× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শ্রাবস্তীঃ এক জাদুকরী তীর্থভূমি

অনলাইন

রিফাত আহমেদ
(২ বছর আগে) ডিসেম্বর ৩, ২০২১, শুক্রবার, ৩:৩৩ অপরাহ্ন

খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক। কোশল রাজ্যের বিশাল রাজধানী শ্রাবস্তী নগরী। কোশলে রাজত্ব তখন রাজা প্রসেনজিতের। ধনী ব্যবসায়ী সুদত্তের আমন্ত্রণে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ এসেছেন অন্ধকার শ্রাবস্তীকে আলোর পথ দেখাতে। রাজকুমার সিদ্ধার্থের বুদ্ধত্ব লাভের তখন সাত বছর হয়ে গেছে। কিন্তু হঠাৎ ভিন্নচিন্তার আবির্ভাব যেনো মানতে পারছে না এলাকাবাসী। আর এলাকাবাসীর এই বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে কয়েকজন গোঁড়া বিরুদ্ধচারীর দল। প্রায় তিনশ এর মতো জাফরান-রঙা আলখাল্লা পরিহিত শিষ্য সঙ্গে নিয়ে এসেছেন বুদ্ধ শ্রাবস্তীতে।
এলাকাবাসীর অনাস্থায় তাদের একজন হারিয়ে ফেললেন ধৈর্য, উদ্যত হলেন অলৌকিকত্ব প্রদর্শন করে তাক লাগিয়ে দিতে সবাইকে। কিন্তু বাধা হয়ে দাড়ালেন স্বয়ং বুদ্ধ। শিষ্যকে যত্ন নিয়ে বোঝালেন তিনি, অলৌকিকত্ব দিয়ে মনভোলানো এবং মনে সত্যিকার মানবতাবোধ জাগ্রত করার মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। জ্ঞানের মূর্ত প্রতীক গৌতম বুদ্ধের যুক্তিকে কিছুতেই খন্ডন করতে পারলেন না শিষ্য। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংযত করলেন তিনি। ব্যাপারটি নীরবে দাঁড়িয়ে দেখছিলো চতুর বিরুদ্ধাচারীর দলটি। তারা ভাবলো, এই তো সুযোগ সন্ন্যাসীকে ধরাশায়ী করবার। বুদ্ধের মহিমা সম্পর্কে অজ্ঞাত বিরুদ্ধাচারীরা নিজের অলৌকিকত্ব প্রদর্শনে তাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলো। তারা নিশ্চিত ছিলো যে, এই সন্ন্যাসী কোনো ধরনের অলৌকিকত্ব দেখাতে অপারগ। বুদ্ধ মৃদু হাসলেন। সেই হাসিতে কোনো অবজ্ঞা বা ঘৃণা ছিলো না, ভীষণ প্রশান্ত ছিলো সেই হাসি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বুদ্ধ রাজি হয়ে গেলেন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে। আর এরপরই ঘটেছিলো গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশার সবচেয়ে বড় অলৌকিক ঘটনা, যুগ যুগ ধরে হিমালয়ের পাদদেশের শ্রাবস্তী নগরী যার সাক্ষ্য বয়ে চলেছে।

কোশল একটি নদীবেষ্টিত রাজ্য। এর পশ্চিমে ছিলো সুমতি নদী, দক্ষিণে সর্পিকা বা স্যান্দিকা নদী, পূর্বে সদানীরা নদী এবং উত্তরে নেপালের পার্বত্য অঞ্চল। অচিরাবতী নদী বা বর্তমান রাপ্তী নদীর তীরে অবস্থিত শ্রাবস্তী নগরীতে প্রায় সব কিছুই ছিলো সহজলভ্য, আর এ কারণেই কোশলের রাজধানী ছিলো এটি। অধিকাংশের মতে, পালি ভাষার ‘সাবত্থী’ (অর্থাৎ যেখানে সব পাওয়া যায়) থেকেই ‘শ্রাবস্তী’ শব্দটি এসেছে। তবে অনেকে আবার এ-ও বলেন, ‘সবত্থা’ নামের এক ঋষির বাসস্থান এখানে ছিলো বলে এই জায়গার নাম হয়েছে ‘সাবত্থী’ বা ‘শ্রাবস্তী’।

এই শ্রাবস্তীরই খুব ধনী একজন ব্যবসায়ী সুদত্ত। তবে ধনী হলেও তিনি ছিলেন ভীষণ দানশীল। তিনি অনাথদের পিন্ডি বা খাবার দিতেন বলে লোকে তাকে ‘অনাথপিন্ডিক’ বলেই চিনতো। ব্যবসার কাজে মগধে তার আসা-যাওয়া সবসময় লেগেই থাকতো। আর মগধে গেলেই তিনি থাকতেন নিজের স্ত্রীর ভাইয়ের সাথে, যিনি নিজেও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। একবার মগধে গিয়ে সুদত্ত তার স্ত্রীর ভাইয়ের পরিবারকে কোনো অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির জন্য ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করতে দেখলেন। ‘বুদ্ধ’ নামের কোনো এক বিশেষ সন্ন্যাসী ও তার অনুগামী ভিক্ষুদের জন্য ছিলো এতোসব আয়োজন। ভোজ অনুষ্ঠানের দিন গৌতম বুদ্ধের দেখা পেয়ে এবং তার বাণী শুনে এক অদ্ভূত আত্মতৃপ্তিতে ভরে গেলো সুদত্তের হৃদয়। তিনি বুদ্ধকে অনুরোধ করলেন যেনো শ্রাবস্তীবাসীও বুদ্ধের দীপ্তিময় বাণী শুনে নিজেদের আত্মোপলব্ধির সুযোগ পায়। সুদত্ত শ্রাবস্তীতে যাওয়ার জন্য দাওয়াত করলেন বুদ্ধকে। কিন্তু বুদ্ধ জানতে চাইলেন, তার সঙ্গী প্রায় শ’খানেক ভিক্ষুদের জন্য যথেষ্ট জায়গা সুদত্ত দিতে পারবেন কি না। সুদত্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে জানালেন যে, তিনি সব ব্যবস্থা করে রাখবেন।

শ্রাবস্তীতে ফিরে গিয়ে অতিথিদের থাকার জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে খুঁজতে সুদত্ত পেয়ে গেলেন এক বিশাল বাগান বা উপবন। কিন্তু সেই উপবন ছিলো রাজকুমার জিতকে দেয়া রাজা প্রসেনজিতের উপহার। তাই সুদত্ত রাজকুমার জিতকে বললেন যে, তিনি এই উপবন কিনতে চান। রাজকুমার জিত ভীষণ কৌতুক অনুভব করলেন। বাবার দেয়া উপহার বিক্রি করার কোনো ইচ্ছাই তার ছিলো না। তাই তিনি সুদত্তকে বললেন এক অদ্ভূত দাম। অনেকটা ঠাট্টা করেই জিত বললেন, এই সম্পূর্ণ উপবনের ভূমি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে ঢেকে দিতে পারলেই একে বিক্রি করবেন তিনি। সুদত্ত নিজের সম্পদ বিক্রি করে জিতকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যিই চারটি গরুর গাড়ি ভর্তি করে স্বর্ণমুদ্রা পাঠালেন এবং নিজের লোকদের নির্দেশ দিলেন উপবনের সমস্ত ভূমি মুদ্রা দিয়ে আচ্ছাদিত করে দিতে। জিত এই অবাক কান্ড দেখে স্তম্ভিত হলেন এবং উপলব্ধি করলেন যে, নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ অতিথির জন্যই সুদত্তের এমন উন্মাদনা। চতুর্থ গাড়ির স্বর্ণমুদ্রা তখনও নামানো হয় নি এবং ইতিমধ্যেই উপবনের তিন ভাগের দুই ভাগ মুদ্রায় আচ্ছাদিত হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় জিত জানালেন, যেটুকু অংশ বাকি রয়েছে তা তিনি উপহারস্বরূপ দিতে চান আসন্ন বিশেষ অতিথিকে। আচ্ছাদিত অংশের সকল স্বর্ণমুদ্রা খরচ করে খালি অংশের সেই জায়গাটিতে বিশেষ প্রবেশদ্বার তৈরী করে দিলেন রাজকুমার জিত। আর রাজকুমারের সম্মানে সুদত্ত এই উপবনের নাম রাখলেন ‘জিতবন’ বা ‘জেতবন’।

অবশেষে সুদত্তের নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য জেতবনের পথে রওয়ানা হলেন বুদ্ধ। কিন্তু নতুন দিনের সম্ভাবনা নিয়ে আসা এই অতিথির প্রতি আস্থা আনতে পারলো না কিছু মানুষ এবং তারা অন্যদেরকেও উসকে দিতে লাগলো। শেষমেশ তারা যখন বুদ্ধের পরীক্ষা নিতে চাইলো, তখন শ্রাবস্তীর আকাশ ছেয়ে গেছে আশ্চর্য মেঘমালার ভিড়ে। মানবতাবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে মানুষকে সত্যের খোঁজ দেয়ার চেয়ে নিজের সক্ষমতা দেখানো হঠাৎ-ই আজ বড় হয়ে উঠলো গৌতম বুদ্ধের জন্য। শুরু হলো এক অতিপ্রাকৃতের যুদ্ধ। মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেলো শ্রাবস্তীর চেহারা। হঠাৎ করেই বুদ্ধের শরীরের উপরের অংশ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ এবং নিচের অংশ থেকে পানি বের হতে লাগলো। উপস্থিত সবাই হতভম্ব। এ কি করে সম্ভব! প্রকৃতির দুটি বিপরীতমুখী উপাদান একই সাথে কিভাবে বের করছে বুদ্ধ? ঘটনা এখানেই শেষ নয়। আগুন এবং পানি এবার ক্রমাগত নিজেদের জায়গা প্রতিস্থাপন করতে লাগলো, অর্থাৎ কাঁধ থেকে পানি বের হলে পা থেকে আগুন এবং পা থেকে আগুন বের হলে কাঁধ থেকে পানি বের হতে লাগলো। এবার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও পানি মিলে বুদ্ধের শরীরকে ঘিরে তৈরী হলো এক সাতরঙা রংধনু, আর সেই রংধনুর প্রতিটি রঙে আলাদা আলাদা আসনে বিভক্ত হয়ে গেলেন বুদ্ধ। শ্রাবস্তীবাসী হতবাক হয়ে দেখতে লাগলো একই বুদ্ধের ভিন্ন ভিন্ন রূপের আলাদা আলাদা অবয়ব; একজন বুদ্ধ ধ্যানে মগ্ন, তো আরেকজন বুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, আরেকজন বুদ্ধ হেঁটে বেড়াচ্ছেন, তো আরেকজন আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে আছেন, আরেকজন আবার অপর এক সত্ত্বার সাথে বিতর্কে জড়িয়ে আছেন ইত্যাদি। এমন দৃশ্যের অবতারণা বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুতে প্রথমবার হয়েছিলো, আর আজ তা দেখছে সমগ্র শ্রাবস্তীবাসী। হঠাৎ করেই শুরু হলো বৃষ্টি। কিন্তু সবাই অবাক হয়ে লক্ষ করলো, সেই বৃষ্টিতে ভেজার যাদের ইচ্ছা ছিলো, শুধু তারাই ভিজছে, বাকিদেরকে তো তা স্পর্শই করছে না। সহসাই প্রচন্ড শক্তিশালী এক ঝড় এলো এবং উড়িয়ে নিয়ে গেলো বিরুদ্ধাচারী নেতাদের তাঁবু। বিরুদ্ধাচারীরা মোট ছয় জন ছিলো। এতোক্ষণ যা যা ঘটে গেলো, এর মধ্যে তারা অনেক চেষ্টা করেও এক বিন্দু নড়াচড়া করতে পারে নি। বুদ্ধের ক্ষমতা নিজ চোখে দেখার পর লজ্জায় অবনত হয়ে যায় তাদের মাথা। তাদের একজন বাদে বাকি পাঁচজনই আত্মহত্যা করেছিলো। আর সেই ঘটনার পর শ্রাবস্তীর প্রায় নব্বই হাজার মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করেছিলো।

শ্রাবস্তীতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাকে বলা হয় ‘দ্য টুইন মিরাকেল’ বা ‘মিরাকেল অ্যাট শ্রাবস্তী’। এটি ছিলো বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা। গৌতম বুদ্ধ তার জীবদ্দশায় বিভিন্ন সময় পরিস্থিতির বিবেচনায় কিছু অলৌকিকত্ব দেখিয়েছেন, কিন্তু তাদের কোনোটাই শ্রাবস্তীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার অনুরূপ নয়। শ্রাবস্তীর ঘটনার বিবরণ আমরা দুটি জায়গা থেকে পেয়েছি, একটি হলো পালি ভাষার বুদ্ধঘোষের ‘ধর্মপদ আত্মকথা’ (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক) এবং অপরটি হলো সংস্কৃত ভাষার নাগার্জুনের ‘ধর্মসংগ্রহ’ এর অংশবিশেষ ‘প্রতিহার্য সূত্র’ (খ্রিস্টপরবর্তী ২য় শতক)।

বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান মতবাদ অনুসারে, ‘দ্য টুইন মিরাকেল’ সংঘটিত হওয়ার পর বুদ্ধ তিন মাসের বর্ষাবাসে স্বর্গে গিয়ে নিজের মৃত মাকে অভিধর্ম শিক্ষা দেন, যেনো তিনিও স্বর্গের পথ খুঁজে পান।

শ্রাবস্তী গৌতম বুদ্ধের জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তারকারী একটি জায়গা। এই জায়গাটির গুরুত্ব এতোই বেশি ছিলো যে, বুদ্ধ প্রায় ২৫টি ‘বর্ষাবাসব্রত’ এখানে কাটিয়েছেন। ‘বর্ষাবাসব্রত’ বুদ্ধেরই প্রণীত একটি নিয়মের অংশ। ভিক্ষুসংঘ গঠনের পর গৌতম বুদ্ধ তার ধর্মবাণী ছড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন ভিক্ষুদেরকে। তাই ভিক্ষুরা পায়ে হেঁটে পাহাড়-পর্বত পাড়ি দিয়ে লোকালয়ে যেতেন ধর্ম প্রচারের জন্য। কিন্তু বর্ষাকালে কাদামাখা পথে যাতায়াত, পোকামাকড় ও সাপের কামড়ের আশঙ্কা, রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি ভিক্ষুদের জন্য ভীষণ কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য বর্ষা ঋতুর তিন মাস, অর্থাৎ আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথি থেকে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত ভিক্ষুদেরকে বিহারে অবস্থান করে ধর্মের আলোচনা, ধ্যান ও জ্ঞানচর্চার পরামর্শ দেন বুদ্ধ। একেই ‘বর্ষাবাসব্রত’ বলা হয়, যা আসলে ভিক্ষুদের এক প্রকার আত্মশুদ্ধির অনুষ্ঠান।

শ্রাবস্তী নগরী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি তীর্থস্থানের মতো। ১৮৬২-৬৩ সালের দিকে স্যার আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম এই জায়গায় খননকাজ পরিচালনা করেন। তার চেষ্টায়ই এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় ড. হো, ড. জে. পি. ভোজেল, ড. কে. কে. সিনহা এবং প্রফেসর ইয়োশিনোরি আবোশীর তত্ত্বাবধানে বেশ কয়েকবার এই শ্রাবস্তীতে খননকাজ চলেছে।

জেতবন মঠের ধ্বংসাবশেষ থেকে সেই কুঁড়েঘরটি পাওয়া গেছে, যেখানে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ প্রায় ২৫টি বর্ষাবাসব্রত কাটিয়েছেন। সেই কুঁড়েঘরের ধ্বংসাবশেষের উপর ‘মুলাগন্ধকুটি’ নামের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ মন্দির নির্মিত হয়েছে। এ ছাড়াও জেতবন মঠে মিলেছে বুদ্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দুই জন শিষ্যের স্মৃতিস্তম্ভ, অনাথপিন্ডিক (সুদত্ত) এর স্তম্ভ এবং আঙ্গুলিমালার স্তম্ভ। তারা দুই জনই ছিলেন শ্রাবস্তীর অধিবাসী। অনাথপিন্ডিকের কথা তো জানা হলো। কিন্তু কে এই আঙ্গুলিমালা? আসলে আঙ্গুলিমালা ছিলেন একজন কুখ্যাত দস্যু। পথে-ঘাটে ভ্রমণরত লোকদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাদের আঙ্গুল কেটে আঙ্গুলের মালা বানিয়ে গলায় পরে থাকতেন তিনি। এমন ভয়ঙ্কর ডাকাত কি করে সন্ন্যাসী বনে গেলো, এটাই ভাবছেন তো। আসলে গৌতম বুদ্ধের মহিমা এতোই অদ্ভূত যে, তা এমন পাষাণহৃদয় পাপীকেও পরিণত করেছিলো তার উদারতম শিষ্যতে। হ্যাঁ, এই আঙ্গুলিমালা একদিন স্বয়ং বুদ্ধের পথ অবরোধ করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধের সর্বনাশ করার বদলে বুদ্ধের মহিমায় অভিভূত হয়ে নিজেই হয়েছিলেন অনুগত, মন-প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন বৌদ্ধত্বকে, বেছে নিয়েছিলেন অহিংসার পথ।

জেতবনের আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হলো ‘আনন্দবোধি’ গাছ, যা আসলে ‘বোধগয়া’ এর ‘মহাবোধি’ গাছেরই একটি চারা থেকে বিকশিত হয়েছে। ‘বোধগয়া’ এর ‘মহাবোধি’ গাছের নিচেই বুদ্ধত্ব অর্জন করেছিলেন সিদ্ধার্থ তথা গৌতম বুদ্ধ। আর এ জন্যই তিনি সেই গাছের চারা শ্রাবস্তীতে আনিয়েছিলেন, যেনো শ্রাবস্তীতে বসবাসরত তার অনুগামীরা তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ পান। সত্যি সত্যিই যদি এটি আসল ‘মহাবোধি’ গাছের অংশ হয়, তবে শ্রাবস্তীর এই ‘আনন্দবোধি’ গাছ নিঃসন্দেহে সবচেয়ে প্রাচীন বোধিবৃক্ষ হিসেবে পরিচিত শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরের ‘মহাবোধি’ গাছের চেয়েও বেশি প্রাচীন।

কথিত আছে, মোগাল্লানা নামের একজন ভিক্ষু ভূমি স্পর্শ করার আগেই মহাবোধি গাছের একটি পড়ন্ত বীজ সংগ্রহ করেছিলেন, যেটিকে সুদত্ত একটি সোনালী পাত্রে অঙ্কুরোদগমের জন্য রেখেছিলেন এবং বুদ্ধের আদেশে এটিকে আনন্দ নামের একজন শিষ্য জেতবনের প্রবেশপথে রোপণ করেছিলেন। গাছটি অদ্ভূতভাবে বেশ লম্বা হয়েছিলো এবং বুদ্ধ নিজে এর নিচে বসে সারারাত ধ্যানচর্চা করে গাছটিকে পবিত্র করেছিলেন। আনন্দের হাতে রোপণ হয়েছে বলে গাছটির নাম রাখা হয় ‘আনন্দবোধি’।

প্রথমে মগধের একটি অংশ হিসেবে এবং পরে ক্রমান্বয়ে মৌর্য সাম্রাজ্য ও কুষাণ সাম্রাজ্যের সময়ে শ্রাবস্তী নগরী ও জেতবন বিহার ভীষণ সমৃদ্ধি লাভ করেছিলো। গুপ্তযুগের শেষ দিকে গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গা একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। খননের সময় জায়গাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে রূপা ও তামার মুদ্রা, অযোধ্যার মুদ্রা এবং কুষাণ মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে।

শ্রাবস্তী শুধুমাত্র বৌদ্ধদের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছেও এই জায়গা বেশ গুরুত্ব বহন করে। তারা বিশ্বাস করে, ৩য় জৈন তীর্থঙ্কর শোভনাথের জন্মস্থান এই শ্রাবস্তী। শোভনাথ জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষসহ আরো বেশ কিছু জৈন ধর্মের নিদর্শন এই শ্রাবস্তীতে পাওয়া গিয়েছে। সুতরাং ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে হোক, কিংবা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে হোক, এই জায়গাটির বিশেষত্ব অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই।

[লেখকঃ চেয়ারপার্সন, সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’স এসিস্ট্যান্স ফাউন্ডেশন। ইতিহাস, বিজ্ঞান নিয়ে লেখা staycurioussis.com (বাংলা এবং ইংলিশ) ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
পাঠকের মতামত
**মন্তব্য সমূহ পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।
Sadek Hossain
৯ ডিসেম্বর ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:২৬

বাহ!

পরিতোষ চাকমা
৪ ডিসেম্বর ২০২১, শনিবার, ৫:৫৩

উপমহাদেশের প্রখ্যাত শ্রাবস্তী নগরীর বিষয়ে লেখনী শৈলী সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য ধন্যবাদ জানাই রিফাত আহমেদ ও মানবজমিন কর্তৃপক্ষকে। তাঁদের আগামী দিনে বয়ে আনুক আনবিল সুখ ও শান্তি । জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।

Palash Cox
৩ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার, ১:২৯

বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম তীর্থস্থান শ্রাবস্তীর ইতিহাসকে প্রকাশ ও প্রচার করার জন্য লেখক ও মানবজমিনকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। লেখক ও মানজমিনের দীর্ঘজীবী কামনা করছি।

Shahariar Shumi
৩ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার, ৭:২৯

An amazing piece of writing looking forward for more outstanding piece of writing ✍

যতি সেন বড়ুয়া
৩ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার, ৭:২৮

অসাধারণ লিখনি, বৌদ্ধ ধর্মের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক তথ্য জানতে পারলাম অনেক ধন্যবাদ মানবজমিনকে এবং লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সাথে লেখকের দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।

Ghazala Mohsin
৩ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার, ৬:২৩

An interesting and informative piece of writing.

Tanzeem
৩ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার, ৪:৪৪

Wow really nice. Very interesting, looking forward to read more.

Elora
৩ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার, ৪:২৪

লেখাটি খুব সুন্দর লাগলো। ধন্যবাদ মানবজমিনকে ধন্যবাদ রিফাত আপাকে।

দীপা ফেরদৌস
৩ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার, ৪:০১

অনেক সুন্দর লেখা

Mushfiqua Hasneen
৩ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার, ৩:৪৭

খুব খুব ভালো লাগলো। এত সুন্দর লিখেছেন।

Rafia Sharmin Imtiax
৩ ডিসেম্বর ২০২১, শুক্রবার, ৩:২৬

অপূর্ব! লেখাটি পড়ছি, মনে হচ্ছে যেন চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছি অসাধারণ লেখনী শৈলী। ধন্যবাদ মানবজমিন, ধন্যবাদ রিফাত আহমেদ।

অন্যান্য খবর