অনলাইন

ভারতীয় সাংবাদিকতার সাহসী কণ্ঠস্বরের চিরবিদায়

ড. মাহফুজ পারভেজ

২০২১-১২-০৪

ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক, সত্য প্রকাশের পথে নির্ভীকচিত্তের বিশ্লেষক বিনোদ দুয়া পরলোকগমন করেছেন। শনিবার (৪ ডিসেম্বর) দিল্লির একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সেখানকার আইসিইউ'তে ভর্তি ছিলেন বিনোদ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭। 
 
 
চলতি বছরের শুরুর দিকে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। সেই থেকেই তাঁর শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। পরবর্তীতে সমস্যা বাড়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। এদিন তার মেয়ে মল্লিকা দুয়া নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে নিজের বাবার মৃত্যুর খবর জানান। রবিবার (৫ ডিসেম্বর) দুপুরে দিল্লির লোধি গ্রাউন্ড শ্মশানে বিনোদ দুয়ার শেষকৃত্য হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সে কথা জানিয়েছেন জনপ্রিয় কৌতুক শিল্পী তথা অভিনেত্রী কন্যা মল্লিকা দুয়া।
 
টিভি সাংবাদিকতার রূপকার ছিলেন বিনোদ দুয়া। দূরদর্শনে কাজ করেছেন বেশ কয়েক বছর। পরবর্তীতে এডিটিভি-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন সাইট এবং চ্যানেলের সঙ্গে তিনি সংযুক্ত ছিলেন।
 
বিনোদ কন্যা জানিয়েছেন, 'আমাদের সাহসী এবং অসাধারণ বাবা বিনোদ দুয়া আজ প্রয়াত। অতুলনীয় জীবন কাটিয়েছেন তিনি। উদ্বাস্তু কলোনি থেকে যাত্রা শুরু করে ভারতীয় সাংবাদিকতার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ৪২ বছর ধরে অসীম সাহসের সঙ্গে সাংবাদিকতা করেছেন। আজীবন সত্যের জন্য লড়াই করেছেন। এই মুহূর্তে উনি আমাদের মায়ের সঙ্গে রয়েছেন। ওঁর ভালোবাসার মানুষ এবং স্ত্রী চিন্নার সঙ্গে স্বর্গে আছেন উনি। আমি নিশ্চিত সেখানেও ওঁরা আবার একসঙ্গে গান গাইবেন, রান্না করবেন, ঘুরবেন এবং অবশ্যই ঝগড়া করবেন।'
 
উল্লেখ্য, এ বছরই বিনোদ এবং তার চিকিৎসক  স্ত্রী পদ্মাবতী দুয়া করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। পদ্মাবতী ছিলেন দক্ষিণ ভারতের কেরালার মালয়ালম ভাষী মানুষ। করোনায় দু'জনের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে শুরু করে। পদ্মাবতী চলতি বছরের ১১ জুন মারা যান। দিল্লির গুরুগ্রামের যে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন পদ্মাবতী, সেখানেই ছয় মাসের ব্যবধানে মারা যান বিনোদ।
 
ভারতীয় মিডিয়ার 'দরবারি ও অনুগত সাংবাদিকদের' বাইরের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ছিলেন বিনোদের। সরকার ও প্রশাসনের তীব্র সমালোচনায় মুখর ছিলেন তিনি। ধর্মীয় উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও নাগরিক অধিকার হননের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। সংখ্যালঘু ও নিপীড়িত নাগরিক শ্রেণি পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি সবসময়।
 
বর্তমানে পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও  উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (এখন নাম খাইবার পাখতুনখাওয়া) সংলগ্ন ডেরা ইসমাঈল গাজি এলাকা মানুষ বিনোদ দেশভাগের কারণে জন্ম ও শৈশব কাটান পুরনো দিল্লির রিফিউজি কলোনিতে। কঠোর পরিশ্রম করে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে যোগ দেন সাংবাদিকতায়। নাটক, কবিতা, বাম রাজনীতির সংস্পর্শও তিনি লাভ করেন।
 
বিনোদকে বলা হয় ভারতের ভিজ্যুয়াল সাংবাদিকতার প্রথম প্রজন্মের অন্যতম একজন রূপকার। বেশ কয়েকটি নিউজভিত্তিক টিভি চ্যানেলের প্রতিষ্ঠা তার হাতে। সেখানে তিনি সংবাদভাষ্য ও সাক্ষাতকার গ্রহণের মতো বিষয়কে জনপ্রিয় ও মনোগ্রাহী করে তুলেন। ভারতের নগর পরিভ্রমণ আর বিচিত্র খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে তার সরেজমিন রিপোর্টিংগুলো ছিল তথ্য ও বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল। ইউটিউবে সেসবের ক্লিপিং মিলিয়ন ভিউ ও লাইক পেয়েছে।
 
শেষ জীবনে বিনোদ কর্পোরেট মিডিয়ার নীতি ও কৌশলের বিরোধীতা করে ওয়েবভিত্তিক চ্যানেলে বেশি মনোযোগ দেন। 'এইচডব্লিউ' সাইটে 'বিনোদ দুয়া শো' ছিল ঈর্ষান্বিত জনপ্রিয়তায় ধন্য। ভারতের নাগরিকত্ব আইন, কৃষি বিল, দিল্লির দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তিনি ক্ষমতাসীনদের প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। এজন্য তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার সম্মুখীন হতে হয়।
 
ইংরেজি ও হিন্দির পাশাপাশি মাতৃভাষা উর্দুতে ছিল বিনোদ দুয়ার তুলনাহীন দখল। গালিব থেকে শুরু করে মীর তকি মীর, দাগ, মাশরিকি, ইকবাল, সাহির লুধিয়ানভি, শাকিল বাদায়ুনি, হসরত মোহানী, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, কাইফি আজমি পর্যন্ত মশহুর কবিদের উক্তি, গজল ও নজমের কলি তিনি নান্দনিক ভঙ্গিমায় প্রয়োগ করতেন সমকালীন সমস্যার তুলনাকালে। সাহিত্যের সঙ্গে ইতিহাসবোধের মিশেলে তিনি তার বক্তব্য ও আলোচনাকে রসময়, যুক্তিনিষ্ঠ ও কঠোর সমালোচনার তলোয়ারে পরিণত করেছিলেন।
 
বিনোদ দুয়ার অনুষ্ঠান যারা একবার দেখেছেন, তারা তার পরবর্তী অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করতেন। শুধু ভারতে নয়, বিশ্বব্যাপীই ছিল তার অগণিত দর্শক। তার মৃত্যুতে ভারতীয় সাংবাদিকতার সাহসী কণ্ঠস্বর ও নৈর্ব্যক্তিক ধারার একজন অগ্রণী প্রতিনিধির চিরবিদায়ের করুণ বার্তা ধ্বনিত হলো। 
 
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status