× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মানব পাচারের ভয়ঙ্কর ফাঁদ, দশ মাসে ১৪৫ মামলা

শেষের পাতা

ফাহিমা আক্তার সুমি
২৭ নভেম্বর ২০২১, শনিবার

রিফাদুল ইসলাম হৃদয়। ভয়ঙ্কর টিকটকার নির্মাতা। শত শত তরুণ-তরুণীকে নিয়ে করতেন পার্টির আয়োজন। পার্টি ছিল হৃদয়ের নারী পাচারের মূল প্ল্যাটফরম। নারীদের ফাঁদে ফেলার অস্ত্র ছিল হ্যাংআউট ও পুল পার্টি। থাকতো সব ধরনের আয়োজন। পার্টিতে অংশ নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তো উঠতি বয়সী টিকটকাররা। সেই সুযোগে তৈরি করতো বন্ধুত্ব।
এরপর কৌশলে তরুণীদের পাচার করতো। হৃদয়ের এই পার্টিতে অংশ নেয়া অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। অনলাইনে তরুণীদের টিকটক মডেল বানানো ও অন্যান্য প্রলোভন দেখিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনে আকৃষ্ট করা হতো। দেখানো হতো উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন। যৌনবৃত্তিতে নিয়োজিত করা হতো এসব ভুক্তভোগী তরুণীদের। পাচারের পর তাদের বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করিয়ে জোরপূর্বক অশালীন ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করতো। যাতে তারা এই ধরনের কাজে বাধ্য হয়। মানব পাচারকারীদের
 ফাঁদে পড়ে এই তরুণীর মতো শত শত নারী-পুরুষ দুর্ভোগ আর যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। এমনকি হারাচ্ছেন জীবনও। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, গত দশ মাসে ১৪৫টি মামলা হয়েছে। এমন প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক ভুক্তভোগী পরিবার প্রতিকার ও সহযোগিতা চেয়েছেন।   
২০২১ সালে ভারতে বাংলাদেশি এই তরুণীর যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। টিকটকার হৃদয় তরুণীকে দল বেঁধে ধর্ষণ করে। প্রায় এক বছর ধরে পরিবারের সঙ্গে ওই তরুণীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো। পরিবারের কেউ জানতেন না তার সন্ধান। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তিনি। ভারতের পুলিশ জানায়, ওই তরুণীকে বিবস্ত্র করে শারীরিক নির্যাতনের পর দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়। বীভৎস কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে একটি পতিতালয়ে যৌনকর্মী হিসেবে তাদের বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। যৌনকর্মী হিসেবে অবাধ্য হওয়া ও লেনদেন নিয়ে বিরোধের জের ধরেই ভাইরাল হওয়া ভিডিওর ওই তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়।
এরপর ভিডিওর সূত্র ধরে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে ওইদিন রাতে হাতিরঝিল থানায় মামলা হয়। নির্যাতনের শিকার তরুণীর বাবা বাদী হয়ে পর্নোগ্রাফি ও মানব পাচার আইনে মামলাটি করেন। মামলায় একজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও চারজনকে আসামি করা হয়েছিলো। ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখে হৃদয়ের মা-বাবা নিশ্চিত হয়েছেন- ভয়ঙ্কর এ ঘটনার সঙ্গে তাদের ছেলে সম্পৃক্ত। এদিকে মামলায় বাদী বলেন, তার মেয়েকে দুবাইয়ে পাঠানোর কথা বলে ভারতে নিয়ে যান টিকটকার হৃদয়। এরপর আন্তর্জাতিক পাচারকারীদের কাছে তাকে বিক্রি করে দেন। টিকটকার বাবু ও নির্যাতনের শিকার তরুণীর বাসা মগবাজারে একই এলাকায়। টিকটকে মডেল বানানোর কথা বলে বিভিন্ন সময় ভারতে নিয়েছে চক্রটি।
শুধু টিকটক হৃদয় নয়, এই রকম অনেক মানব পাচার চক্রের ফাঁদে পড়ে হারাতে হচ্ছে সর্বস্ব। বিভিন্ন দেশে নেয়া ও চাকরির প্রলোভনসহ বিভিন্ন কৌশলে তাদের পাচার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এমন প্রতারণার শিকার অনেক নারী-পুরুষ সমাজে নানাভাবে অপমান-অপদস্থ হচ্ছেন। বিশেষ করে পাচার হওয়া নারীদের নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এসব ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই অভিযোগ করছেন। অভিযোগের সূত্রধরে তারা এ ধরনের প্রতারকদের আইনের আওতায় আনছেন।
১০ই নভেম্বর রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে মানব পাচার চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- ফয়সাল, সোহেল হোসেন, রুবি, সেলিনা ও কল্পনা। র‌্যাব জানিয়েছে, এই চক্রটি বেশি বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে নারী-পুরুষদের পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে আসছিল। ২০২১ সালের ২০শে মে এক তরুণীকে পাচার করা হয়। সেই তরুণীর খোঁজ পাওয়া যায়নি আজও। তরুণীর মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ অনুসন্ধান চালিয়ে এই চক্রকে শনাক্ত করে। চক্রটির মূল হোতা ফয়সালের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নয়ন মাতবরের কান্দি গ্রামে। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছেন, ১০ বছর ধরে পাচার কাজে জড়িত তারা। একজন তরুণীকে পাচার করতে তাদের খরচ হয় ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। এরমধ্যে বাংলাদেশে থাকা দালালের পেছনে যায় ১৫-২০ হাজার টাকা। তরুণীদের পাচারের পর অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হয়। ফয়সাল ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণে দেশটিতে দু’বার ছয় মাস করে জেল খেটেছে। সোহেলও ওই দেশে জেল খেটেছে ছয় মাস।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, গত দশ মাসে ১৪৫টি মামলা দায়ের হয়েছে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে। জানুয়ারিতে ১৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৩টি, মার্চে ১৪টি, এপ্রিলে ২টি, মে মাসে ১৫টি, জুন মাসে ২০টি, জুলাইতে ১৩টি, আগস্ট মাসে ১৭টি, সেপ্টেম্বরে ১৫টি ও অক্টোবর মাসে ২২টি। এবং মানব পাচার চক্রের ৪০৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৩৯ হাজার ৫৯ জন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন মানবজমিনকে বলেন, মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আমরা সবসময় সতর্ক অবস্থানে আছি। এই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন লোভনীয় চাকরি ও বিদেশে নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করছে। ভিসা জাল করে যে দেশে যাওয়ার সুযোগ আছে, সে দেশের কথা বলে ভিন্ন রুটে নিয়ে তাদের পাচার করে দিচ্ছে। বর্তমানে টিকটকের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়েও পাচার করা হচ্ছে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর