× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

কালজয়ী চিত্র মোনালিসার হাসি

মত-মতান্তর

গাজী মিজানুর রহমান
২৩ নভেম্বর ২০২১, মঙ্গলবার

শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে যার অল্প জ্ঞান আছে, তিনিও ‘মোনালিসা’ চিত্রকর্মটির নাম শুনেছেন। প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে এই চিত্রকর্মটি সংরক্ষিত আছে। এই ছবিতে একজন সাধারণ রমণীকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, তার স্মিত হাসি এবং অলংকারহীন শারিরীক সৌন্দর্য খুবই উচ্চমার্গের বলে বিবেচনা করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিল্পকর্ম ও সাহিত্যকর্মের মধ্যে কিছু খুঁত থাকে; যিনি রচনা করেন, তিনি সম্পাদনা করলে রচনা আরও উৎকৃষ্ট হতে পারে। কিন্তু সব জায়গায় এ নিয়ম খাটে না। কিছু কিছু সৃষ্টি আছে যা সম্পাদনা করতে গেলে তার স্বাতন্ত্র্য বিঘ্নিত হয়। ‘মোনালিসা’ শিল্পকর্মটি সেরকমই একটি সৃষ্টি। কিন্তু সাধারণ মানের চিত্রকর্ম-বোদ্ধা কেউ ছবিটির দিকে তাকালে বলবে, মোনালিসার হাসির কথা এত শুনলাম, কই, হাসতে তো দেখি না! সব হাসি কি সহজে দেখা যায়? মোনালিসার হাসি কষ্ট করে বুঝতে হয় বলে এই হাসির মূল্য এত বেশি আর সে চিত্রশিল্পট এত মহৎ।

রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন—“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু”—তখন তিনি সে-দেখাকে সাধারণ চোখে দেখার কথা বলেন না, বলেন গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখার কথা।
সব শিশিরবিন্দু শিল্পীর মন নাড়া দিতে পারে না। তাই সবসময়ের সূর্যালোক আর সবসময়ের পারিপার্শ্বিকতা শিশিরবিন্দুকে মহীয়ান ক’রে প্রেরণাদায়ী ভূমিকা পালন করে না। তার জন্য বিশেষ মুহুর্তের দরকার পড়ে। মোনালিসার হাসি সেরকমই একটা-কিছু। চোখের পাতা উঠালেই মনের দরজায় এসে সে টোকা দেয় না। এ হাসি হোটেলের অভ্যর্থনা-কক্ষের দরাজ হাসি নয়। এটা চেপে রাখা একটা হাসি— যার অভিব্যক্তি ঠোঁটের দরজা ঠেলে বাইরে আসতে চায়, কিন্তু আসে না। বুঝতে হলে তার দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হয়। মোনালিসার হাসি যেন পশ্চিমাকাশে দ্বিতীয়া চাঁদের মত একচিলতে সরু অবয়বের স্মিত হাসির রেখা, ঘাড় ব্যথা করে দেখতে হয়। তাই সে-দেখায় আনন্দ এবং বিস্ময় বেশি ।

লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি এই ছবিটি এঁকেছিলেন ১৫০৩ সাল থেকে ১৫১৯ সালের মধ্যে। ছবির নারী চিত্রটি আঁকার এক যুগ পরে এ ছবির পেছনের প্রাকৃতিক দৃশ্য অংকিত হয়। তখন অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগের অবসানের পর ইতালিতে রেনেসাঁর সূত্রপাত হইয়েছিল। সেখান থেকে গোটা ইউরোপ ক্রমে ক্রমে আলোকিত হতে থাকে। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি ছিলেন ইতালীয় রেনেসাঁর উত্তুঙ্গ সময়ের চিত্রকর, নকশাবিদ এবং ভাস্কর। তিনি থাকতেন ইতালির ফ্লোরেন্সে। সেখানকার এক বস্ত্র ব্যবসায়ী ফ্রান্সেসকো ডেল জিওকন্ডো এর স্ত্রী লিসা গেরাডিনি হচ্ছেন ‘মোনালিসা’ চিত্রকর্মের রমণী। বলা হয় যে, লিসা গর্ভবতী হয়েছেন --এ কথা বুঝাবার জন্য তিনি আনন্দ আর লাজনম্র অনুভূতি মিশিয়ে এ হাসিটা উপহার দিয়েছিলেন। উপহার দিয়েছিলেন এমন একজনকে যার তুলি বিস্ময় জাগাতে পারে। তাই তিনিও ছবির সাথে হয়ে গেলেন ইতিহাস। আর লিওনার্দো পেলেন ছবি আঁকার এক অতুলনীয় সময়ের প্রেরণা। ঠোঁট এবং চামচ মিলিত হলো একই মোহনায়।

মোনালিসার এই হাসি কি সম্পাদনাযোগ্য? একে আরো মনোমুগ্ধকর করা কি সম্ভব? এর উত্তর হবে -- না। লিওনার্দো নিজেও দ্বিতীয়বার তুলি হাতে নিয়ে এর চেয়ে ভালো সংস্করণ বানাতে পারবেন না। কারণ তখন তার মধ্যে সেই আগের প্রেরণা কাজ করবে না। বিশেষ একটা মুহূর্তে মনের উপর যে-এক সৃষ্টির বিদ্যুৎ খেলে যায়, তার নাম প্রেরণা। প্রেরণা ছাড়া অসাধারণ কিছু সৃষ্টি হয় না। সেটা অন্য কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে হতে পারে, কিন্তু সৃষ্টিশীল কাজের জগতে হয় না বললেই চলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, কবিরা বিশেষ সময়ে এমন এমন পংক্তি রচনা করেন, যা কবি নিজেই কিছুদিন পরে পড়লে ভাবেন, এমন সুন্দর আমি কী করে লিখলাম? সেরা আর্টের ক্ষেত্রে একই কথা খাটে। তবে প্রেরণা বলতে কোনো ঐশ্ব্ররিক অবদান বুঝানো হচ্ছে না। প্রেরণা মানে, একটা বিশেষ সময়ে নতুন এবং মহৎ কিছু সৃষ্টি করার বিশেষ তাগিদ।এই প্রেরণা বাইরের জগতের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ফলে নিজের ভেতর থেকে আসে। এটা কারো বক্তৃতা শুনতে শুনতেও হতে পারে। এটা এমন একটা-কিছু যা মনে দাগ কাটে। প্রেরণা শুধুই শিল্পীদের জন্য এককভাবে কুক্ষিগত সম্পদ তাও নয়। এ প্রসঙ্গে ৭ ই মার্চের ভাষণের কথা ভাবতে পারি আমরা। সময়ের প্রেরণা থেকে সেদিন বঙ্গবন্ধু লক্ষ জনতার উদ্দেশে সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন এই বক্তৃতার কথামালা। সেজন্যেই এটা এত মহৎ এক বক্তৃতা।

‘মোনালিসা’ চিত্রকর্মটি শুধু এক রমণীর হাসিমুখের জন্য বিখ্যাত তা নয়। এর মধ্যে শিল্প-সৌকর্যের আরো আরো বিষয়-আশয় আছে। ব্রিটেনিকার দেয়া তথ্য মতে যখন ‘মোনালিসা’ আঁকা হয়েছিল, তখন এ রমণীর চোখের উপরের ভ্রুযুগল হালকা দৃশ্যমান ছিল। ছয় শত বছরের সংরক্ষণ কাজের ফলে এখন সেটা খালি চোখে দেখা যায় না। ‘মোনালিসা’ আঁকা যখন শেষ হয়, তখন লিওনার্দো ফ্রান্সের রাজকর্মচারি ছিলেন। ছবিটি রাজরাজড়দের ঘরের দেয়ালে টানানো থাকতো। সম্রাট নেপোলিয়ন এটা তার শয়নকক্ষের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতেন। রাজতন্ত্রের অবসানের পর ‘মোনালিসার’ ঠাঁই হয় ল্যুভর মিউজিয়ামে। এখান থেকে মিউজিয়ামে কাজ করতে আসা এক ইতালীয় নাগরিক ১৯১১ সালে শিল্পকর্মটি সরিয়ে ফেলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, তার দেশের শিল্পীর আঁকা ছবি ইতালীতেই মানাবে বেশি। এই ঘটনা নিয়ে তখন বিরাট হই-চই হয়েছিল। আর দুই বছর পরে মোনালিসা যখন পুনরায় ল্যুভর মিউজিয়ামের বুলেটপ্রুফ কাচের পেছনে ফিরে আসে, তখন তার জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। তাই মহৎ শিল্পকর্মের মহত্বই কেবল তার জনপ্রিয়তার একমাত্র কারণ নয়, আরো অনেককিছু এর পেছনে কাজ করে। সে যা-ই হোক না কেন, ‘মোনালিসা’ এক অনন্য শিল্পকর্ম, যা এক রমণীর প্রচ্ছন্ন হাসিকে সমাচ্ছন্ন করবে যুগান্তরের সংস্কৃতি-প্রেমী মানুষের বুকে।

( লেখক ও সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট )
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর