ইতালির পালেরমো শহরে একটি চেয়ারের ওপর অস্বস্তি নিয়ে বসে আছেন এক বাংলাদেশি যুবক অভিবাসী। হাতে থাকা মোবাইল নাড়াচাড়া করছেন। লিবিয়া থেকে তিনি ইতালি গিয়েছেন। কিভাবে গিয়েছেন সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন বিবিসির কাছে।
২০১৯ সালে আলি (ছদ্মনাম) নামের এই যুবকের বয়স ছিল ১৯ বছর। সিদ্ধান্ত নেন ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণের মাধ্যমে কাজের সন্ধান করবেন। এ জন্য পিতামাতার অনুমতিও নেন। এক্ষেত্রে তাকে উদ্বুদ্ধ করেন একজন দালাল। বাস্তবে তারা হলো পাচারকারী।
সে বা তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশি যুবকদের ধনী দেশগুলোতে উন্নত বেতনের কাজের প্রলোভন দিয়ে পোস্ট দেয়। সিলিলিতে আরেকজন বাংলাদেশি বলেছেন, তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সে দালালের মাধ্যমে ২০১৬ সালে দেশ ছাড়েন। ডকুমেন্টে তার বয়স এখন ২১ বছর। বলেন, তিনি বিদেশে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বয়স কম থাকার কারণে পারছিলেন না। তাই এক দালাল তাকে একটি ভুয়া পাসপোর্ট বানিয়ে দেয়।
ওদিকে লিবিয়াতে অবস্থানকালে আলিকে লিবিয়া ত্যাগে অব্যাহতভাবে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে তার দালাল। এমনকি এ জন্য ওই দালাল আলিকে তার বাসায় রাতের খাবারের জন্য আমন্ত্রণও করে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় একটি কসমেটিক্সের দোকানে কয়েক বছর কাজ করছিলেন আলি। তা থেকে যা আয় হতো তা দিয়ে গ্রামে থাকা পরিবারকে সাপোর্ট দিতেন।
আলির মতো এমন সব তরুণ, যুবকদের আশাকে পুঁজি করে মানব পাচার করে দালালরা। তাদেরকে দারিদ্র্য থেকে উঠে আসার স্বপ্ন দেখায়। দেখায় অপার সম্ভাবনার দুয়ার। তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যক যারা ফাঁদে পা দেন, তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত দেখতে পান- তারা আসলে আটকে পড়েছেন ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ কবলিত লিবিয়ায়। পাচারের শিকার হয়ে এসব মানুষ লিবিয়ায় যাওয়ার পর তাদের সামনে থাকে তিনটি সুযোগ। তাহলো- সীমাহীন দুর্দশা, শোষণ আর দাসত্ব।
আলি স্বীকার করেন- লিবিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না আমার। কিন্তু দালাল আমার পিতামাতার সঙ্গে সাক্ষাত করে। তাদেরকে বলে যে, আমি লিবিয়ার কারখানায় কাজ করলে মাসে ৫০০ ডলার পর্যন্ত আয় করতে পারবো। এ অবস্থায় বাবা-মা জানান আমাকে বিদেশে পাঠানোর মতো অর্থ নেই তাদের। কিন্তু আমাদের কি কি সম্পদ আছে এসব খোঁজখবর নেয় দালাল। আমাদের ছিল তিনটি বেশ বড় গরু। দালাল তার একটি বিক্রি করে দিয়ে আমাকে বিদেশে পাঠানোর লোভ দেখায়।
লিবিয়া পৌঁছতে এক সপ্তাহ লাগে আলির। প্রথমে ঢাকা থেকে বাসে করে যান ভারতের কলকাতায়। তারপর বিভিন্ন ফ্লাইটে করে যান মুম্বই, দুবাই এবং কায়রো। এক পর্যায়ে লিবিয়ার বেনগাজি বিমানবন্দরে পৌঁছেন। সেখানে পৌঁছার পর দেখতে পান এক বিশৃংখল অবস্থা। কোনো নিরাপত্তারক্ষী বা পুলিশ নেই। পৌঁছার পর পরই তাকে দালালের নিয়োজিত স্থানীয় প্রতিনিধিরা নিয়ে যায়। আটকে রাখে একটি জেলখানার মতো স্থানে। তার সঙ্গে যে অর্থকড়ি ছিল সবটা কেড়ে নেয়। তারপর তাকে আটকে রাখে মুক্তিপণের জন্য।
মুক্তিপণ পরিশোধ করতে পিতামাতা তাদের অবশিষ্ট দুটি গরুও বিক্রি করে দেন। আলিকে যেখানে আটকে রাখা হয় তা একটি ছোট্ট রুম। তাতে কোনো মাদুর নেই। সঙ্গে রাখা হয়েছিল আরো ১৫ বাংলাদেশিকে। এর মধ্যে যারা মুক্তিপণ দিতে পারেননি, তাদেরকে খাবার দেয়া হতো না। খুব খারাপ আচরণ করা হতো।
আলি বলেন, অনেক সময় আমার সামনেই তাদেরকে প্রহার করা হতো। অনেক সময় গোপন স্থান দিয়ে রক্ত বের হতো। এমন আহত ব্যক্তিকে সাহায্য করতে কেউ ছিল না। এমনকি তাকে বা তাদেরকে হাসপাতালে নেয়া হতো না। কয়েক বছরে লিবিয়ায় পাচারকারীদের হাতে যেসব বাংলাদেশি আটক আছে তাদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়েছে। ২০২০ সালের মে মাসে রাজধানী ত্রিপোলির কাছে মিজদা এলাকায় একটি ওয়্যারহাউজে গুলি করে হত্যা করা হয় ৩০ জন অভিবাসীকে। এর মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশি।
আলিকে মুক্তি দেয়া হলে তিনি বেনগাজিতে একটি বোতলজাত পানির পাম্পে কাজ করেন তিন মাস। তারপর ত্রিপোলিতে একটি টাইলস ফ্যাক্টরিতে কাজ নেন। বিবিসি আরো লিখেছে, বর্তমানে লিবিয়ায় আছেন প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি। তাদের সঙ্গে যেমন, তেমনি আচরণ করা হতো আলির সঙ্গেও। কোনো বেতন দেয়া হতো না। বসবাস করতে হতো অসহ্যকর এক অবস্থায়। আলি বলেন, আমরা কাজ বন্ধ করলেই প্রহার করা হতো, লাথি দেয়া হতো, মাটিতে ফেলে দেয়া হতো। এক সময় আমাদের একজন একটি টাইলস ভেঙে ফেলে, তখন এক ব্যক্তি এসে তাকে লাথি মারে।
তারা বসবাস করতেন ওই কারখানার মালিকের অধীনে। তাদেরকে তালাবদ্ধ করে চাবি নিয়ে যেতো। আলি বলেন, মালিকই আমাদেরকে কাজে নিয়ে যেতেন। কাজ শেষে আবার বাসায় দিয়ে যেতেন। সার্বক্ষণিক আমাদেরকে পাহারা দিতেন দু’জন প্রহরী। আমরা যে কাজ করতাম, তার জন্য কোনো বেতন দেয়া হতো না। পর্যাপ্ত খাবার দেয়া হতো না। তাই আমরা পালানোর সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের একজন চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি দ্বিতীয় তলা থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেন।
বেশ কয়েকবার পালানোর ব্যর্থ চেষ্টার পর একজন দয়ালু লিবিয়ান আলিকে সাহায্য করেন। তাকে একটি মসজিদে আশ্রয় নিতে সাহায্য করেন। এ সময় আলির সামনে একটিই অপশন খোলা ছিল। তা হলো আবার পাচারকারীর সঙ্গে যোগাযোগ। এ সময় তিনি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছার টার্গেট নেন। আবার তার পিতামাতা অর্থ সংগ্রহে নামেন। তারা শেষ সম্বল বিক্রি করে তার সফরের অর্থ যোগন। ঋণ করেন। এতে বাংলাদেশ থেকে ইতালি পর্যন্ত যেতে তার পরিবারের মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৪০০০ ডলার।
গত বছর জুলাইয়ে সমুদ্র পাড়ি দেয়া আলির জন্য ছিল আরেক ভয়াল অভিজ্ঞতা। তারা একটি ডিঙ্গিতে ছিলেন ৭৯ জন অভিবাসী। আলি বলেন, টানা দুই দিন আমরা শুধু সমুদ্রের ভিতর ভেসেছি। এ সময় শুধু পানি আর পানি দেখেছি চারদিকে। কোথাও ভূমির দেখা মেলেনি। এক সময় একটু দূরে দুটি শার্ক দেখতে পাই। কেউ কেউ বলতে থাকেন, তারা আমাদেরকে খেতে আসছে। আমাদের জীবন শেষ।
এক পর্যায়ে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় লাপেদুসা দ্বীপে। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় সিসিলিতে। আলি বর্তমানে সিসিলির রাজধানী পালেরমোর বাইরে অভিবাসীদের একটি বিশাল ক্যাম্পে বসবাস করছেন। তার সঙ্গে আছেন নাইজেরিয়া, গাম্বিয়া ও সেনেগালের অভিবাসীরা। আলি বলেন, লিবিয়ায় কোনো বাংলাদেশি বা অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। তাদেরকে যেখানে আটকে রাখা হতো, তা নিয়ন্ত্রণ করতো পাচারকারীরা।
কিন্তু ইতালি পৌঁছার পর আলি অস্থায়ী ডকুমেন্ট পেয়েছেন। তাতে তাকে কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। মানবিক সুরক্ষার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছেন। বর্তমানে পালেরমো’র মিশ্র সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। আফ্রিকার অভিবাসীদের সঙ্গে একটি সুশি রেস্তোরাঁয় কাজ করছেন। সেখানে দরকষাকষির তেমন সুযোগ নেই। সাধারণ সিসিলিয়ান যে বেতন পান তার চেয়ে কম বেতন দেয়া হচ্ছে আলিদের। এতে তিনি সপ্তাহে ৬ দিন হিসেবে কাজ করার পর এক মাসে বেতন পান প্রায় ৮৭০ ডলার। এর মধ্যে ৫৭০ ডলার বাড়ি পাঠিয়ে দেন।