হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি নেই। মঙ্গলবার রাতে তার স্বাস্থ্যের অবস্থা কিছুটা খারাপ হলেও গতকাল সারাদিন ছিল আগের মতোই। সিসিইউতে রেখেই তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা লিভারে। এই জটিলতা বাড়ছে। চিকিৎসকের ভাষ্যমতে, লিভার সিরোসিসের দিকেই এগোচ্ছে। তবে এখন ঠিক আগের স্টেজে আছে। কিডনির ক্রিয়েটিনিন হু হু করে বর্ডার লাইন ক্রস করছে।
বেগম জিয়ার মেডিকেল বোর্ড সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
মেডিকেল বোর্ডের এক চিকিৎসক মানবজমিনকে বলেন, গেল কয়েকদিন খালেদা জিয়ার বমির সঙ্গে রক্তপাত হচ্ছিল। এজন্য গত কয়েকদিন আগে তার এন্ডোস্কপি করানো হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। এছাড়া অন্য সমস্যাগুলোর কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। লিভারের জন্য গ্যাস্ট্রন্টেরোলজি অ্যান্ড হেপাটোলজি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা চলছে। প্রধান ইলেকট্রোলাইট অর্থাৎ সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ক্লোরিন উপাদানের পরিমাণ কমে যাওয়ায় দুর্বলতা বেড়ে যায় এখন তারও একটু উন্নতি হয়েছে। ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে যান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ রাজনৈতিক এবং নাগরিক সমাজের নেতারা। সেখানে তারা প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় অতিবাহিত করেন। পরে গতকাল দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, খালেদা জিয়া অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মধ্যে আছে। যেকোনো মুহূর্তে চলে যেতে পারেন। তার অবস্থা অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল। মেডিকেল বোর্ডের ৬ জন চিকিৎসক আমাকে বিস্তারিত বলেছে। আমি তাদের ফাইল এর প্রত্যেকটা লেখা পড়ে দেখেছি। উনার মুখ দিয়ে রক্তপাত হচ্ছে। পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হচ্ছে। ব্লাড প্রেসার একশ’র নিচে নেমে এসেছে। আমি গত মঙ্গলবার গিয়ে দেখেছি বেগম জিয়াকে রক্ত দেয়া হচ্ছে।
বিএনপি’র ৮ দিনের কর্মসূচি ঘোষণাখালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে ৮ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। মূল দল ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। গতকাল দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কর্মসূচির কথা জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর আগে দলটির যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের নিয়ে যৌথ সভা করেন মির্জা ফখরুল। সেখানে কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে অংশ নেয়া এক নেতা জানান, অন্তত শান্তিপূর্ণ ও অহিংস পদ্ধতিতে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কর্মসূচি সোমবার স্থায়ী কমিটিতেই দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কোনো ধরনের সহিংসতা সৃষ্টি হয় এমন কর্মসূচি এড়িয়ে যেতে দলের মূল নেতৃত্বের নির্দেশনা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং সম্পাদকমণ্ডলীয় নেতাদের সঙ্গে যৌথ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে আমাদের এসব কর্মসূচি পালন করা হবে।
কর্মসূচিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ২৫শে নভেম্বর যুবদলের সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি এবং ঢাকায় এই বিক্ষোভ সমাবেশ হবে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে। ২৬শে নভেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজের পর মসজিদে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তির জন্য দোয়া মাহফিল হবে। একইভাবে মন্দির-প্যাগোডায় বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। স্বেচ্ছাসেবক দলের উদ্যোগে ২৮শে নভেম্বর সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় এই বিক্ষোভ সমাবেশ হবে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে। ৩০শে নভেম্বর বিএনপি’র উদ্যোগে বিভাগীয় শহরগুলো সমাবেশ করা হবে। ১লা ডিসেম্বর ছাত্রদলের উদ্যোগে সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ পালন করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা দলের উদ্যোগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হবে ২রা ডিসেম্বর। কৃষক দলের উদ্যোগে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ হবে ৩রা ডিসেম্বর এবং ৪ঠা ডিসেম্বর মহিলা দলের উদ্যোগে মৌন মিছিল করা হবে।
বিএনপি’র চলমান কর্মসূচি দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছি। সমাজে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ইস্যুতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। তবে, সব পরিস্থিতি বুঝে আমাদের কর্মসূচি দিতে হয়। কোনো হঠকারিতামূলক কর্মসূচি আমরা দিতে চাই না।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমান উল্লাহ আমান, আব্দুস সালাম, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।
মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন খালেদা জিয়া: রিজভীবেগম খালেদা জিয়া মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন বলে জানিয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গতকাল দুপুরে ঢাকা জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলামের কাছে স্মারকলিপি দেয়ার পর এ কথা বলেন তিনি।
রিজভী বলেন, খালেদা জিয়া মিথ্যা মামলায় তিন বছর ধরে বন্দি রয়েছেন। এরপর তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমরা আগেও বলেছি, তাকে তিলে তিলে নিঃশেষ করতেই বন্দি করা হয়েছে। এর প্রমাণ হলো, তিনি এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
বিএনপি’র এই নেতা বলেন, আমরা বারবার বলেছি, উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হোক। কিন্তু সরকার নানা অজুহাত দেখিয়ে তার মুক্তির বিষয়টি বিলম্বিত করছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে যখন বন্দি ছিলেন, তখন তিনি বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। রিজভী আরও বলেন, ‘খালেদা জিয়া গণতন্ত্রকে অন্ধকার গুহা থেকে মুক্ত করেছেন। অথচ তাকে ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।’
খালেদা জিয়াকে দ্রুত মুক্তি ও বিদেশে সুচিকিৎসার দাবিতে ঢাকা জেলা বিএনপি’র পক্ষ থেকে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপি’র ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি মো. সালাউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আবু আশফাক, বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায় প্রমুখ।