ফিলিস্তিনের প্রথম সারির ৬টি মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলে আখ্যায়িত করেছে ইসরাইল। সঙ্গে সঙ্গে এর নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফিলিস্তিন সরকার, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো। ইসরাইলের এমন নির্দেশ জারির পর ওই ৬টি সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধে ঘেরাও অভিযান পরিচালনা করতে পারবে ইসরাইলি সেনারা। পারবে তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে। এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন ফিলিস্তিনিরা। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা। যেসব গ্রুপকে এই তালিকায় ফেলা হয়েছে তার মধ্যে আছে ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আল হক, আদামীর রাইট গ্রুপ, ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল-প্যালেস্টাইন, দ্য বিসান সেন্টার ফর রিসার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, দ্য ইউনিয়ন অব প্যালেস্টাইনিয়ান ওমেন্স কমিটিজ এবং দ্য ইউনিয়ন অব এগ্রিকালচারাল ওয়ার্ক কমিটিজ।
শুক্রবার ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ওই ৬টি মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ ফিলিস্তিনের পপুলার ফ্রন্ট অব দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি)-এর সঙ্গে যোগসূত্র আছে।
পিএফএলপি হলো একটি বাম ধারার রাজনৈতিক দল। পাশাপাশি তারা হলো একটি সশস্ত্র শাখা। ইসরাইলের বিরুদ্ধে তারা ভয়াবহ হামলা করেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, মানবাধিকার গ্রুপের ছদ্মাবরণে তারা পপুলার ফ্রন্টের পক্ষে আন্তর্জাতিক ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করছে। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেন পিএফএলপির সিনিয়র নেতারা। তারা এর সদস্যদেরকে নিয়োগ দেন। এর মধ্যে ওইসব সদস্য আছেন, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া পিএফএলপির জন্য অর্থ যোগানদাতার কেন্দ্রীয় উৎস হলো এসব সংগঠন। বিস্তারিত না জানিয়ে বলা হয়েছে, তারা ইউরোপিয়ান দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকে।
ইসরাইল সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে ফিলিস্তিনের নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে নগ্ন হামলা আখ্যায়িত করে এর নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসরাইলের অবৈধ দখলদারিত্ব এবং অব্যাহত অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ফিলিস্তিনি নাগরিক সমাজ ও জনগণের মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক এবং মানহানিকর অপবাদ দিচ্ছে এর মাধ্যমে।
ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছেন, ইসরাইল এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তার অফিসকে জানানো হয়নি। ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদেরকে তিনি টেলিফোনে বলেন, এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার ভিত্তি কি সে বিষয়ে আরো তথ্য জানার জন্য আমরা ইসরাইলের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবো। ওদিকে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তারা বলেছে, ওই ৬টি গ্রুপের কর্মকা-কে কার্যত নিষিদ্ধ করেছে এই সামরিক নির্দেশ। এর পরিণতিতে ইসরাইলি নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা এই গ্রুপগুলোর অফিস বন্ধ করে দিতে পারবে। তাদের সম্পদ জব্দ করতে পারবে। সদস্যদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠাতে পারবে। পাশাপাশি তাদেরকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়ার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। অ্যামনেস্টি এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক আন্দোলনের বিরুদ্ধে ইসরাইলি সরকারের ভয়াবহ ও অন্যায় আক্রমণ বলে অভিহিত করেছে। ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন বিষয়ক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরিচালক ওমর শাকির বলেছেন, মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করা সংগঠনের বিরুদ্ধে এটা হলো ইসরাইলের পর্যায়ক্রমিক আক্রমণ। তিনি আরো বলেন, ইসরাইলের ভয়াবহ নির্যাতন- মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, বর্ণবাদ, ফিলিস্তিনি লাখ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে নিষ্পেষণ, এসব নিয়ে যখন উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তারই প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে তাদের সর্বশেষ এই প্রতিক্রিয়া। বিষয়টি বাস্তবেই উদ্বেগের। একই সঙ্গে বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি পরীক্ষা। তারা মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ান কিনা পরীক্ষা তা নিয়ে। ওমর শাকির বর্তমানে বসবাস করছেন জর্ডানে। সেখান থেকে তিনি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের রিপোর্ট ডকুমেন্ট আকারে ধারণ করার জন্য দুই বছর আগে ইসরাইল তাকে দেশছাড়া করে। তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থার টার্গেটে পরিণত হয়েছেন।
ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিস বলেছে, তারা ইসরাইলের এই ঘোষণায় ‘এলার্মড’ বা সচেতন হয়ে উঠেছে। তারা বলেছে, বৈধ মানবাধিকার এবং মানবাধিকারের পক্ষের কাজকে সন্ত্রাসবিরোধী লেজিসলেশন দিয়ে দমন করা উচিত নয়। তারা আরো বলেছে, ওই ৬টি সংগঠন বন্ধ করার জন্য যেসব কারণ দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে কিছু কারণকে অস্পষ্ট এবং অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। মানবাধিকারের পক্ষে জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিউর মেরি ললোর এক টুইটে বলেছেন, এ খবরে তিনি উদ্বিগ্ন।
বর্তমানে ইসরাইল কর্তৃপক্ষের নিষিদ্ধ ঘোষিত আল হক গ্রুপের প্রধান শাওয়ান জাবারিন বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ইসরাইল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তারা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাজ বন্ধ করার জন্যই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইলি মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ বিৎসেলেম তার দেশের সরকারের এ ঘোষণাকে একটি কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের চরিত্র বলে বর্ণনা করেছে। তারা বলেছে, আমাদের ফিলিস্তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তাদের পাশে অবস্থান করছে বি’সেলেম। তাদের সঙ্গে আমরা বছরে পর বছর একসঙ্গে কাজ করে গর্বিত। এর নির্বাহী পরিচালক হাগাই আল-এড টুইটে জাবারিনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ফিলিস্তিনি সংগঠন দ্য আদালাহ জাস্টিস প্রজেক্ট বলেছে, ইসরাইলের সর্বশেষ এই সিদ্ধান্তে ওই সংগঠনের পক্ষে যারা কাজ করেন, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।