মানব পাচারের অভিযোগে নিজেদের অ্যাপ স্টোর থেকে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম সরিয়ে ফেলার হুমকি দিয়েছিল অ্যাপল। ফেসবুকে পরিচালিত কথিত অনলাইন স্লেভ মার্কেটের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী হিসেবে পাচার করা হত এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র নারীদের। এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ২০১৯ সালে ফেসবুককে এমন হুমকি দেয় অ্যাপল। সাবেক কর্মী ফ্রাসেস হিউগেনের আভ্যন্তরীণ নথি ফাঁস করার প্রেক্ষিতে সোমবার এ খবর প্রকাশ্যে আসে। এতে জানা যায়, শুধু ফেসবুক নয়, ইনস্টাগ্রামও ব্যবহৃত হতো নারী পাচারে।
ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই নারীদেরকে সৌদি আরব, মিশর ও কুয়েতে পাঠানো হতো। সবথেকে বেশি পাচার করা হতো ফিলিপাইনসহ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে। অ্যাপলের চাপের পর ফেসবুক পাচারের সঙ্গে যুক্ত প্রায় এক হাজার একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল।
এরপর অ্যাপলও তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। যদিও প্রকাশিত নথিতে জানা যায়, অ্যাপল হুমকি দেয়ার এক বছর আগে থেকেই এ বিষয়ে জানতো ফেসবুক। এমনকি এই অনলাইন স্লেভ মার্কেটের ‘এইচইএক্স’ নামের একটি কোড নাম ছিল।
সেসময় মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী নির্যাতন নিয়ে বৈশ্বিক গণমাধ্যমগুলোতে অনেক সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। এতে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া নারী গৃহকর্মীরা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন রিপোর্টে জানা যায়, তাদেরকে প্রহার করা হতো ও নানাভাবে হেনস্থা করা হতো। এমনকি তাদের পাসপোর্টও নিয়ে নেয়া হতো। ২০১৮ সালে ফিলিপাইনের এক গৃহকর্মীকে ফ্রিজের মধ্যে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এর প্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী গৃহকর্মী পাঠানো নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল ফিলিপাইনের সরকার। ফিলিপাইন সরকারের একটি সাইবার টিম ফেসবুকে সক্রিয় রয়েছে, যাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে এ ধরণের বিজ্ঞাপন থেকে দেশের নারীদের রক্ষা করা।
এদিকে এপি নিউজ জানিয়েছে, ফেসবুকের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হলেও বাস্তবে তার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। সংবাদ সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজকের দিনেও ফেসবুকে ‘খাদিমা’ বা আরবিতে দাসী লিখে সার্চ করলেও নানা বিজ্ঞাপন দেখা যায়। এতে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েদের বয়স ও ছবিসহ তাদের দাম উল্লেখ করা আছে।
ফেসবুকের ফাঁস হওয়া এক নথিতে লেখা আছে, আমাদের অনুসন্ধান অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া নারী গৃহকর্মীরা নানা ধরণের অভিযোগ করে থাকেন। এরমধ্যে আছে তাদেরকে বন্ধ ঘরে আটকে রাখা, খেতে না দেয়া, জোরপূর্বক তাদের চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি, বেতন না দেয়া এবং তাদের অনুমতি ছাড়াই অন্য মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়া। এ নিয়ে তারা তাদের কাজ দেয়া এজেন্সিগুলোর কাছে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ দেন। কিন্তু এজেন্সিগুলো শুধু তাদেরকে এসব নির্যাতন মেনে নেয়ার পরামর্শ দেয়। ওই রিপোর্টে আরও উল্লেখ আছে যে, ফেসবুক জানতো এই এজেন্সিগুলো গৃহকর্মীদের যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনা স¤পর্কে ওয়াকিবহল ছিল। কিন্তু এরপরেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিত না। সেসময় এপিকে দেয়া এক বিবৃতিতে ফেসবুক জানিয়েছিল, তারা এই অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। যদিও সামাজিক মাধ্যমটিতে এ জাতীয় বিজ্ঞাপন অব্যাহতভাবে প্রচার চলছিল।
অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা ইকুইডেম রিসার্চের নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফা কাদরি বলেন, ফেসবুক যদিও প্রাইভেট কোম্পানি। কিন্তু যখন এমন একটি কোম্পানির বিলিয়ন বিলিয়ন ব্যবহারকারী থাকে তখন এটি একটি রাষ্ট্রের মতো হয়ে যায়। এ কারণে ফেসবুক পছন্দ করুক বা না করুক তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। এই গৃহকর্মীদের ফেসবুকের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। সেখানে এ জাতীয় কোনো নীতিমালাই নেই। কীভাবে তাদেরকে কাজ দেয়া হবে এবং তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার হবে এগুলো নিয়ে কোনো নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নেই। তাই এমন পরিবেশে যখন কর্মীদের পাঠানো হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই এমন ভয়াবহ পরিণতি দেখা যায়। ফিলিপাইনের কর্মীদের সাহায্যার্থে কাজ করা গ্রুপ সান্দিগানের সদস্য ম্যারি অ্যান আবুন্দা বলেন, ফেসবুকের এখন দুটি চেহারা। এটি মানুষকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করছে। আবার একইসঙ্গে এটি সন্ত্রাসী ও সিন্ডিকেটগুলোর স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে, যারা সাধারণ মানুষের দুর্বলতাকে ব্যবহার করছে।
এদিকে হিউগেনের এমন দাবির প্রতিবাদ জানিয়েছে ফেসবুক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটির সিইও মার্ক জাকারবার্গ এ নিয়ে ১৩০০ শব্দের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। এতে তিনি দাবি করেছেন, হিউগেনের প্রকাশিত নথিগুলো হচ্ছে বেছে বেছে নেতিবাচক দিকগুলো প্রকাশ করা, যাতে করে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়।