× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আলেকজান্ডারের পারস্য বিজয়: কিছু চমকপ্রদ ঘটনা

অনলাইন

গাজী মিজানুর রহমান
(২ বছর আগে) জানুয়ারি ২৩, ২০২২, রবিবার, ১২:১৪ অপরাহ্ন
আলেকজান্ডার এবং হেপায়েস্টিন তৃতীয় দারিয়ুসের পরিবারের সাথে দেখা করতে যান।

পারস্য এবং গ্রীসের মধ্যে প্রাচীনকালে দা-কুমড়ার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। রোম তখনও আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারেনি। ইজিয়ান সাগর তীরবর্তী ইউরোপীয় অঞ্চলে গ্রীসের জোটভুক্ত ছোট ছোট রাজ্যগুলির ছিল একচ্ছত্র দাপট। অন্যদিকে ব্যবিলনীয় সাম্রাজ্যের তখন মৃত্যুঘন্টা বেজেছে আর তদস্থলে নিকটপ্রাচ্য, মধ্য-এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে পারস্যের দাপট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মেসিডোনিয়ার আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট এর আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত পারস্যের এই প্রভাব দুই শত বছর স্থায়ী হয়েছিল। পারস্য তখন এশিয়া অঞ্চল থেকে দার্দানেলিস পেরিয়ে ইউরোপীয় ভূখন্ড আক্রমণ করতে যেত। তারপর উল্কার মত ছুটে এসে আলেকজান্ডার পারস্য সাম্রাজ্যের সমগ্র আনাতোলিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, মিশরসহ সবটুকু এলাকা দখল করে নেয়। ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত প্রাচ্যে আলেকজান্ডারের অভিযান অব্যাহত ছিল।

খ্রীস্টপূর্ব ৩২৪ অব্দে পাঞ্জাব অভিযান থেকে ফিরে এসে পারস্যের আকামেনিড সাম্রাজ্যের রাজধানী সুসাতে অবস্থানকালীন আলেকজান্ডারের মাথায় অভিনব এক ভাবনা স্থান পায়।
তিনি আগে থেকে দেখেছিলেন যে গ্রীক আর পারস্যের নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে। এবার আলেকজান্ডার ভাবলেন পারস্যকে স্থায়ীভাবে বশ করতে হলে রক্তের মিশ্রণ চাই। তাই তিনি গ্রীক অভিজাতদের বললেন পারস্যের অভিজাত কন্যাদের বিয়ে করতে। আলেকজান্ডার নিজে পারস্যের আগের দুই সম্রাটের দুই কন্যাকে বিয়ে করেন। তাকে সহ মোট ৮০ টি বিয়ে সম্পন্ন হয় একসাথে । পাত্রগণ ছিলেন আলেকজান্ডারের রাজকীয় বাহিনীর সেনাপতি ও অন্যান্য বিশিষ্ট পদাধিকারী। গ্রীক বরেরা চেয়ারে বসেছিলেন। আর পাশে একটি চেয়ার খালি ছিল। ভেতর থেকে ৮০ টি রমণী এসে যার যার হবু স্বামীর পাশে বসেন এবং গ্রীক কায়দায় বিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আলেকজান্ডার মারা যাওয়ার সাথে সাথে তার অমাত্যরা পারসিয়ান স্ত্রীদের পরিত্যাগ করেন ।

কেবল একজন তার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন নি । সেই ব্যক্তি হচ্ছেন তার একজন সেনাপতি – নাম সেলুকাস । তাকে ভারতবাসী সবাই চেনে । আলেকজান্ডার যখন খ্রীস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে পাঞ্জাব আক্রমণ করতে আসেন , তখন তার সঙ্গে ছিলেন এই সেনাপতি সেলুকাস । আলেকজান্ডার এ দেশের মানুষের ভাবগতিক দেখে তখন বলেছিলেন , কী বিচিত্র এ দেশ সেলুকাস ! এই সেলুকাস আলেকজান্ডরের মৃত্যুর পর সেলুসিড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন । ব্যবিলন থেকে শাসিত এই সাম্রাজ্যের বাহিনী খ্রীস্টপূর্ব ৩০৫ অব্দে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের ভারতীয় সাম্রাজ্য আক্রমণ করেছিল । যুদ্ধে কোনো পক্ষ চূড়ান্তভাবে পরাজিত না হলেও সেলুকাস বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয় । এ দেশ থেকে শত শত হাতি উপঢৌকন নিয়ে চলে যান সেলুকাস ।

আর নিজের কন্যা হেলেনাকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাথে বিয়ে দিয়ে যান । এ এক মহানুভব সন্ধি । প্রাচীনকাল থেকে যুদ্ধের সাথে প্রেম , ভালোবাসা , নারীর উপরে জবরদস্তি এবং বিবাহ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে । আর আছে সাংস্কৃতিক লেনদেন । বিজিত আর বিজয়ীর সংস্কৃতি যেমনটা মিশে যায় , তা ঐতিহাসিক ঘটনার চেয়ে কম চমকপ্রদ নয় ।

লক্ষণীয় যে , সে সময়ের রাজা-বাদশাহেরা যুদ্ধের ময়দানে নিষ্ঠুর হলেও ব্যক্তিগত জীবনাচরণ ও বিশ্বাসে তাদের কেউ কেউ ভালো লোক ছিলেন । এদিক দিয়ে আলেকজান্ডার সবার উপরে । আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের মত এত বড় সাম্রাজ্য ইতিহাসে বিরল । কিন্তু তার উদারতার কথা কিংবদন্তীতূল্য । আলেকজান্ডার এবং পাঞ্জাবের রাজা পুরুর মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল সেই যুদ্ধে পুরু পরাজিত হলেও তার রাজকীয় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে আনুগত্যের আশ্বাস পাওয়ায় আলেকজান্ডার তার রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন । এর পর আলেকজান্ডার পুরুর দেশের ‘কালানস’ নামের এক নাগা সাধুর ভক্ত হয়ে তাকে পাঞ্জাব থেকে সাথে নিয়ে পারস্যের রাজধানী সুসাতে যান ।

দীর্ঘ পথশ্রমে বৃদ্ধ কালানস একসময় অসুস্থ হয়ে পড়েন । তিনি জড়ভরত হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আত্ম-উৎসর্গ করে চিতায় উঠতে চান । আলেকজান্ডার তাকে নিরস্ত করতে ব্যর্থ হয়ে চিতা জ্বালাবার আদেশ দেন । নাগা সাধু মৃত্যুর আগে বলেছিলেন , আমেদের দেখা হবে ব্যাবিলনে । তখনো ব্যাবিলনে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না আলেকজান্ডারের । কিন্তু ভাগ্যের পরিণতি তাকে ঠিকই পরের বছর ব্যবিলনে নিয়ে যায় । সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে খ্রীস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে তার মৃত্যু হয় । অনেকে তখন বলতে থাকেন , নাগা সাধু তাদের দুজনের আত্মার দেখা হওয়ার কথা বলেছিলেন । মৃত্যুর পর আলেকজান্ডারের দেহ দুই বছর ধরে ব্যবিলনে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল । তারপর মেসিডোনিয়ার পথে রওনা হলে সিরিয়ার মধ্যে এক স্থানে আলেকজান্ডারের সেনাপতি মিশরের গভর্নর টলেমি পথরোধ করেন এবং মিশরে নিয়ে আলেকজান্ডারের দেহ প্রথমে মেম্ফিসে পরে আলেকজান্দ্রিয়ায় সমাধিস্ত করেন ।

এই মৃত্যু সংবাদে পারস্যের বিজিত সম্রাট দারিয়ুসের মাতা সিসিগাম্বিস এতই ভেঙ্গে পড়েন যে , তিনি তিন-চারদিন কিছু না খেয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেন । এ এক আশ্চর্যজনক ঘটনা । যে আলেকজান্ডার তার সন্তানের বিশাল সাম্রাজ্য কেড়ে নেন এবং আলেকজান্ডারের কারণেই রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে থাকা দারিয়ুস তার নিজের বাহিনীর সেনাপতিদের দ্বারা নিহত হন , সেই আলেকজান্ডারের মৃত্যুতে শোক , এটা কি করে সম্ভব ! এর উত্তর এভাবে দেয়া হয় যে, সিসিগাম্বিস তার পুত্রকে তখন ঘৃণা করতেন এবং আলাকজান্ডারের মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে স্নেহ করতেন । খ্রীস্টপূর্ব ৩৩৩ অব্দে ইসাস এর যুদ্ধে দারিয়ুস আলেকজান্ডারের কাছে পরাজিত হয়ে রাজধানী থেকে বিতাড়িত হয় । সেদিন দারিয়ুস এর পরিবার-পরিজন সকলেই তার সাথে ছিল ।

দ্বিগুন সৈন্য থাকা সত্বেও দারিয়ুস হঠাৎ করে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার কারণে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় । দারিয়ুস তার মাতা , স্ত্রী-সহ পরিবারের সকলকে ভুলে নিজের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে গিয়ে কাপুরুষতা দেখায় । এটা তার মাতা ক্ষমা করতে পারেননি এবং পরবর্তীকালে তাকে ঘৃণা করতে । অন্যদিকে বন্দী হওয়ার পর দারিয়ুস-পরিবারের সাথে আলেকজান্ডার ভালো ব্যবহার দেখিয়ে তাদের প্রিয়ভাজন হয়ে যান । এছাড়া আলেকজান্ডার পরে দারিয়ুস-কন্যা কে বিয়ে করায় সম্পর্কে সিসিগাম্বিস ছিলেন আলেকজান্ডারের দাদি-শাশুড়ি । আলেকজান্ডার যেদিন দারিয়ুসের বন্দী পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান সেদিন তার সাথে তার সেনাপতি ও বাল্য বন্ধু হেপায়েস্টিন ছিলেন । সিসিগাম্বিস ভুল করে হেপায়েস্টিনকে কুর্নিশ করলে রানীকে হেপায়েস্টিন বলেন , আলেকজান্ডার তিনি নন , অন্যজন । তখন রানী বিব্রত ও ভিত হন ।

কিন্তু আলেকজান্ডার তাকে বলেন , “ আপনি ভুল করেননি , মাতা ; এই ব্যক্তিও আলেকজান্ডার ." এমন বন্ধুত্ব ইতিহাসে বিরল । এই বন্ধু আলেকজান্ডারের মৃত্যুর ৮ মাস আগে মারা যান এবং তার মৃত্যুতে আলেকজান্ডার শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন ।

মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যও ভারতে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । তার সাম্রাজ্য মগধ থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । একসময় তার সাম্রাজ্যে খাদ্যাভাবে মন্বন্তর উপস্থিত হয় । মানুষের দুর্দশা দেখে চন্দ্রগুপ্ত নিজে অনশন করতে শুরু করেন এবং তাতেই তার মৃত্যু হয় । এমন মহানুভবতার ভুরি ভুরি উদাহরণ প্রাচীনকাল ও মধ্যযুগের ইতিহাসে আছে । কিন্তু আধুনিক যুগে এসে সত্যাশ্রয়ী বীরত্ব , মহানুভবতা , সৌজন্য বিনিময় –এগুলি তিরোহিত হয়েছে বলে মনে হয় । কেবল ক্ষমতা প্রাপ্তি আর ক্ষমতার সন্ধানই যেন একমাত্র মোক্ষ । ছলেবলে , কৌশলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা আর সত্যের সাথে মিথ্যা জড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের বহ্নুৎসব সর্বদা দৃশ্যমান । এর কোনো ভৌগলিক সীমারেখা নেই ।

গাজী মিজানুর রহমান (সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট ও লেখক)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
পাঠকের মতামত
**মন্তব্য সমূহ পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।
Dr Shameem Hassan
২৭ জানুয়ারি ২০২২, বৃহস্পতিবার, ৩:৫১

ইতিহাস লিখা হয় অনেক সময় আবেগ আবার অনেক সময় নিজ স্বার্থে। একই ঘটনা আবার অন্য যায়গায় অন্য ভাবে লিখা হয়েছে। ইতিহাস লিখানো হয় , কখনো লিখা হয় না।

SWARNA KAMAL CHAKRAB
২৩ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ১০:২৫

Absolutely wonderful. It is really a wonderful piece to remember. Expect more such articles from Mr. Mijanoor Saheb.

মোঃ মাহমুদুল হক
২৩ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ১২:১৮

সুন্দর একটি আর্টিকেল পড়লাম। লেখককে অশেষ ধন্যবাদ।

অন্যান্য খবর