে দেশের সর্বময় নেতা।

মি. কিম জানালেন ২০০৯ সালের মে মাসে তাদের কাছে একটি আদেশ এলো একটি সন্ত্রাসী টাস্কফোর্স গড়ে তুলতে। লক্ষ্য ছিল উত্তর কোরিয়ার পক্ষ ত্যাগকারী এক কর্মকর্তাকে হত্যা করা। ‘কিম জং আন-এর জন্য এটা ছিল সর্বোচ্চ নেতা (তার বাবা)কে সন্তুষ্ট করার এক প্রয়াস,’ বলছেন মি. কিম।
‘ঐ কর্মকর্তা হুয়াং জাং-ইয়পকে হত্যা করতে একটি ‘সন্ত্রাসী টাস্কফোর্স’ গড়ে তোলা হয়। আমি ব্যক্তিগত এতে নেতৃত্ব দিই। হুয়াং জাং-ইয়প ছিলেন উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর কর্মকর্তাদের একজন। উত্তর কোরিয়ার নীতিনির্ধারণীতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ১৯৯৭ সালে পক্ষ ত্যাগ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে যাওয়াটাকে উত্তর কোরিয়ার সরকার একেবারেই ক্ষমা করতে পারেনি। সেজন্যই পিয়ংইয়াংয়ের শাসক পরিবার চেয়েছিল প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। এই ষড়যন্ত্রের দায়ে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর দু’জন মেজর এখন সিউলে ১০ বছর সাজা খাটছেন। এই হত্যা প্রচেষ্টার কথা পিয়ংইয়াং সরকার বরাবরই অস্বীকার করে আসছে এবং বলে আসছে যে এটা দক্ষিণ কোরিয়ার সাজানো নাটক।

কিন্তু মি. কিম-এর এই জবানবন্দি ভিন্ন কথা বলছে। ‘উত্তর কোরিয়ায় কিম জং ইল এবং কিম জং আন-এর মর্যাদা রক্ষার জন্য সন্ত্রাস হচ্ছে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার’- বলছেন মি. কিম, ‘মহান নেতাকে খুশি করার জন্য এটা ছিল এক উপহার।’

কিন্তু ঘটনা এর পরও ঘটেছে।
এক বছর পর ২০১০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীর চেওনান নামে একটি জাহাজ টর্পেডো মেরে ডুবিয়ে দেয়া হয়। এতে ৪৬ জন মারা যান। ওই হামলায় জড়িত থাকার কথাও উত্তর কোরিয়ার সরকার অস্বীকার করেছে।

একই বছর নভেম্বর মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি দ্বীপ ইয়ংপিয়ং-এর ওপর উত্তর কোরিয়ার গোলন্দাজ বাহিনী কয়েক ডজন গোলাবর্ষণ করে। এতে দু’জন সৈন্য এবং দু?’জন বেসামরিক লোক নিহত হন। উত্তর কোরিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট কিম ইয়ং চোল-এর বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ায় বিক্ষোভ।
ওই হামলাটি কার নির্দেশে ঘটানো হয়েছে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মি. কিম বলছেন, তিনি ‘চেওনান এবং ইয়ংপিয়ং-এর ওপর হামলার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না। কিন্তু এসব হামলার কথা আরজিবি অফিসারদের কাছে গোপন ছিল না এবং তারা গর্বের সঙ্গে এসব কথা বলাবলি করতো।’

আর এসব অপারেশন শীর্ষ নেতার নির্দেশ ছাড়া ঘটা সম্ভব ছিল না বলে তিনি বলছেন। ‘উত্তর কোরিয়ায় এমনকি যখন একটি রাস্তা নির্মাণ হয়, সেটা সর্বোচ্চ নেতার সরাসরি অনুমোদন ছাড়া ঘটে না। চেওনান জাহাজটি ডুবিয়ে দেয়া কিংবা ইয়ংপিয়ং দ্বীপের ওপর হামলা কোনো নিম্নপদস্থ কর্মকর্তার কাজ হতে পারে না।
‘এ ধরনের সামরিক কাজের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন কিম জং আন-এর বিশেষ নির্দেশেই ঘটে। এটা একটা সাফল্য।’

‘নীল বাড়ির গুপ্তচর’
মি. কিম বলছেন, উত্তর কোরিয়ায় তার দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি ছিল দক্ষিণ কোরিয়াকে শিক্ষা দিতে কৌশল তৈরি করা। লক্ষ্য ছিল ‘রাজনৈতিক গোলযোগ তৈরি করা।’ সেটা করতে হলে মাঠ পর্যায়ে লোকের প্রয়োজন। ‘অনেক ঘটনা আছে যেগুলো আমার নির্দেশে গুপ্তচরেরা দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়ে সম্পন্ন করেছে। অনেক ঘটনা আছে’- বললেন তিনি। তবে এসব ঘটনার বিস্তারিত কিছুই তিনি বলছেন না- শুধু একটি রহস্যময় ঘটনার কথা উল্লেখ করেন।

‘এক ঘটনায় উত্তর কোরিয়া থেকে একজন গুপ্তচরকে পাঠানো হয়েছিল, যে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের অফিসে কাজ করেছিল। তারপর সে নিরাপদে উত্তর কোরিয়ায় ফিরে আসে। সেটা ছিল ১৯৯০-এর দিকের ঘটনা। সে পাঁচ-ছয় বছর নীল বাড়িতে (ব্লুু হাউজ- দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের অফিসের নাম) কাজ করেছিল।

‘আমি আপনাকে বলতে পারি, উত্তর কোরিয়ার গুপ্তচরেরা দক্ষিণ কোরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত তৎপর।’

বিবিসির পক্ষে এসব দাবি কোনোভাবেই যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
দক্ষিণ কোরিয়ায় আটক বেশ ক’জন উত্তর কোরীয় গুপ্তচরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। এবং সংবাদপত্র এনকে নিউজের প্রতিষ্ঠাতা শ্যাড ও’কনর যেমনটা এক নিবন্ধে লিখেছেন, নানা ধরনের গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে দক্ষিণ কোরিয়ার কারাগারগুলো এক সময় উত্তর কোরিয়ার গুপ্তচরে বোঝাই ছিল। এ ধরনের ঘটনা বেশ কয়েকটি ঘটেছে এবং অন্তত একটি ঘটনায় উত্তর কোরিয়া থেকে সরাসরি একজন গুপ্তচরকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এনকে নিউজের তথ্য অনুযায়ী এসব ঘটনা ২০১৭ সালের পর থেকে কমে এসেছে। কারণ, পুরনো ধাঁচের গুপ্তচরবৃত্তি বাদ দিয়ে উত্তর কোরিয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করে গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করে। উত্তর কোরিয়া দরিদ্র দেশ হলেও পক্ষ ত্যাগকারী ব্যক্তিরা অনেক আগেই জানিয়েছেন যে পিয়ংইয়ং সরকারের অধীনে অন্তত ৬,০০০ দক্ষ হ্যাকার রয়েছে। মি. কিম-এর দাবি অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং ইল সেই ১৯৮০-এর দশক থেকেই ‘সাইবার যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে’ নতুন কর্মী প্রশিক্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ‘মোরানবং ইউনিভার্সিটি সারা দেশ থেকে সব মেধাবী শিক্ষার্থীদের বেছে নিয়ে ৬ বছর দীর্ঘ এক বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রমে ঢুকিয়ে দিতো’- জানালেন তিনি।

বৃটিশ নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও বলছেন, ল্যাজারাস গ্রুপ নামে পরিচিত উত্তর কোরিয়ার একদল হ্যাকার ২০১৭ সালে বৃটিশ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এনএইচএস এবং অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠানের ওপর সাইবার হামলা চালিয়ে সেগুলো প্রায় অচল করে দিয়েছিল। একই গ্রুপটি ২০১৪ সালে সনি পিকচার্সের হামলার পেছনে ছিল বলে সন্দেহ করা হয়।

মি. কিম বলছেন, এদের অফিসটির নাম ছিল ৪১৪ লিয়াজোঁ অফিস এবং এটি আরজিবির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। তিনি দাবি করছেন, সেটি ছিল একমাত্র অফিস যার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার নেতার সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগ ছিল। ‘নিজেদের মধ্যে আমরা এর নাম দিয়েছিলাম কিম জং ইল-এর তথ্য কেন্দ্র।’

ড্রাগের বদলে ডলার
কিম জং আন সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে তার দেশে আবার এক ‘সংকট’ তৈরি হয়েছে এবং গত এপ্রিলে সবাইকে বলেছেন, আরেকটি ‘কঠিন যাত্রা’র জন্য  তৈরি হতে। এই কথাটি কিম জং ইল-এর শাসনামলে ব্যবহার করা হয়েছিল যখন উত্তর কোরিয়ার ব্যাপক এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সেই সময়টাতে মি. কিম অপারেশনস বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তাকে নির্দেশ দেয়া হয় মহান নেতার ‘বিপ্লবের জন্য’ অর্থ সংগ্রহ করতে, অর্থাৎ অবৈধ মাদক ব্যবসা শুরু করতে। ‘এই দায়িত্ব হাতে পাওয়ার পর আমি তিনজন বিদেশিকে উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে আসি। ওয়ার্কার্স পার্টির একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একটি কারখানা খুলি এবং মাদক  তৈরি শুরু করি।’

‘সেই মাদক ছিল আইস (ক্রিস্টাল মেথ), এগুলো ডলারে বিক্রি করে সেই অর্থ কিম জং ইল-এর কাছে পৌঁছে দিই।’ সেই সময়ে মাদক কারবারের ব্যাপারে মি. কিম-এর বক্তব্য গ্রহণযোগ্য, কারণ উত্তর কোরিয়াতে দীর্ঘদিন ধরে হেরোইন এবং আফিম তৈরি হয়েছে।

সাবেক উত্তর কোরীয় কূটনীতিক ইয়াং হো, যিনি নিজেও পক্ষ ত্যাগ করেছিলেন, তিনি ২০১৯ সালে অসলো ফ্রিডম ফোরামে জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়া সরকারিভাবে মাদক চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত। এবং সরকার সে দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক মাদকাসক্তিকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। আমি মি. কিমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেই অর্থ কোথায় গেল? সেটা কী জনগণের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে? ‘আপনাকে যে ব্যাপারটা বুঝতে হবে তা হলো উত্তর কোরিয়ার সব অর্থের মালিক উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা,’ তিনি বলছেন, ‘সেই টাকা দিয়ে তিনি প্রাসাদ তৈরি করেন, দামি গাড়ি কেনেন, পোশাক কেনেন এবং বিলাসী জীবনযাপন করেন।’

উত্তর কোরিয়ায় ১৯৯০’র দশক থেকে শুরু হওয়া খাদ্যাভাবে হাজার হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে অনুমান করা হয়। মি. কিম বলছেন, উত্তর কোরিয়ার আয়ের আরেকটি উৎস হচ্ছে ইরানের কাছে অবৈধভাবে অস্ত্র বিক্রি করা। এটিও দেখাশোনা করতো অপারেশনস ডিপার্টমেন্ট। ‘এই অস্ত্রের মধ্যে ছিল ছোট সাবমেরিন আর সেমি-সাবমারসিবল। এ ধরনের আধুনিক অস্ত্র তৈরিতে উত্তর কোরিয়া সিদ্ধহস্ত’- বলছেন তিনি। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ইরানের অস্ত্র ব্যবসা ১৯৮০’র দশক থেকেই ওপেন সিক্রেট এবং এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ব্যালিস্টিক মিসাইল, বলছেন উত্তর কোরিয়ার ওপর শীর্ষ পণ্ডিতদের একজন অধ্যাপক আন্দ্রেই ল্যানকভ।

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও উত্তর কোরিয়া ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র তৈরির গবেষণায় বেশ এগিয়ে রয়েছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশটি চারটি নতুন অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। এগুলো হচ্ছে দূরপাল্লার ক্রুজ মিসাইল, ট্রেন থেকে উৎক্ষেপণ করা যায় এমন ব্যালিস্টিক মিসাইল, হাইপারসোনিক মিসাইল এবং বিমান বিধ্বংসী মিসাইল। এই কাজে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তাও বেশ আধুনিক।
মি. কিম বলছেন, দীর্ঘদিন গৃহযুদ্ধ চলেছে এমন বেশ কয়েকটি দেশে উত্তর কোরিয়া অস্ত্র এবং প্রযুক্তি বিক্রি করেছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে জাতিসংঘ অভিযোগ করেছে যে সিরিয়া, মিয়ানমার, লিবিয়া এবং সুদানে অস্ত্র সরবরাহ করেছে উত্তর কোরিয়া।

পিয়ংইয়াং-এর তৈরি অস্ত্র বিশ্বের সমস্যাপূর্ণ এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে জাতিসংঘ বলছে।

‘অনুগত এক কর্মচারীর স্বপ্নভঙ্গ’
উত্তর কোরিয়ায় মি. কিম-এর জীবন ছিল নানা সুবিধায় ভরপুর। তিনি দাবি করেন কিম জং আন-এর ফুপু তাকে একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। উত্তর কোরিয়ার নেতার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তিনি অবাধে বিদেশে যেতে পারতেন।

তিনি বলেন, মূল্যবান ধাতু এবং কয়লা বিক্রি করে সুটকেস বোঝাই ডলার নিয়ে দেশে ফিরতেন। হতদরিদ্র একটি দেশে এ ধরনের জীবনযাপনের কথা অনেকেই কল্পনাও করতে পারবে না। বৈবাহিক সূত্রে মি. কিম-এর রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল ভালো। কিন্তু সেই একই সম্পর্ক তার জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছিল।

বিশেষভাবে কিম জং আন যখন তার চাচা জ্যাং সং থায়েককে হত্যা করেন, তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে আর উত্তর কোরিয়ায় থাকা চলবে না। মি. কিম-এর সঙ্গে আমার যে কয়েকবার দেখা হয়েছে, প্রত্যেকবারই আমি তার কাছে জানতে চেয়েছি তিনি কেন এখন মুখ খোলার সিদ্ধান্ত নিলেন। ‘এটা আমার একটা দায়িত্ব’ - বলছেন তিনি, ‘এখন থেকে এক স্বৈরাচারী শাসকের কবল থেকে আমার দেশের ভাইদের মুক্ত করার জন্য আমি কাজ করে যাবো।’ উত্তর কোরিয়া থেকে পক্ষ ত্যাগ করে আসা ৩০ হাজারেরও বেশি লোক এখন দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাস করছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে অল্পসংখ্যক মানুষই প্রকাশ্যে কথা বলেছেন।

কিন্তু তাদের এসব কথাবার্তা যাচাই করার সুযোগ কোথায়?
উত্তর কোরিয়ায় মি. কিম-এর জীবন ছিল একেবারেই ভিন্ন। কিন্তু তার বয়ানের মধ্য দিয়ে এমন এক শাসন ব্যবস্থার ভেতরের চিত্র পাওয়া যায়, যে শাসন ব্যবস্থা থেকে মানুষের পালানোর সুযোগ কমই। আর উত্তর কোরিয়ার শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কী কী করে, সে সম্পর্কেও একটা ধারণা পাওয়া যায়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর