একুশটা বছর। কীভাবে যেন চলে গেল। হিসাবের খাতায় কতো বদল! পাওয়া, না পাওয়া। সেদিনের কিশোর আজ মধ্যবয়সী। পাল্টে গেছে শরীরের গঠন, চুলের রঙ। জীবনে এসেছে সঙ্গী, সন্তান। বিয়োগান্তক কত ঘটনাও ঘটেছে। হারিয়েছি কতো প্রিয়জন।
কেউবা বাবা-মা’কে। হারিয়েছি বন্ধুদের। জীবনে যা যায় তা কি কখনো ফিরে? মাঝে-মধ্যে হাজির হয় পুরনো দিনগুলো। মুহূর্তের জন্য হলেও। ১২ই নভেম্বর, ২০২১। শুক্রবার। দিনটা আবার এলো। ঘুম ঘুম চোখ। রেডি হতে হবে দ্রুত। নাস্তা খাওয়ার তাড়া। কেডস কি পরা হয়েছে ঠিকমতো। রহিম স্যারের চোখ কি এড়ানো যাবে? কিংবা তাজুল ইসলাম স্যার কি অপেক্ষা করছেন কান্দিরপাড়ে। ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কোথায়?
কুমিল্লা জিলা স্কুল ৯৯ ব্যাচ। পুরনো বন্ধুরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে সারা দুনিয়ায়। এমনিতে এটা ভোগবাদী সমাজ। সবাই ব্যস্ত। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার সময় বের করাও কঠিন। আবার অনেকের জন্য ভৌগলিক দূরত্বের কারণে তা সম্ভবও হয়ে ওঠে না। পুনর্মিলনী নিয়ে আলোচনা চলছিল অনেকদিন ধরেই। তারিখও দেওয়া হয়। কিন্তু কালান্তক করোনায় থমকে যায় আয়োজন। এবার আবার নতুন করে সময় নির্ধারণ করা হয়। একদল বন্ধু দিনরাত পরিশ্রম করে সফল পুনর্মিলনীর জন্য। কিন্তু হঠাৎই বদলে যায় দৃশ্যপট। বলা নেই, কওয়া নেই স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় আমাদের বন্ধু দেওয়ান তকি। প্রার্থনা আর প্রচেষ্টা বিফল হয়। আমরা চোখের জলে বিদায় জানাই প্রিয় বন্ধুকে। হৃদয় ভেঙে গেলেও আমাদের মেনে নিতে হয়। কষ্ট আর যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে এগুতে থাকে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। শুক্রবার সকাল সকাল আমরা যখন বহু বছর পর কুমিল্লা জিলা স্কুল মাঠে সমবেত হই খুবই দ্রুত ফিরে যাই পুরনো দিনগুলোতে। আমাদের স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে বন্ধু দেওয়ান তকি। কতোজনের কতো স্মৃতি। তারা ছিল যমজ ভাই রকি, তকি। দুইজনেই জিলা স্কুল-৯৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী। পরবর্তী জীবনে তকি জড়িয়েছিল রাজনীতিতে। কিন্তু কোনো দুর্নাম কখনও সঙ্গী হয়নি তার। তকির সঙ্গে আমরা স্মরণ করি কামরুল, তমাল, সুমন, মোহাইমিন, সোহেল ও সোহাগকে। পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া আমাদের বন্ধুরা। এইখানে, এই ভূমে কতো কিছুই না ঘটবে। অথচ তাদের সঙ্গে আর কখনও আমাদের দেখা হবে না। আমরা হারিয়েছি বেশ কয়েকজন প্রিয় শিক্ষককেও। ভাবতেই কেমন লাগে। এই স্কুল থাকবে, মাঠ থাকবে। অথচ আমরা কেউ এখানে থাকবো না। আমরাতো তারই দিকে প্রত্যাবর্তন করছি।
আনুষ্ঠানিক পুনর্মিলনীর শুরুতে সকাল ৯টায় স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে বের হয় র্যালি। শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে তা আবার ফিরে আসে স্কুল প্রাঙ্গণে। বন্ধুরা ফিরে যায় ক্লাসে। কেউবা ক্লাস সিক্সের ছাত্র, কেউবা সেভেনের। কোথায় কী বদলে গেল, কোনটা ঠিক আগের মতোই আছে মেলানোর চেষ্টা চলে। মোবাইলের ক্যামেরায় বন্দি করার চেষ্টা করা হয় সময়টাকে। সকাল ১১টায় আলোচনা অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রয়াত বন্ধুদের ও শিক্ষকদের স্মরণে পালন করা হয় নীরবতা। কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাশেদা আক্তার ৯৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আর সাবেক শিক্ষকদের নিয়ে কেক কাটেন। আলোচনায় অংশ নেন প্রাক্তন শিক্ষক মোসলেহ উদ্দিন, খগেন্দ্র বাবু, আবদুল ওয়াহাব, তাজুল ইসলাম, রিক্তা বড়ুয়া প্রমুখ। সাবেক শিক্ষার্থীদের চলার পথ নিয়ে দিক-নির্দেশনা দেন তারা। বিকালে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সন্ধ্যায় ফের মনটা খারাপ হয় আমাদের। কারণ বিদায়ের ক্ষণ যে এসে গেল। কিন্তু আশা শেষ হয় না। নিশ্চয় আবার দেখা হবে বন্ধু।