সালমা খাতুন, বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল তারকার নাম। টাইগ্রেস ক্রিকেটারদের ন্যূনতম খবরও যারা রাখেন তাদের কাছে পরিচিত মুখ এই অফ স্পিন অলরাউন্ডার। বাংলাদেশের আবহে যখন মেয়েদের ক্রিকেটে অংশ নেয়া গ্রহণযোগ্যতা পায়নি তখন ক্রিকেটকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেন তিনি। ক্রিকেটে কাটিয়েছেন এক যুগ। অংশ নিয়েছেন চারটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। এবার প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন বাংলাদেশের। ওডিআই বিশ্বকাপ খেলতে বাছাইপর্বের বাধা রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। বৈশ্বিক এই টুর্নামেন্টে খেলতে না পারালে আক্ষেপের শেষ থাকবে না সালমার।
বিশ্বমঞ্চে খেলার পরিকল্পনা এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটে নিজের দীর্ঘদিনের পদচারণার অভিজ্ঞতা নিয়ে ক্রিকবাজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সালমার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: আপনি এক যুগ ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন। দীর্ঘ পথ চলাটা কেমন ছিল?সালমা: অনেক পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছি আমরা। আমি এই জার্নিটা উপভোগ করেছি।
প্রশ্ন: আপনি যখন ক্রিকেট শুরু করেন সমাজের রক্ষণশীল মানসিকতা নিশ্চয়ই এটিকে সহজভাবে নেয়নি?সালমা: আমি যখন ক্রিকেট শুরু করি ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনার শিকার হইনি কিংবা কোনো বাধাও তৈরি হয়নি। কিন্তু সবাই আমার মতো ভাগ্যবতী নয়। অনেক মেয়ের সমালোচনা সহ্য করতে হয়, অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাদের। আমাদের দেশে নারী ক্রিকেটের তেমন নাম ডাক না থাকায় এটা নিয়ে অনেকে কথা বলতো। তবে আমি সবসময় মনে করতাম, যে যাই বলুক আমি জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়াবো এবং দেশের হয়ে খেলবো। আমার চিন্তা ছিল, যদি ভালো খেলি এবং ফিট থাকি তাহলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো। আমার লক্ষ্য ছিল জাতীয় দলের হয়ে খেলা এবং দেশের হয়ে অবদান রাখা এবং এখনও একই উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষেরা সমালোচনা না করে সমর্থন করছে আমাদের।’
প্রশ্ন: আপনি খুলনা অঞ্চলের মেয়ে। আর খুলনা মেয়েদের ক্রিকেটের ‘আঁতুর ঘর’ হিসেবে পরিচিত। আপনি কী মনে করেন এ বিষয়ে?সালমা: আমার মনে হয়, খেলাধুলার ব্যাপারে অনেক আগ্রহী খুলনার মেয়েরা। বিভিন্ন ধরনের সুযোগ পায় তারা, যেমন কোচিং সুবিধাটা পায় খুলনার মেয়েরা- সেজন্যই তারা এগিয়ে থাকে।
প্রশ্ন: আপনার ক্রিকেটের জার্নিটা শুরু হয় কোথায়?সালমা: আমি আমার চাচা, ভাই এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলতাম। আমাদের গ্রামে চাচার দলে আমিই একমাত্র মেয়ে সদস্য ছিলাম। সেখান থেকেই আমার ক্রিকেট যাত্রা শুরু হয়। চাচা আমার পরিবারকে ক্রিকেট খেলার বিষয়ে রাজি করিয়েছিলেন। সেখান থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে আমার। তবে কখনোই কল্পনা করতাম না যে, একদিন আমি জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারবো। যখন শুনলাম বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল শুরু করবে তখন আমি খুব খুশি হলাম। আমি ক্রিকেট খেলতে মনস্থ করলাম। আমার চাচা এবং মা এতে সম্মতি জানালেন। ২০০৭ সালে আমি খুলনা স্টেডিয়ামে যাওয়া শুরু করলাম এবং সেবছর ১০টি জেলার টুর্নামেন্টের জন্য বাছাই হয়। আমি খেলার সময় সালওয়ার কামিজ পড়তাম, ট্রাউজার পড়ে খেলতাম না। এমনকি প্রথমবার আমি সালওয়ার কামিজেই খুলনা স্টেডিয়ামে যাই। সেখানে আমি কোচ সালাউদ্দিন স্যারের (প্রয়াত) দেখা পাই। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কী করি? উত্তরে বললাম, আমি বল করতে পারি- স্পিন, পেস উভয়টাই। একইসঙ্গে ব্যাটিংও করতে পারি। এরপর এক ওভার করে পেস ও স্পিন বল করতে বলেন তিনি। সেই ট্রায়ালের পর স্যার আমাকে স্পিন বোলিং করার পরামর্শ দেন। সেই থেকে আমি স্পিন বল করি। অনুশীলনের পর সালাউদ্দিন স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, খেলার জন্য প্রয়োজনীয় জার্সি আছে কি না আমার। বললাম, নেই।
তখন তিনি আমাকে খেলার পোশাক কিনে দেন। এরপর প্রতিদিনই অনুশীলন করতে থাকি। অনেকের চোখেই আমার পারফরম্যান্স ধরা পড়ে।
প্রশ্ন: ২০০৭ সালে মালয়েশিয়ায় আপনার প্রথম সফর?সালমা: হ্যাঁ, আমাদের প্রথম সফর ছিল মালয়েশিয়ায়, ২০০৭ সালে। আমি সুযোগ পাই এবং ভালো খেলি। জাফরুল এহসান স্যার আমাদের কোচ ছিলেন। চার দেশীয় সিরিজ দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়।
প্রশ্ন: মেয়ে হিসেবে বাড়ির বাইরে থাকায় পরিবার থেকে কোনো বাধা পেয়েছেন?সালমা: আমি কখনো পরিবার ছাড়া থাকতাম না। একটি রাতও আমার মাকে ছাড়া কাটেনি। যখন খুলনা জেলা দলের হয়ে খেলার সুযোগ পেলাম, সেবারই প্রথম বাড়ির বাইরে থাকি। আমার মা খুব কেঁদেছিলেন, আমিও। মাকে যখন মালয়েশিয়া সফরের কথা জানাই, তিনি অনেক খুশি হন। আমার সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা এসেছিলেন তিনি, এয়ারপোর্টেও গিয়েছিলেন।’
প্রশ্ন: ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে না পারার আক্ষেপ হয় না?সালমা: অবশ্যই, আক্ষেপ হয় আমার। আমরা এখনও কোয়ালিফায়ারে রয়েছি এবং এখন আমার লক্ষ্য শুধুই ওয়ানডে বিশ্বকাপে। শুধু আমিই না দলের সবারই লক্ষ্য এটি। আমাদের এখনও বাছাইপর্বের বাধা টপকানো বাকি। আমি অন্তত একটি ওডিআই বিশ্বকাপ খেলতে চাই। যদি সেটা সম্ভব না হয়, তাহলে এটা আমার জন্য সবচেয়ে বড় আক্ষেপের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।’